ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে দুই গ্রামের সংঘর্ষে নিহত ব্যবসায়ী ফয়সাল খুনের ঘটনায় আবারও বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবী জানিয়েছেন সরাইল উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রোকেয়া বেগম। তিনি ঘটনার পরের দিন কালীকচ্ছ বাজারের সকল সিসি ক্যামেরা নিয়ে আসার কারণও জানতে চান। তিনি চেয়ারম্যানসহ কিছু নিরপরাধ লোকজনকে হত্যা মামলায় আসামি করার অভিযোগ করেছেন। গত বৃহস্পতিবার উপজেলা আইনশৃঙ্খলা সভায় লিখিত বক্তব্যে তিনি এই দাবী জানান। এর আগে গত ১৫ এপ্রিল শনিবার ফয়সালের জানাযায় একই দাবী জানিয়েছিলেন সাবেক এমপি এড. জিয়াউল হক মৃধা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন ঠাকুর। ককটেল বিস্ফোরণ নাকি গুলিতে নিহত হয়েছে ফয়সাল? নিহতের স্বজনদের ভিন্ন বক্তব্য। পুলিশের সাথে তাদের বক্তব্যের গড়মিল। এক ব্যক্তি খুনের ঘটনায় দুটি হত্যা মামলা। সব মিলিয়ে ফয়সাল হত্যার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে তৈরী হয়েছে ধূম্্রজাল। এই ধূম্রজাল ভেদ করে ফয়সালের প্রকৃত খুনী কে? এবং কেন তাকে হত্যা করা হয়েছে? এমন সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর বিচার বিভাগীয় তদন্ত ছাড়া বেরিয়ে আসবে না বলে মনে করছেন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ সরওয়ার উদ্দীনের সভাপতিত্বে ওই সভায় বক্তব্য রাখেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন ঠাকুর, সরাইল সদর ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল জব্বার, শাহজাদাপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোছা. আছমা বেগম, নোয়াগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান মনসুর আহমেদ, পানিশ্বর ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান মিষ্টার, পাকশিমুল ইউপি চেয়ারম্যান কাউছার আহমেদ, অরূয়াইল ইউপি চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও চুন্টা ইউপি চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবির। ইউপি চেয়ারম্যানরা বলেন, চেয়ারম্যানরা জনপ্রতিনিধি। এলাকায় দাঙ্গা হাঙ্গামা হলে ঝুঁকি নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করি। এরপর যদি মামলার আসামি হতে হয়, তাহলে আর ঝগড়া নিয়ন্ত্রণ করতে যাব না। সরাইল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আসলাম হোসেন বলেন, ঘটনাটির সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত চলছে। আর তদন্তের স্বার্থেই সেখানকার সিসি ক্যামেরা খুলে আনা হয়েছে। প্রয়োজন হলে ব্যক্তি মালিকানা ক্যামেরা গুলো আমরা ক্রয় করে দিব। সূত্র জানায়, ঘটনার ১০ দিন পর গত ২৪ এপ্রিল সোমবার আদালতে দায়ের করা (জিআর-৭৭/২৩) করা ওই মামলায় স্থানীয় চেয়ারম্যান সায়েদুল হক সহ নামীয় আসামি করা হয়েছে ২৮ জনকে। এর আগে এই ঘটনায় নিহতের চাচা কুট্রাপাড়া গ্রামের মাফুজ মিয়া বাদী গত ১৬ এপ্রিল রোববার চেয়ারম্যন ও জিহাদ দুইজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ২০/২৫ জনকে আসামি করে সরাইল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। আদালত মামলা দুটি একত্রে সংযুক্ত করে তদন্ত করার জন্য সরাইল থানার অফিসার ইনচার্জকে (ওসি) নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ রাকিব মিয়ার দায়ের করা মামলার প্রধান স্বাক্ষী নিহতের মামা ওসমান হারূনী (৩৫) ভিডিও বক্তব্যে এই ঘটনার জন্য পুলিশকে দায়ী করেছিলেন। একই ঘটনায় দুটি হত্যা মামলা ও বক্তব্যের ভিন্নতায় এখন ফয়সাল হত্যার বিষয়টি ঘিরে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। মামলা, নিহতের পারিবার ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, নিহত ফয়সালের পিতা রাকিব মিয়া মামলায় বলেছেন সন্তানের শোকে তারা শোকাহত ছিলেন। তাঁর ভাই মাফুজ মিয়া শোকাহত অবস্থায় সম্পূর্ণ ঘটনা অবগত না হইয়া দুইজনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ২০/২৫ জনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন (মামলা নং-১৭, তারিখ-১৬.০৪.২০২৩ খ্রি.)। এখন তিনি কিছুটা সুস্থ্য হয়েছেন। খুঁজ খবর নিয়ে আসামীদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করে নিজে বাদী হয়ে আদালতে আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। এই মামলায় কালীকচ্ছ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সায়েদুল হক (৬৫) ও ব্যবসায়ি জিহাদ মিয়া (৩০) সহ মোট ২৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় কালীকচ্ছ, ধর্মতীর্থ, মূলবর্গ ও মনিরবাগ এলাকার আরো লোকজন থাকার কথা বলা হয়েছে। মাফুজ মিয়া বাদী হয়ে করা মামলায় শুধু দুইজন আসামীর নাম ছিল। এখন নতুন করে আরো ২৬ জনের নাম ঠিকানা যুক্ত হলো। ঘটনার রাতে ১১ জন ও পরে আরো ১ জনসহ মোট ১২জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। একই ঘটনায় প্রথমে চাচা পরে পিতা বাদী হয়ে পরপর দুটি হত্যা মামলা। প্রত্যক্ষদর্শী ওসমান হারূনীসহ একাধিক ব্যক্তির বক্তব্যের ভিন্নতা দিনদিন স্পষ্ট হয়ে ওঠছে। ফয়সালকে কে বা কারা গুলি করেছে? কেন গুলি করেছে? গুলি নাকি ককটেল বিস্ফোরণের কারণে ফয়সাল খুন হয়েছে? পুরো বিষয়টি নিয়ে এখনো কাটছে না ধূম্রজাল। তবে চিকিৎসক বলছেন এ গুলি ছুররা গুলি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক লোক বলছেন, ছোট এই ঘটনাটিকে রহস্যজনক কারণে বড় করেছে তৃতীয় একটি পক্ষ। কার সাথে কোন সময় তর্ক হয়েছে। উচ্চবাচ্য হয়েছে। বাক-বিতন্ডা হয়েছে। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় কথা কাটাকাটি হয়েছে। ছোটখাট ঘটনায় মামলা ছিল। এসব বিষয় মাথায় রেখে কৌশলে অনেক নিরপরাধ ও নিরীহ লোককে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। আল্লাহ এসব সহ্য করবেন না। সরাইল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আসলাম হোসেন ফয়সাল খুনের ঘটনায় দুটি হত্যা মামলা হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, নিহতের পিতা বাদী হয়ে আদালতে আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করে দুটি মামলাকে সংযুক্ত করে তদন্ত চেয়েছেন। বিজ্ঞ আদালত সংযুক্ত করেই তদন্তের আদেশ দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত: ঘটনার রাতে ১২ টার দিকে বিবদমান দুই গ্রামের ৪৪৪ জনকে আসামি করে এস আই তারিকুল ইসলাম বাদী হয়ে বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা করেছেন। ঘটনার সময় আটক করা ১১ ব্যক্তিকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। পরবর্তীতে আনোয়ার নামের আরেক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছেন। তিন মামলায় এখন মোট আসামীর সংখ্যা ৪৯৭ জন।