ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে দুই গ্রামের সংঘর্ষে নিহত ব্যবসায়ী ফয়সালের বাবা মো. রাকিব মিয়া বাদী হয়ে আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনার ১০ দিন পর গত ২৪ এপ্রিল সোমবার আদালতে দায়ের করা (জিআর-৭৭/২৩) করা ওই মামলায় স্থানীয় চেয়ারম্যান সায়েদ হোসেনসহ নামীয় আসামি করা হয়েছে ২৮ জনকে। এর আগে এই ঘটনায় নিহতের চাচা কুট্রাপাড়া গ্রামের মাফুজ মিয়া বাদী গত ১৬ এপ্রিল রোববার চেয়ারম্যন ও জিহাদ দুইজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ২০/২৫ জনকে আসামি করে সরাইল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। আদালত মামলা দুটি একত্রে সংযুক্ত করে তদন্ত করার জন্য সরাইল থানার অফিসার ইনচার্জকে (ওসি) নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ রাকিব মিয়ার দায়ের করা মামলার প্রধান স্বাক্ষী নিহতের মামা ওসমান হারূনী (৩৫) ভিডিও বক্তব্যে এই ঘটনার জন্য পুলিশকে দায়ী করেছিলেন। একই ঘটনায় দুটি হত্যা মামলা ও বক্তব্যের ভিন্নতায় এখন ফয়সাল হত্যার বিষয়টি ঘিরে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে।
মামলা, নিহতের পারিবার ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, নিহত ফয়সালের পিতা রাকিব মিয়া মামলায় বলেছেন সন্তানের শোকে তারা শোকাহত ছিলেন। তাঁর ভাই মাফুজ মিয়া শোকাহত অবস্থায় সম্পূর্ণ ঘটনা অবগত না হইয়া দুইজনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ২০/২৫ জনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন (মামলা নং-১৭, তারিখ-১৬.০৪.২০২৩ খ্রি.)। এখন তিনি কিছুটা সুস্থ্য হয়েছেন। খুঁজ খবর নিয়ে আসামীদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করে নিজে বাদী হয়ে আদালতে আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। এই মামলায় কালীকচ্ছ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সায়েদুল হক (৬৫) ও ব্যবসায়ি জিহাদ মিয়া (৩০) সহ মোট ২৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় কালীকচ্ছ, ধর্মতীর্থ, মূলবর্গ ও মনিরবাগ এলাকার আরো লোকজন থাকার কথা বলা হয়েছে। মাফুজ মিয়া বাদী হয়ে করা মামলায় শুধু দুইজন আসামীর নাম ছিল। এখন নতুন করে আরো ২৬ জনের নাম ঠিকানা যুক্ত হলো। রাকিব মিয়ার মামলায় বলেছেন, তাঁর ছেলে কালীকচ্ছ নানার বাড়িতে থেকে পড়ালেখার পাশাপাশি ব্যবসা বাণিজ্য করতো। আসামিরা মিটিং করিয়া সায়েদুল হকের নেতৃত্বে কালীকচ্ছ বাজারে এসে দাঙ্গায় লিপ্ত হয়। মামলায় বলা হয়, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ১৪ এপ্রিল শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে কালীকচ্ছ ইউনিয়নের সূর্য্যকান্দি ও ধর্মতীর্থ এলাকার বাজারে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত হয়। উভয় গ্রামের ৩০০ থেকে ৪০০ লোক দা, লাঠিসোটা, বল্লম, ইটপাটকেল, ককটেল ও আগ্নেয়াস্ত্র শর্টগান নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষ চলাকালে বিপুল পরিমাণ ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। ককটেল বিস্ফোরণ ও শর্ট গানের গুলাগুলিতে অনেক পথচারী আহত হয়। ব্যবসার কাজে বাজারে থাকা ফয়সাল সংঘর্ষ করতে নিষেধ করে। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে চেয়ারম্যানের হুকুমে কয়েকজন ফয়সালের দুই হাত চেপে ধরে। জিহাদ হত্যার উদ্যেশ্যে শর্টগান দিয়ে ফয়সালের বুকে গলার নিচে গুলি করে। গুলিটি হাড় মাংস ছেদ করে ভেতরে ঢুকে। অন্যান্য আসামিরা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটালে ককটেলের স্পিøন্টার ফয়সালের বুকে লাগিয়া অসংখ্য রক্তাক্ত জখম হয়। ফয়সাল চিৎ হইয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়ে অজ্ঞান হইয়া যায়।
সরাইল থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাঠিচার্জ, ৫৬ রাউন্ড রাবার বুলেট ও ৬ রাউন্ড টিয়ারসেল ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। গুরূতর আহত অবস্থায় ফয়সালকে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। তবে চেয়ারম্যান সায়েদুল হকের পরিবার ও স্বজনরা জানায়, জনপ্রতিনিধি হিসাবে দাঙ্গা থামাতে গিয়েছিলেন। তিনি গ্রাম্য ষড়যন্ত্রের শিকার। ভোটে পাস করে চেয়ারম্যান হওয়াটাই সায়েদুল হকের জন্য কাল হয়েছে। বিশেষ একটি মিথ্যা বানোয়াট মামলা দিয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিটিকে ফাঁসানোর খেলায় মেতেছে। তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরানোরই মহলটির উদ্যেশ্য। সত্য একদিন প্রকাশ হবেই। জিহাদের স্বজনরা জানায়, একটি গ্রƒপ ব্যক্তিগত আক্রোশ মিটানোর জন্য জিহাদের বিরূদ্ধে মিথ্যা ও উদ্যেশ্য প্রণোদিত অভিযোগ করছে। এই ঘটনার সাথে জিহাদের কোন ধরণের সম্পৃক্ততা নেই। শুধুমাত্র হয়রানি ও ক্ষতিগ্রস্ত করার লক্ষে তাকে আসামি করা হয়েছে।
ধূম্রজাল:
একই ঘটনায় প্রথমে চাচা পরে পিতা বাদী হয়ে পরপর দুটি হত্যা মামলা। প্রত্যক্ষদর্শী ওসমান হারূনীসহ একাধিক ব্যক্তির বক্তব্যের ভিন্নতা দিনদিন স্পষ্ট হয়ে ওঠছে। ফয়সালকে কে বা কারা গুলি করেছে? কেন গুলি করেছে? গুলি নাকি ককটেল বিস্ফোরণের কারণে ফয়সাল খুন হয়েছে? পুরো বিষয়টি নিয়ে এখনো কাটছে না ধূম্রজাল। তবে চিকিৎসক বলছেন এ গুলি ছুররা গুলি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক লোক বলছেন, ছোট এই ঘটনাটিকে রহস্যজনক কারণে বড় করেছে তৃতীয় একটি পক্ষ। কার সাথে কোন সময় তর্ক হয়েছে। উচ্চবাচ্য হয়েছে। বাক-বিতন্ডা হয়েছে। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় কথা কাটাকাটি হয়েছে। ছোটখাট ঘটনায় মামলা ছিল। এসব বিষয় মাথায় রেখে কৌশলে অনেক নিরপরাধ ও নিরীহ লোককে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। আল্লাহ এসব সহ্য করবেন না। সরাইল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আসলাম হোসেন ফয়সাল খুনের ঘটনায় দুটি হত্যা মামলা হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, নিহতের পিতা বাদী হয়ে আদালতে আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করে দুটি মামলাকে সংযুক্ত করে তদন্ত চেয়েছেন। বিজ্ঞ আদালত সংযুক্ত করেই তদন্তের আদেশ দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত: ঘটনার রাতে ১২ টার দিকে বিবদমান দুই গ্রামের ৪৪৪ জনকে আসামি করে এস আই তারিকুল ইসলাম বাদী হয়ে বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা করেছেন। ঘটনার সময় আটক করা ১১ ব্যক্তিকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। পরবর্তীতে আনোয়ার নামের আরেক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছেন। তিন মামলায় এখন মোট আসামীর সংখ্যা ৪৯৭ জন।