২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের শৌর্য -বীর্যের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম জানান দেওয়ার দিন ২৬ মার্চ। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ থেকে স্বাধীনতা দিবসের মাধ্যমে সূচনা হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের। দীর্ঘ নয় মাসের এই যুদ্ধের মাধ্যমে অনেক ত্যাগ ও রক্তের মাধ্যমে আমরা বিজয় লাভ করি। অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা। তারপর থেকেই প্রতিবছর ২৬ মার্চকে পালন করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে। এ স্বাধীনতা দিবসের আনন্দোজ্জ্বল মুহূর্তের মধ্যে প্রথমেই যে কথা মনে পড়ে, তা হল এ দেশের অসংখ্য দেশপ্রেমিক শহীদের আত্মদান। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলার মানুষ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক স্বৈরশাসনের ২৪ বছরের গ্লানি থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল। লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে রাঙানো আমাদের স্বাধীনতার সূর্য। তাই এ দেশের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবস সব চাইতে গৌরবময় ও পবিত্রতম দিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। এরপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়ে, অর্থ দিয়ে, সম্পদ দিয়ে, সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়ে স্বাধীনতার পতাকা এ দেশের শ্যামল ভূমিতে ওঠাতে সক্ষম হয়েছিল।
পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয়ার পর থেকেই মূলত স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন করা হয়। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে রোধ করার জন্যে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ১৯৫২ সালে পুনরায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দিলে ছাত্র জনতা পুনরায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৯৫২ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। এ আন্দোলনকে স্তিমিত করার জন্যে গুলি চালানো হয়। শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার বরকতসহ আরও অনেকে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি এবং যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয় লাভ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার ভিতকে নড়বড়ে করে দেয়। তখন থেকেই স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপিত হয়। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে আটক করা হয়। কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে তাঁকে আটকে রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে টালবাহানা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ বলে জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। সারা বাংলায় শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। ২৫ মার্চের রাতের অন্ধকারে হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার, অসংখ্য ঘুমন্ত বাঙালি হত্যা এবং পরবর্তী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাঙালিরা দেশকে শত্রু মুক্ত করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। হানাদার বাহিনীও নিরস্ত্র মানুষদের ওপর নির্মম অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকে। তখন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে হানাদার বাহিনী ক্রমেই বিপর্যস্ত হতে থাকে। এমনি ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ সুযোগে ভারতের সেনাবাহিনী সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মওকা পেয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় অর্জিত হয়। জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এই দিনটি প্রত্যেক বাঙ্গালির জীবনে বয়ে আনে একই সঙ্গে আনন্দণ্ডবেদনা-গৌরবের এক অম্ল-মধুর অনুভূতি। গৌরবোজ্জ্বল এই দিনটি প্রতিবছর আসে আত্মত্যাগ, আত্মপরিচয় ও ঐক্যের বার্তা নিয়ে। সেই সাথে স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য। নব উদ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনা নিয়ে আসে এই দিন। তাই আমাদের উচিত এই দিনটিকে শক্তিতে পরিণত করে নতুন দিনের পথে এগিয়ে চলার। আর বাংলাদেশের এই মহা বিজয়ের মহানায়ক হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই সবুজ দেশে, ৫৩ বছর আগে এই দিনে উদয় হয়েছিল এক নতুন সূর্যের। সেদিনের সেই সূর্যের আলোয় ছিল নতুন নিদের স্বপ্ন। যে স্বপ্নে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল এ দেশের ৩০ লক্ষ্য মানুষ।