পটুয়াখালীতে এক শিশুকে ধর্ষনের অভিযোগ ধামাচাপা দিতে একাট্টা হয়েছেন থানা পুলিশ থেকে শুরু করে গ্রামের চেয়ারম্যান মেম্বর। আর একথা শোনার পর এসপি পুলিশ পাঠালেন হতদরিদ্র ভিকটিমের বাড়ী তাকে নিয়ে আসার জন্য। পুলিশের এসআই রুনা ওই বাড়ী যান। এসপির নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে কিছুই হয়নি বলে এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে মোবাইলে ভিডিও করে উল্টো কাউকে না জানানোর জন্য শাসিয়ে ভিকটিমকে না নিয়ে চলে আসেন। পটুয়াখালী সদর উপজেলার মাদারবুনিয়া ইউনিয়নের কুড়ালিয়া গ্রামে এমন ঘটনায় এলাকাবাসীও হতভম্ভ। জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হবে।
প্রতিবেশী জবেদ সিকদারের কাছে ধর্ষনের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন বৃদ্ধা হাছেন বানুর স্কুল পড়-য়া ১২ বছরের শিশু কন্যা। ঘটনায় দুই ঘন্টার মাথায় পটুয়াখালী সদর থানায় উপস্থিত হয় পুলিশের কাছে অভিযোগ দিতে। ওসির কক্ষে ঢুকে অফিচার্জ ইনচার্জ মনিরুজ্জামাকে তার ঘটনার চুলছেরা বর্ননা দিয়েছেন। কিন্তু কোন কিছুতেই ওসিকে বিশ্বাস করাতে পারেনি মা-মেয়ে। যতবার ধর্ষনের ঘটনা তাকে বোঝাতে চেয়েছেন-ততবার মিথ্যা ও সাজানো বলে মা-মেয়েকে ধমক দিয়েছেন ওসি। উল্টো ওসি ভিকটিম শিশুকে আম চোর হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এরপর নারী-শিশু হেল্প ডেক্সে নিয়ে ভিকটিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন নারী পুলিশ। সেখানেও একই বাক্য ছুড়ে দেয়া হয়েছে ভিকটিমের পরিবারকে। পরবর্তীতে থানার গোলঘরে পুলিশ-ধর্ষক পরিবারের উপন্থিতিতে শালিস বসাবসির এক পর্যায় গভীর রাতে বাড়ী ফিরতে বাধ্য হয় পরিবারটি। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে এমন বক্তব্য দিয়েছেন ভিকটিম পরিবার।
সোমবার দুপুরে (১৫ মে) সদর থানায় কর্মরত এসআই রুনা ও এসআই শিপন ভিকটিমের বাড়ী যান। পটুয়াখালী জেলা সদরে এক ভিক্ষুকের স্কুল পড়-য়া শিশু কন্যার ধর্ষনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে এবার ভিকটিমের বাড়ীতে গিয়ে শাসালেন পুলিশ। এ সময় ধর্ষনের ঘটনা এড়িয়ে অন্য বক্তব্য দিতে ভিকটিমকে নানাভাবে প্রভাবিত করেন তারা। সোমবার বিকাল ৫,৪০ মিনিটে ভিকটিমের বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে কথা হলে ওই নারী পুলিশ কর্মকর্তা রুনার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেন তিনি। এ সময় সঙ্গে ছিলেন মাদারবুনিয়া ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হারুন অর রশীদ। এরপূর্বে (১১ মে) গত বৃহস্পতিবার উল্লিখিত ঘটনায় আইনি সহায়তা পেতে সদর থানায় গিয়ে ওসি মনিরুজ্জামান কর্তৃক শায়েস্তার শিকার হন তারা। সদর উপজেলার মাদারবুনিয়া ইউনিয়নের কুড়ালিয়া গ্রামের সড়কের পাশে ঝুপড়ি তুলে বসবাস করেন ওই ছিন্নমুল পরিবারটি।
মোবাইল ফোনে কথা হলে ভিকটিমের বৃদ্ধা মা বলেন-একজন মহিলা ও একজন পুরুষ পুলিশ বাড়ীতে আসেন এবং আমাকে দাবিয়ে গেছেন। মিথ্যা কথা যদি না বলি, তা হলে আমাদের জেলে ভরে দেয়ার ভয় দেখিয়েছেন বাড়ীতে আসা ওই নারী পুলিশ। ওই পুলিশের এসআই রুনা তাকে আরও বলেন-আপনাকে থানা থেকে ছেড়ে দিয়েছে এ কথা বললে আমাদের চাকুরি থাকবে না, আপনি আমাদের চাকুরিটা বাচাইবেন নাহ্। এখোন বলবেন-আমার মেয়ে ওই বাড়ীতে আম পারতে গেলে তখন জবেদ শিকদারের বউ তা দেখে মেয়েকে মারছেন, আর কিছুই হয়নি। জবেদ সিকদারের বিষয়ে কোনো কিছু বলবেন না। যদিও এসআই শিপন নিরবে দাঁড়িয়ে ছিলেন বলে দাবি করেন ভিকটিমের মা।
ভিকটিমের মা আরও বলেন-পুলিশের সঙ্গে বাড়ীতে আসা মেম্বর হারুন বলেন-যদি মিথ্যা কথা না বলে-তাহলে চেয়ারম্যান-মেম্বর এবং পুলিশ ফেসে যাবে। এখোন এইটা বলো-এতে আপনার ভালো হবে। এ সময় তাদের শেখানো কথা বলতে বলে এসআই রুনা মোবাইল দিয়ে ভিডিও করার প্রস্তুতি নিলে ভিকটিমের মা তাদের কাছ থেকে দুরে সরে আসেন। এ সময় ভিকটিম শিশুকে নারী পুলিশ ধরে রাখেন বলে দাবি করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে মাদারবুনিয়ার ২ নং ইউপি সদস্য হারুন অর রশীদ বলেন-আমাকে পুলিশ সঙ্গে নিয়ে গেছে। পুলিশের সঙ্গে তাদের কথা সময় আমি পাশে সরে আসছি। তাই কিছু বলতে পারবোনা এবং আমি তাদের কিছু বলতে প্রভাবিত করিনি।
এ প্রসঙ্গে এসআই রুনা সঙ্গে ফোনে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি কলটি কেটে দেন। এ প্রসঙ্গে এসআই শিপনের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। (১৫ মে) সোমবারের ঘটনা জানতে সদর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মনিরুজ্জামানকে কল দেয়া হলে তিনি কল রিসিভ করেননি
ভিকটিমের বৃদ্ধা মা হাছেন বানু বলেন-গত ১১ মে সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮টার দিতে তার শিশু কন্যা (ভিকটিম) মৌসুমী ফল কুড়াতে প্রতিবেশি জবেদ সিকদারের বাড়ীর বাগানে যান। বাগান থেকে বেশ কিছু ফল সংগ্রহ করেন ভিকটিম। ফলগুলো নিতে জবেদ শিকদার ভিকটিমকে ব্যাগ দেয়ার কথা বলে ঘরে ডেকে নেন। ব্যাগ পাওয়ার আশায় ভিকটিম ঘরে ঢুকলে জবেদ সিকদার দরজা বন্ধ করে ধস্তাধস্তির এক পর্যায় তার মেয়ের সঙ্গে অপকর্মে লিপ্ত হয়। এমন দৃশ্য দেখে জবেদ শিকদারের স্ত্রী সালেহা বেগম তার মেয়েকে মারধোর করেন। মারধোর থেকে রেহাই পেতে বিবস্ত্র অবস্থায় ঘর থেকে বাহিরে বেড়িয়ে নিরাপদে আশ্রয় নেন মেয়েটি। পরে ওই বাড়ীর এক গৃহবধুর কাছ থেকে কাপড় নিয়ে বাড়ীতে ফিরে তার কাছে সব খুলে বলেন।
হাছেন বানু আরও বলেন-ঘটনার দিন সকালে ১০টার দিকে মেয়েকে নিয়ে সদর থানায় পৌছে ওসি স্যারের রুমে যাই। এ সময় ওসির কাছে সব খুলে বলি। কিন্তু ওসি বলেন তোমরা মিথ্যা কথা বলো। জবেদ শিকদার আমার মেয়ের ক্ষতি করছেন, তা কোনো ভাবেই তাকে বিশ্বাস করাতে পারেনি। উল্টো ওসি আমাদের নানান ভাবে শাসিয়েছেন। মেয়েকে নিয়ে থানায় আসছি, এমন খবর শুনে গ্রামের অনেক মানুষ এবং জবেদ শিকদারের ছেলেরা থানায় এসে আমাকে অভিযোগ দিতে বাধা দেন। এ সময় আমি পুলিশ ও গ্রাম থেকে আসা মানুষদের ভিকটিমকে নিয়ে হাসপাতাল পরীক্ষার দাবি করি। তারা বলেন-এতে তোমার মেয়ের বদনাম ও ভবিষ্যত নিয়ে ঝামেলা হবে। জবেদ সিকদারের ছেলেরা তোমাকে ক্ষতিপূরন দেবে, ঝামেলা করার দরকার নাই। সকাল ১০ থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত থানায় ছিলাম, কারো সহযোগীতা পায়নি, উল্টো পুলিশ ধমক দিয়েছেন। তাই বাধ্য হয়ে মেয়েকে নিয়ে বাড়ী আসি। একই বক্তব্য দিয়েছেন ভিকটিম শিশুটি।
সংশ্লিষ্ট ইউপি সদস্য আবদুল হাই বলেন-ঘটনা শুনে আমি ও চেয়ারম্যান সাহেব দুপুরে থানায় যাই। থানায় পৌছে চেয়াম্যান সাহেব ওসিকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে চলে আসেন। একই কথা বলেছেন- মাদারবুনিয়ার ইউপি চেয়াম্যান আমীনুল ইসলাম মাসুম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই বাড়ীর এক ব্যক্তি ও এলাকাবাসী বলেন-ঘটনার দিন আপত্তিকর অবস্থায় জবেদ সিকদারের স্ত্রী মো. সালেহা বেগম ভিকটিমকে পেটায়। পেটানি খেয়ে বিবস্ত্র অবস্থায় ঘরে থেকে দৌড়ে অন্য ঘরে আশ্রয় নেয়। পরে এক গৃহবধু তাকে কাপড় দিলে তা গাঁয়ে জড়িয়ে নিজ বাড়ীতে যান ভিকটিম। সুত্রটি আরও বলেন-ভিকটিমের বৃদ্ধ বাবা রাজ্জাক খান অসুস্থ। বৃদ্ধা মা হাছেন বানুর ভিক্ষাতে সংসার ও মেয়ের লেখা-পড়া চলে। ভিকটিম ৭৫ নং কুড়ালিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। রাস্তার পাশে ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করেন তারা। অতিদরিদ্র হওয়াতে তাদের পক্ষে কেউ নেই বলে অভিযোগ করেন।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কমল দত্ত এবং জাহিদুল ইসলাম (সুপ্রীকোর্ট) বলেন-এ সংক্রান্ত ঘটনায় ভিকটিম পুলিশের কাছে আসলে দ্রুত মেডিকেল সম্পন্ন করা বাধ্যতামুলক এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২০০০ এর ২২ ধারা মোতাবেক বিজ্ঞ নারী শিশু ট্রাইব্যুনালে হাজির করে জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা। এখানে অন্য কোনো সুত্রকে প্রাধান্য দেয়ার সুযোগ নাই। অপর একটি সুত্র বলেন-ওই দিন মোটা টাকা রফাদফার মাধ্যমে মা-মেয়ের কণ্ঠ রোধ করে ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়েছেন পুলিশ ও ধর্ষক পরিবার গং।
এসআই শিপন বলেন-অভিযোগের ভিত্তিতে জবেদ শিকদারকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থানায় নিয়ে আসি। এরপরের ঘটনা আমার জানা নাই। ঘটনা অসত্য বলে থানার গোলঘরে মিমাংসা হয়েছে।
সদর থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মনিরুজ্জামান বলেন-তারা প্রথমে এক বয়স্ক লোকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছিল। মেয়েটি রেকর্ড হলো সে বিভিন্ন বাড়ী ফল চুরি করতেন। ওইদিন ওই বাড়ীর কিছু আম পেরেছে। তা নেয়ার জন্য একটি ব্যাগ দরকার। ব্যাগ নিতে মেয়েটি ওই ঘরে ঢুকলে ঘরের গৃহবধু তাকে চোর বলে শায়েস্তা করেন। মেয়েটি এই চুরির অপবাদ ঢাকতে এমন ঘটনা সাজিয়েছেন। ভিকটিমকে মেডিকেল পরীক্ষা করা যেত কিনা এমন প্রশ্নে ওসি বলেন-বয়স্ক লোকটা আনার পর দেখা গেলো-বিষয়টি এমন নয়, ভিকটিমের অপবাধ ঢাকতেই এই কান্ড করেছেন। যা ইউপি চেয়াম্যান সাহেবও জানেন। নারী পুলিশ দ্বারাও জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এমন আলামত পায়নি।
এসকল বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম ও প্রশাসন) এবং সদর সার্কেল অফিসার সাজেদুর ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন-বিষয়টি আমার জানা নাই। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করছি। এ সময় ভিকটিম পরিবারকে সর্বোচ্চ আইনি সহায়তা দেয়ার কথা বলেন তিনি।