এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বটগাছ টি কালীগজ্ঞ শহর হতে প্রায় ১০ কিঃমিঃ পূর্ব দিকে এর অবস্থান। বর্তমানে কালীগঞ্জ উপজেলার মালিয়াট ইউনিয়নের বেথুলী মৌজার সুইতলা-মল্লিকপুরে বর্তমানে ১১ একর জমি জুড়ে বিদ্যমান এই বটগাছটি এশিয়ার বৃহত্তম বটগাছ বলে খ্যাত। বটগাছ এমনিতেই বড়। বিশাল জায়গা নিয়ে এ গাছ তার ডালপালা বিস্তৃত করে। কিন্তু এই জায়গা যদি দুই একর নিয়ে হয় তাহলে সেই গাছ কত বড়! হ্যাঁ, এমনই একটি বটগাছের অবস্থান ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার সুইতলা মল্লিকপুরে। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে চিকন পিচের রাস্তা মল্লিকপুর ছুঁয়েছে। ১২ কিলোমিটার এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে সবুজের পাহাড়। যে সবুজের শেষ নেই। এটি সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছ। ৮নং মালিয়াট ইউনিয়নের বেথুলী মৌজায় বর্তমানে ১১ একর জমি জুড়ে রয়েছে এর অস্তিত্ব। এর উচ্চতা আনুমানিক ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট। বর্তমানে বটগাছটি ৫২টি বটগাছে রূপ নিয়েছে। বিবিসির জরিপে ১৯৮৪ সালে এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম খ্যাত এ বটগাছের অবস্থান ও নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা জটিলতা এবং রয়েছে কিংবদন্তী। কারও কাছে সুইতলার বটগাছ, কারও কাছে সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছ আবার কারও কাছে বেথুলীর বটগাছ বলে এটি পরিচিত। বিবিসির জরিপে একে এশিয়ার সবচেয়ে বড় বটগাছ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আর ২০০৯ সাল থেকে সামাজিক বন বিভাগ যশোর এ বটগাছটির ব্যবস্থাপনা করে আসছে। গাছটির উৎপত্তি সম্পর্কে স্থানীয়রা কোনো সুনিদির্ষ্ট তথ্য দিতে পারেনি, তবে প্রায় দুইশ’ থেকে তিনশ’ বছর পুরোনো বলে ধারণা করা হয়। গাছটি কে বা কারা লাগিয়েছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য কেউ না দিতে পারলেও জানা যায়, এখানে আগে কুমারদের বসতি ছিল। কুমার পরিবারের কোনো একটি কুয়োর মধ্যে আজকের বটগাছটির জন্ম। স্থানীয়দের মুখে গাছটি সম্পর্কে কথিত আছে ক’বছর আগে কুদরতউল্লা নামে একজন গাছের ডাল কাটলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। শুরু হয় রক্তবমি। কুদরতের স্ত্রী বট গাছ আগলে ধরে কান্নাকাটি করে। স্বামীর প্রায় ভিক্ষা চায়। অবশেষে তার স্বামী সুস্থ হয়ে ওঠে। এ রকম অনেক গল্প মল্লিকপুরবাসীদের কাছে শোনা যায়।
বটগাছটি কেন্দ্র করে পাশেই বাংলা ১৩৬০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেথুলী বা মল্লিকপুরের বাজার। এই বাজারের প্রথম দোকানদার ছিলেন মল্লিকপুর গ্রামের বেলায়েত আলী, বেথুলী গ্রামের স্বরজিত কুমার সাহা, মমতাজ ডাক্তার, মল্লিকপুরের মুনছুর বিশ্বাস ও মথুরাপুর গ্রামের হামিদুল। বটতলায় কালীপূজার জন্য একটি স্থায়ী পিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। চাপরাইল গ্রামের গৌর পদ অধিকারী এবং হাজারী লাল অধিকারীর আর্থিক সহায়তায় এটি নির্মিত হয়। এলাকাবাসী জানান, অযত্ন-অবহেলা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও নানামুখী অত্যাচারের কারণে ঐতিহ্যবাহী এ বটগাছের অস্তিত্ব আজ নষ্ট হতে চলেছে। মল্লিকপুর গ্রামের বেলায়েত মিয়া বেঁচে থাকা পর্যন্ত তিনি এসব দেখাশোনা করতেন। তিনি নিজ সন্তানের মতো ভালোবাসতেন এ বটবৃক্ষকে। যে কারণে তিনি এই বটগাছের কাছে সর্ব প্রথম দোকান দেন এবং বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয়রা আরও জানান, ১৯৮২ সালের পূর্ব পর্যন্ত এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বৃহত্তম বটগাছ বলে পরিচিতি ছিল কলকাতার বোটানিকেল গার্ডেনের একটি গাছ। পরবর্তীতে বিবিসির এক তথ্যানুষ্ঠান প্রতিবেদনে প্রচার হয়-‘মল্লিকপুরের বটগাছই এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম। ১৯৯৮ সালের দিকে কালীগঞ্জ উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা সুশেন চন্দ্র রায়ের সহযোগিতায় সেখানে একটি ফুলের বাগান তৈরি করা হয়। বটগাছের চারপাশ ঘিরে প্রাচীন নির্মাণের ব্যবস্থাও করেন তিনি। এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তর বটগাছের ঐতিহাসিক দিক বিবেচনা করে অনেক স্থান থেকে প্রতিনিয়ত দর্শনার্থীরা আসেন। এর গুরুত্ব বিবেচনা করেই ১৯৯০ সালেই বটগাছের পাশেই প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি রেস্ট হাউজ নির্মাণ করা হয়। মল্লিকপুর গ্রামের প্রবিন ব্যক্তি আবদুর রাজ্জাক জানান, এ বট গাছটির বয়স কত তা আশেপাশের গ্রামের লোকজন বলতে পারে না। তিনি মুরব্বিদের কাছে শুনেছেন ৩শ’ বছরের বেশি হবে। যে স্থানে মূল বটগাছের শুরু ওই স্থানের আশপাশে কুমার সম্প্রদায়ের বাস ছিল। সেনদের জায়গায় একটি পাতকুয়া ছিল। কোনো পাখি হয়তো কুয়োর ওপর বটের বীজ এনে ফেলে। সে বীজ থেকে চারা গজায়। জায়গাটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে বিস্তৃর্র্ন জায়গা জুড়ে ফেলে গাছটি। বাড়তে বাড়তে একসময় প্রায় দুই একর জায়গা দখল করে নেয় সেটি। পরিচিতি পায় এশিয়ার সর্ববৃহৎ বটগাছ হিসাবে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ গাছের গোড়াতে পূজা-অর্চনা শুরু করে। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বটগাছ এলাকায় নির্জনতা থাকে না। গাছের বৃদ্ধি ঘটে প্রোপরুট বা বোয়ার ওপর ভর করে।
এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বৃহৎ এ বটগাছটির ঐতিহাসিক দিক বিবেচনা করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন দর্শনার্থী আসেন এখানে। গুরুত্ব বিবেচনা করে ঝিনাইদহ জেলা পরিষদ বটবৃক্ষটির পাশে একটি রেস্ট হাউস নির্মাণ করেন ১৯৯০ সালে। বিস্তৃত বটগাছটির দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাখির কলরব, ছায়াঘেরা শীতল পরিবেশ মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের।
বন বিভাগের তথ্য মতে, এশিয়া মহাদেশের প্রাচীন ও অন্যতম বৃহত্তম বটবৃক্ষ প্রায় ৩১৫ বছর আগে স্থানীয় কুমারের কুয়ার দেওয়ালে জন্মেছিল। মূল গাছটি মারা গেলেও এটি ৪৫ এটি ভিন্ন ভিন্ন গাছে প্রায় ২ দশমিক ৮ একর জায়গাজুড়ে অবস্থান করছে। যার উচ্চতা প্রায় আড়াইশ থেকে ৩শথ ফুট। এর ৩৪৫টি বায়বীয় মূল মাটিতে প্রবেশ করেছে এবং ৩৮টি মূল ঝুলন্ত অবস্থায় বিদ্যমান। ২০০৯ সাল বন বিভাগ বটবৃক্ষটির ব্যবস্থাপনা করে আসছে। থানা পরিষদের কাঁচা পাকা সাপের মত সড়ক বটগাছের কোলে এসে থেমেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ পাহাড়। গাছের শাখা প্রশাখা কোথাও মাটির সাথে মিশেছে। পুরো গাছটি এক দৃষ্টিতে আনা অসম্ভব। স্মারক এ বটবৃক্ষটি ঘিরে রয়েছে নানা উপকথাও। কেউ কেউ মনে করেন, গাছটির বয়স অন্তত ৫০০ বছর। বেথুলি গ্রাম বহু আগে কুমার সম্প্রদায়ের বসতির জন্য বিখ্যাত ছিল। সেই সময় কুমার সম্প্রদায়ের লোকেরা পাতকুয়া ব্যবহার করতো, সেন বংশীয় কুমার পরিবারের কোনো একজনের পাত কুয়োর উপর একদিন একটি গাছ জন্মে। এত বছর আগে এখানে যে গাছটি জন্মে, ডালপালায় আভাস দেয় সেটি একটি বটগাছ। বটগাছ শুধু বটগাছই নয়। আঁকাবাঁকা বিভিন্ন আকৃত্তির ডালপালা, বসার জন্য জায়গা, গোল ঘর, পাখির কলতান, দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আনাগোনা এর সৌন্দর্যকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। চারপাশে বটগাছ, ছায়াঘেরা শীতল হাওয়া যে কারো মনে অন্যরকম প্রশান্তি জোগাবে। জার্নি করে যাওয়ার পর বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কিছুক্ষণ বসলেই প্রশান্তির ঘুম চলে আসবে। ডানেবামে সামনে পেছনে যেদিকে তাকাবেন শুধুই বটগাছ। গাছটির প্রাকৃতিক কারুকার্যে যে কেউ বিমোহিত হতে বাধ্য। এছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে আগত পর্যটকদের ক্লিকে ক্লিকে তৈরি হয় অন্যরকম এক ফটো অ্যালবাম।
বিখ্যাত বটের মূল গাছটি মারা গেছে। এলাকায় বেলায়েত মিঞা সেখানে একটি বটের চারা রোপন করেছেন। চারাটি এখন তরুণ অন্য ঝুড়িগুলো তাকে জায়গা করে দিয়েছে। মূল গাছটির অনেক ঝুরি বেড়ে উঠেছে। ঝুরিগুলো শেকড় মেলেছে। তারাও সবুজ হয়েছে বেশ। দেখে মনে হবে শত শত বটবৃক্ষ। তবে অযন্ত আর অবহেলার কারণে কিছু ঝুরি পোকায় নষ্ট করে দিয়েছে। অনেক ডালপালাও ভেঙ্গে পরেছে। ঝড়ে উপড়ে গেছে অনেক ঝুরির শেকড়। এরইমধ্যে বেশ কয়টি ঝুরির গাছ পৃথক হয়ে গেছে। ফলে গাছটি এখন আর এক নেই।