শিশু নির্যাতন দিন দিন বেরেই চলেছে। গত দুই-তিন বছরে প্রায় প্রতিদিনই রোমহর্ষ ঘটনার ভুক্তভোগী হয়েছে শিশুরা। সব খবর পত্রিকার পাতা, নিউজ পোর্টাল বা টেলিভিশনের পর্দা পর্যন্ত যায় না। বাংলাদেশে শিশু, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সমাজকল্যাণ ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে যথাযথ সমন্বয়ের অভাব সামগ্রিকভাবে শিশুর নির্যাতন মোকাবিলাকে কঠিন করে তুলেছে। তার সঙ্গে রয়েছে অপর্যাপ্ত পেশাদারি দক্ষতা এবং সীমিত বিনিয়োগ। বিভিন্ন বয়সী শিশুদের চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি আলাদা হয়। শিশু বিকাশের পর্যায়গুলো বুঝে তাদের বয়স উপযোগী ভালোবাসা এবং উষ্ণতা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষের দক্ষতা এবং আন্তরিকতার অভাব আছে। মনোযোগ দিয়ে শিশুদের কথা শোনা, কোনো বিষয়ে মতবিরোধ হলে তাদের বুঝিয়ে বলা যে গুরুত্বপূর্ণ, সেই বিষয়ে আমাদের অনেকেরই ধারণা নেই। প্রতিবছর বিশ্বের অর্ধেক শিশু (প্রায় ১০০ কোটি) শারীরিক, যৌন এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার। এর ফলে তারা আহত তো হয়ই, কেউ কেউ প্রতিবন্ধী হয়ে যায়, কখনো কখনো শিশুদের মৃত্যুও ঘটে। আমাদের সমাজে শিশু অপহরণ, বেআইনিভাবে কারাগারে আটকে রাখা ও যৌন নির্যাতনের মতো অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে। মেয়ে শিশুরা তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছেও নিপীড়নের শিকার হয়। এ ছাড়াও বাল্যবিবাহের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে মৌলিক অবিচার ও বৈষম্য করা হয়। ২০১৯ সালে প্রকাশিত ইউনিসেফের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৯ জন তাদের অভিভাবক, শিক্ষক ও পরিচর্যাকারীদের কাছ থেকে সহিংস শাস্তি ও আগ্রাসী ব্যবহারের শিকার হয়। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, 'সহিংসতার ধরন যেমনই হোক না কেন, এ অভিজ্ঞতার গুরুতর ও স্থায়ী প্রভাব রয়েছে। এ বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া গেছে, শৈশবে সহিংসতা থেকে তৈরি উদ্বেগ শিশুদের মস্তিষ্কের প্রবৃদ্ধিকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং স্নায়ুতন্ত্রের অন্যান্য অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।' ২০২২ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের পথশিশুদের মধ্যে ৫৬ শতাংশই বিভিন্ন ধরনের মাদকে আসক্ত এবং ২১ শতাংশ শিশু মাদক চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত। তাদের মধ্যে ১৪ শতাংশ ১০ বছর বয়স থেকে তারা মাদক গ্রহণ করছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সমীক্ষায় অংশ নেওয়া শিশুদের ৬৪ শতাংশেরই দৈনন্দিন জীবনযাপন ও নিজেদের যত্ন নেওয়ার বিষয়েও জ্ঞানের অভাব রয়েছে। এসব দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মাদক চোরাকারবারিরা তাদের কাছে মাদক বিক্রি করে এবং তাদেরকে মাদক বহনের মতো কাজে ব্যবহার করে। ঢাকা কিংবা সারাদেশে কত পথশিশু আছে, তার কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। তবে ধারনা করা হচ্ছে এই সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। ১০ লাখ পথশিশুর ৫৬ শতাংশ ধরলে এই সমস্যা কত বিস্তৃত সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। শিশু নির্যাতন বন্ধে প্রতিটি ইউনিয়নে শিকড়ওয়ালা একটা শিশুবান্ধব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। হামলা-মামলার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি যেন সেই শিশুবান্ধব প্রতিষ্ঠানটির ওপর ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে আরো সহায়ক ও সচেতন হতে হবে। তাহলে দেশের শিশু নির্যাতন অবসান ঘটানো সম্ভব।