বিখ্যাত জাপানী পরিচালক ইয়াশিনো অইয়াকাতা বেশ কয়েক বছর আগে এসেছিলেন বাংলাদেশে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের হয়ে বাংলাদেশের শিশু নির্যাতনের উপর একটি গণসচেতনতামূলক তখ্যচিত্র তৈরির প্রকল্পে আমরা জনা দশেক মানুষ এই কাজে একত্র হয়েছিলাম। ছবিটির আন্তর্জাতিক অংশের পরিচালক ছিলেন অইয়কাতা এবং বাংলাদেশের অংশে যৌথ পরিচালনায় ছিলাম আমি এবং আর একজন। মূলত তাকে নিয়েই আজকের এই লেখা। ধরে নিতে দোষ নেই আমরা সবাই ছিলাম সেই দলপতির নির্দেশনা ছত্রতলে। তিনিই আজকের এই লেখার উপলক্ষ - নির্মাতা, কবি ও অসম্ভব সৃজনী উদ্ভাবনী মেধার মানুষ শহীদ রায়হান। আমার সাথে তার কর্মপরিচিতি এখন থেকে না হলেও তিরিশ বছরের। দেশের নামকরা পরিচালক, নায়ক, অভিনেতা ও চিত্রশিল্পী আফজাল হোসেনের নির্দেশনা ছত্রতলে আমরা প্রায় দেড় যুগ কাজ করেছি। তারপর যার যার নিয়তির পথে আমরা পথিক হয়েছি। একজন নির্মাতার উপর লিখতে গিয়ে পিছনের এই কর্ম পরিচিতির কিছুটা প্রাসঙ্গিকতা বোধ করছি এজন্য যে, ওই যেমনটি চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস বলে গেছেন, "কহড়ি ধ ষধহফ নু রঃং ষবমবহফং ধহফ শহড়ি ধ সধহ নু যরং সবহঃড়ৎ." অনুজ শহীদ রায়হান তার কাজ ও ভাবনার মৌলিকতা দিয়ে এই অভাগা অগ্রজকে বহু আগেই ডিঙ্গিয়ে গেছেন। তার পরিচালিত নাটক, তথ্যচিত্র, বিজ্ঞপনচিত্র ও সম্প্রচার প্রকল্পের সংখ্যা সব মিলিয়ে শ’ দুইয়েক কি তারও কিছু বেশি। তবে স্রফে সংখ্যায় নয়, পরিচালনার কারিগরি ও সৃজনী ভাবনায় তার মৌলিকতা গর্ব করার মতো। এখানে যে চিত্রভাবনার পটভূমিকা লিখতে বসেছি সেই ”মনোলোক” পান্ডুলিপির প্রথম পাঠক হবার গর্ব আমার বহুদিন থাকবে। কল্পনার খন্ডচিত্রগুচ্ছ একত্র করে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় রাজনৈতিক জীবনের উপর মনোলোক নাট্যপ্রয়াসে মূলত ভালবাসার রং’এ আবেগের তুলিতে ও সহিত্যের ক্যানভাসে একটি ছবি এঁকেছেন, যাদেরকে নিয়ে আমাদের জাতীয় রাজনীতির স্রােত বয়ে গেছে এবং যাচ্ছেও, তাদের সংশ্লিষ্টতা, জীবন ও নেতৃত্বকে তিনি তার চোখে তার মতো করে দাঁড় করার চেষ্টা করেছেন। এই আবেগঘন কল্পনাধর্মী, সংলাপণ্ডসমৃদ্ধ স্মৃতি কথন এবং এই পান্ডুলিপির উপর তার যে মূল লক্ষ্য একটি ব্যতিক্রমধর্মী ’কোলাজ’ চলচ্চিত্র, তা আমাদের জাতীয় রাজনীতি এবং চিত্র নির্মাণ রীতিতে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করবে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। এখানে পান্ডুলিপির শাব্দিক সীমাবদ্ধতাকে উতরিয়ে গেছেন তার নির্মাণশক্তি এবং পারম্পর্য সৃষ্টির শক্তি ও কৌশলকে। এই সাফল্য দেখার অপেক্ষায় ছিলাম।
‘মনোলোক’ শহীদ রায়হানের মনোজগতের একটি অপ্রকাশিত ভাবনার বাতিঘর। এখান থেকে যে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটছে সেটিও তার নিজের ভাবনার আলো। তার আবেগের জায়গাটি যে সব পাঠকের ভাল লাগবে এমন দাবী লেখক, নির্মাতা নিজেও হয়তো করবেন না। তবে সংলাপ বলার কৌশল এবং যেভাবে তিনি সেই কৌশল দিয়ে চিত্রনির্মাণের একটি নতুন ধারা তৈরি করেছেন, যার সমন্বয়ে তিনি তুলে ধরেছেন তার ‘মনোলোক’ কে সেটাই এখন মূল বিচার্য। তবে প্রস্তরপৃষ্ঠে অবয়ব আকৃতি দিতে যে ভাস্কর পটু, তিনি সেই অবয়বই খোদাই করে তুলে এনেছেন, যে অবয়বগুলো তিনি তার চিত্রনির্মাণের পটভূমিকা হিসাবে বেছে নিয়েছেন। তার সুবিধা হলো, মুখ বা অবয়বগুলো তারও যেমন, দর্শক-শ্রোতা বা পাঠকেরও তেমন অতি পরিচিত। ফলে চরিত্র চিত্রণে অভিনয় পারঙ্গমের ব্যাপারে তাকে খুব বেশি দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও যাঁচাই বাছাইয়ের সংকটে পড়তে হয়নি। জাতীয় নেতাদের কথা, অঙ্গভাষা, ধরণ ও নিজস্বতা এতই পরিচিত যে অভিনয় করে একটা কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টিতে যে অভিনয়শৈলী দরকার হয়, এখানে তার প্রয়োজন হয়নি। পরিচালকের উপর তার জন্য সৃজনী দায়ভার অবশ্য এতটুকু কমে নাই; বরং বাড়েছে। বেড়েছে এজন্য যে সুপরিচিত মহা-অবয়বগুলোর স্বকীয়তায় এতটুকু প্রস্ফুটন-বিচ্যুতির ঝুঁকি নির্মাতা নিয়েছেন। বিশ্বাস ছিলো যে, ঝুঁকি বা অসম্পূর্ণতার রেশ শহীদ রায়হান রাখবেন না। শিশু নির্যাতনের পাঁচ পর্বের ডকু ড্রামা করতে গিয়ে দেখেছি অস্পষ্ট জাপানী নির্দেশকের চিত্রলিপি অনুধাবনে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে কী ধৈর্য ও অনুসন্ধিৎসা নিয়ে কাজ করেছেন শহীদ রায়হান। শহীদ রায়হানের ’মনোলোক’ একটি নীরিক্ষামূলক, আখ্যানধর্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব-নির্ভর স্মৃতির আবেগ-তাড়িত ও আত্ম-অনুসন্ধানী নিবেদন। কালের যে পটে এই নৈবেদ্য গুচ্ছের চিত্র-গ্রন্থনা, তার মূল ‘এপিক’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারের সদস্যবর্গ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলধারার নেতৃসোপান - যাঁরা রাজনৈতিক জীঘাংসার শিকার হয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের শোকাবহ মধ্যরাতে শহীদ হন। মহাশোকের সেই চিত্রপটে শহীদ রায়হান ধারণ করেছেন ওই সময়ের রাজনৈতিক জীবনে ভূমিকা রাখা আরো কিছু মুখাবয়ব, যাদের আত্মকথন স্মৃতির এই চিত্রপটকে পূর্ণতা দিতে সচেষ্ট থেকেছে। অন্য কথায়, তাদের প্রাসঙ্গিকতা ছাড়া চিত্রপটটি অপূর্ণ থেকে যেত। এখানে পছন্দের দায়ভার লেখক বা নির্মাতার একান্ত নিজস্ব। এই সারিকে তিনি হযতো আরো দীর্ঘ করতে পারতেন। তাতে মনে হয় কাহিনীর কলেবর বৃদ্ধি দর্শক-শ্রোতা-পাঠকের ধৈর্য্য সঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন উঠতো। আলোকচিত্র সংগ্রহের সুবিধা আছে। চলচ্চিত্রে একটি আলোকচিত্র খন্ডকে ২৫ টি ফ্রেমে গুণ করে এক সেকেন্ডের পরিসীমা সাব্যস্ত হয়।
চিত্রকথনে শব্দ প্রয়োগে শহীদ রায়হান আবেগের ব্যাকুলতা ও বর্ণানাধর্মিতার সংযতি রাখার ক্ষেত্রে ভাষাতত্ত্বকে আপোশ করেছেন সংকেতবিদ্যা এবং অঙ্গভাষা দিয়ে। ভাষাবিদ্যা বিররণমুখি, কিন্তু সংকেতবিদ্যা আচরণমুখি। ভাষায় ধ্বনি-বর্ণ, বিশেষ্য, বিশেষণ ও ক্রিয়াপদের সমঝোতা আনতে সময় লেগে যায়; সংকেত ও অঙ্গভাষা রীতিতে প্রকাশের ক্ষমতা অনেক সংক্ষিপ্ত হয়েও কার্যকর। আবেগ প্রকাশে ব্যক্তিকে নৈর্ব্যক্তিক করে তোলা বা নিরাসক্তির পরিচয় দেওয়া সত্যিই কঠিন। সেই কঠিন কাজটিতে অনায়াসে মুন্সিপনা দেখিয়েছেন শহীদ রায়হান বিবরণ-মুখিতা পরিহার করে সংকেতাশ্রয়ী হয়ে। সাধারণতঃ গল্পের কাঠামো নির্মানে যুগল-দ্বন্ধ অনিবার্য ভাবে থাকতেই হয়। কিন্তু এই উপস্থাপনায় শহীদ রায়হান যুগল-দ্বন্দ্বের একটি সারিতে দাঁড় করিয়েছেন আবেগ; অন্যটিতে শিল্পকে। আদর্শগত দ্বন্দ্বের যে স্থানে আসার দরকার ছিল অখন্ডতা বা ফেডারেলিস্টদের, সঙ্গত কারণেই এখানে তাকে ঊহ্য রাখতে হয়েছে। সেখানে সত্যের অংশ বিচ্ছেদ বা অঙ্গচ্যুতি ঘটেছে এবং তা’ ঘটাই স্বাভাবিক। বিপ্লবের কাহিনীকারকে কখনোই আভিজাত্যবাদের নন্দন করতে কেউ শোনেনি। বিপ্লবের ভাষ্য লিখতে কখনো কি কেউ সাম্রাজ্রবাদের প্রশস্তি করেছেন? খলনায়কের অনুপস্থিতি শহীদ রায়হানের ‘মনোলোক’ কেও ফেলেছে নৈর্ব্যক্তিকে সত্যাশ্রয়িতার কঠিন পরীক্ষায়। তিনি এটাকেই সত্য জেনেছেন, সত্য মেনেছেন যে, মেঘ কখনোই সূর্যকে ঢেকে রাখতে পারে না। বাংলাদেশ এক সূর্যালোকিত দিব্য। সূর্যের আলো প্রমাণে যেমন অন্ধকারকে খলনায়কের জায়গার আনাটা অনিবার্য নয়, তেমনি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং প্রকাশে, বিকাশে ও ইতিহাসের ধারা পারম্মপর্যে কোনো ঔপনিবেশিকতা বা ফেডারেলতত্ত্বের যুক্তিনিষ্ঠার কোনো অবতারণিক প্রাসঙ্গিকতার অনিবার্যতা তিনি বোধ করেননি। এটা যদি সত্য হয় তাহলে ‘মনোলোকের’ দার্শনিক ভিত্তি সত্যাশ্রয়ী। একটি জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত রাজনৈতিক অভিপ্রায় (ডরষষ) পূর্ববতী সকল আইন-বিধান-প্রথা ও সীমাংসাকে অপ্রাসঙ্গিক করতে যথেষ্ট পারঙ্গম এবং নতুন রাজনৈতিক সত্ত্বার আইনী, নৈতিক ও সমাষ্টিগত বৈধতার সেটাই ভিত্তি। কথা উঠতে পারে, সেই সত্য ব্যক্তি বা ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের সাথে অনিবার্যতঃই সমার্থবোধক বা অপরিহার্য কিনা? উত্তরটি অবশ্যই ইতিবাচক। যে সংগ্রাম এবং সংগ্রামের অর্জন সত্য, তার ইতিহাসের নিয়ামক ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গও অপরিহার্য বা অবিচ্ছেদ্য। ইতিহাস রাজা চতুর্দশ লুইকে মনে রাখবে না, ফরাসী বিপ্লবকেই স্মরণ রাখবে।
অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে একটি সমান্তরালে আনতে পারাই একটি সৃজনশীল কর্ম উদ্যোগের সাফল্যের প্রথম ভিত্তি প্রস্তর। তবে কর্ম সম্পাদনের সরল রৈখিক অবস্থান জরুরী হলেও শিল্পকর্মের বিস্তার সমান্তরাল নয়। চিত্রশিল্পের যেমন রূপায়ন প্রয়োজন; নাটক বা নাট্যাচিত্রনেও তদ্রুপ প্রয়োজন সফল রূপকায়ন। এই যে ‘রূপ’-কে ‘রূপায়ন’ করণ না ‘রূপায়িতকরণ’ উদ্যোগ, তাতে শহীদ রায়হান একত্র করেছেন তার অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে। আমি ‘মনোলোক’ লেখকের মুখে শুনেছিলাম, নিজেও এর অদ্যোপান্ত পড়েছিলাম। তিনি এখানে রূপকাশ্রয়ী হতে গিয়ে ‘বিন্যাসবাদ’ এর উপর গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। ফরাসী লেখক ও গবেষক ক্লদ লোভি-স্ট্রাউস যেমন নতুন প্রথায় লোককথা ও লোকগাঁথাকে বিন্যস্ত করেছেন এবং সফলও হয়েছে, শহীদ রায়হান এই পথ অনুসরণ করে স্বগত: সংলাপের ভিত্তিতে আমাদের জাতীয় জীবনে ট্রাজেডির শিকার বিশিষ্ট নেতৃবর্গের স্মৃতিচারণমূলক এই নিবেদন উপস্থাপনের সঙ্গী করেছেন স্বগত: সংলাপের রূপায়নকে। চিত্রের পান্ডুলিপিতে, নির্মানে রয়েছে তার ব্যতিক্রমী সাহিত্যসৃষ্টির উদ্যোগ।
কবি, সাহিত্যিক, নাট্যতত্ত্বে অনুরাগী ও চিত্রপরিচালক শহীদ রায়হান হৃদয়ে লালন করেন কল্পনা, তার কল্পনার মধ্যে থাকে চিন্তা এবং তার অভিজ্ঞতার ভান্ডারে আছে “বিবিধ রতন।” সেই রত্নরাজিরই একটি হলো আবেগ। তার রাজনৈতিক বিশ্বাসকে আবেগের অনুষঙ্গী করে তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন নাট্যকলা ও মোশন চিত্রে। পরিচালনা, চিত্রধারণ, পটভূমি আয়োজন ও শিল্পণ্ডনির্দেশনা সব কিছু মিলিয়ে তিনি সফল চলচ্চিত্রকার। সংলাপ রচয়িতা হিসাবেও সফল হয়েছেন। নির্দেশনাশৈলীতে তিনি আর কয়জন সফল পরিচালকের মতোই বাস্তব ও পরাবাস্তবের মাঝখানের আইল ধরে হাঁটেন। অনুষ্ঠান-সংগঠক হিসাবে ও খ্যাতি অর্জন করেছেন। ব্র্যান্ড-প্রকৌশলে দক্ষতা ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তার বাণিজ্য-সাফল্যকে ত্বরান্বিত করেছে। এই সম্মিলিত সাফল্যের সাধনায় তার বড় পরিচয় বন্ধু-বাৎসল্য, সহকর্মীদের প্রতি সহমর্মিতা এবং অগ্রজদের প্রতি অকুন্ঠ শ্রদ্ধা। সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশ-বিদেশের কয়েক হাজার প্রিয়জনের পিছনেই কাটে তার দিনের বড় একটা অংশ।
‘মনোলোক’ প্রসঙ্গে আর কয়েকটি কথা বলেই ইতি টানতে চাই এই উপক্রমনিকার। প্রথমেই বলবো শহীদ রায়হানর শিল্পবোধ ও নান্দনিকতার প্রতি মোহাবিশিষ্ট হবার কথা। জাপানী পরিচালকের সাথে এক দলে কাজ করার কথা বারবারই মনে পড়ে যাচ্ছে। পরিচালক আইয়াকাতাকে নাটকটির সংলাপ অংশ ইংরেজিতে অনুবাদ করে বোঝতে হতো। হয়না, অনেক বিরল কথাও অনুবাদের কারণে পানসে মনে হয়? ইংরেজিতে থাকে বলে খড়ংঃ রহ ঃৎধহংষধঃরড়হ? তার পরও তাকে দেখেছি চরিত্রের সাথে সংলাপের পরিবেশ পরিস্থিতি ও ঘটনার পারম্পর্য বিচার করে জাপানী পরিচালক বহুবার সংলাপগুলোর শক্তিমত্ততার প্রশংসা করেছেন। ওগুলো লিখেছিলেন অথবা চটজলদি রসঢ়ৎড়ারুব করে দিয়েছিলেন শহীদ রায়হান নিজেই। ‘মনোলোক’ এও তার হাত থেকে বের হতে দেখছি বহু মানুষের বহু ঘটনার বহু সংলাপের বাহুল্য-বর্জিত ব্যতিক্রম। নিজের গড়া চরিত্রের সংলাপের মতোই সাবলীল ভাবে বলে গেছেন অন্যের মুখের সংলাপ। প্রকাশ করেছেন ওই মানুষেরা আজ বেঁচে থাকলে এখন কী বলতেন বা বলতে পারতেন সেই সব কথা। সেটা বঙ্গবন্ধুর কোনো সহযোদ্ধাই হোন, পরিবারের অন্য কোনো শহীদ সদস্যই হোন, কি শিশু শেখ রাসেলই হোক। লেখক এখানে তার মনের গভীর থেকে তার মর্মশ্বাস বা রক্তক্ষরণের কথা বলে গেছেন ছোট ছোট বাক্যে, বিলাপে বা অনভব বন্টনে। সেই সব ছোট ছোট বাক্যে কী তীক্ষè পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধির জায়গাগুলো তিনি তৈরি করেছেন, ভেবে অবাক হচ্ছি। আত্মমগ্ন ও প্রকাশ-বিমুখ লেখক, নির্মাতা শহীদ রায়হানকে পান্ডুলিপিটা লিখে প্রথম আমাকে পড়ে শোনানোর পরও দেখেছি তাকে ঈর্ষনীয়ভাবে নির্ভার ও নিরাসক্ত। এটা আমাকে বহু চেনা শহীদ রায়হানের আড়ালে বাস করা এক অচেনা শহীদ রায়হানকে এনে দাঁড় করিয়েছে। তার উপলব্ধির গভীরতা ও সাযুজ্যবোধ আমাকে বিশ্বাস করতে সাহায্য করেছে, শহীদ রায়হান গদ্যরীতির এক শক্তিশালী সূত্রধর এবং একজন দরদী মানুষ। আত্ম-উপলব্ধি ছাড়া অন্যের মুখের অশ্রুত কথাকে কেউ এত আপন করে বলতে বা বলার জন্য লিখতে পারে না। তার লেখা সংলাপগুলো দর্শক-শ্রোতা-পাঠকের মনের মধ্যে গভীর অভিঘাত সৃষ্টি করবে; ভাবনার বেড়িবাঁঁধগুলোর স্লইচগেট খুলে দেবে। আপন বিবেককে মোকাবেলা করতে গিয়েই তাকে সংলাপধর্মী এই নাট্যআয়োজনের শিরোনাম দিতে হয়েছে ‘মনোলোক।’ ব্যাক্তির-প্রচারের চেয়ে অনুভূতি বহনের প্রস্ততিই তার গোটা চলচ্চিত্রটি জুড়ে। তার মধ্যে তার লেখা সংলাপের ভিতর দিয়ে নিজের বিশ্বাস ও বোধের আঙ্গিনায় অন্যকে আমন্ত্রণ জানানোর চেয়ে আপন সহজাত অতিথিপরায়নতার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার ব্যাকুলতাই বেশি বলে আমার মনে হয়েছে। রাজনীতির যে আপন পছন্দ ও বিশ্বাসের যে নিক্তিতে তিনি সৃজনশীলতার বাটখারা তুলেছেন, তিনি নিজেও হয়তো কখনো পরিমাপ করতে যাননি তার প্রকৃত ওজন। আপন সীমা-সচেতনাতার সীমান্ত না ডিঙ্গিয়েই তিনি ব্যক্তিকে যুক্ত করেছেন সমষ্টির সাথে, পরিবেশের সাথে পরিবেষ্টনীকে, বহি:র্লোকের সাথে অন্তর্লোককে। আর এই অন্তর্লোকই তো হ’ল ‘মনোলোক।’ তার ক্ষরণ, দহন ও রোদনের কথা এই চলচ্চিত্রে চিত্রিত হয়েছে দ্বিতীয় পুরুষের প্রথম বচনে। কিন্তু শুনে মনে হবে সংলাপগুরো বলা হচ্ছে প্রথম পুরুষের প্রথম বচনেই এখানেই চলচ্চিত্রকারের স্বাতন্ত্র। ব্যথাকে তিনি শিল্পরসে সিক্ত করেছেন; তপ্ত দীর্ঘশ্বাসকে করেছেন আর্দ্র্য লঘুশ্বাস। কষ্টকে উত্তীর্ণ করেছেন উপলব্ধিতে।
শহীদ রায়হানের মধ্যে দার্শনিকের ভার বা চিত্রকরের ধার প্রচারের কোনো আকুলতাই দেখা যাবেনা। ব্যক্তি নেতা বা প্রতিষ্ঠানের তুল্যমূল্য নিরূপন যে তার কাজ নয়, এটা তার লেখায় মূর্তিমান। মতবাদ প্রচারের দাবী মূল্যায়ন বা গ্রহণযোগ্যতা নির্ণয়ের আপেক্ষিক গুরুত্ব নিরূপন করার জন্য অনেক মানুষ আছে। নির্মাতার কাজ শিল্প সৃষ্টি করা। শহীদ রায়হান তার দায়িত্বেই বিশ্বস্ত। কবি-লেখক-সাহিত্যিককে হতে হয় ত্রান্তদর্শী; তাকে হতে হয় তিন কালের পর্যবেক্ষক। অর্থাৎ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ এর কোনো কালপর্বেই তার অনুপস্থিতি কাম্য নয়। এই ত্রিকালদর্শী দিব্যজ্ঞান দিয়েই তিনি অবলোকন করেন তার দেশ-কাল-পাত্র।
প্রতিবাদী সমালোচকেরা অনেক বিশ্ব-ধ্রপদ সাহিত্য স্রষ্টাকে, যারা ব্যক্তি শাসক বা দার্শনিকের বন্দনায় মগ্ন থেকেছেন, তাদেরকে ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তিপূজারী হিসাবে আখ্যয়িত করে থাকনে। তাদের চোখে ব্যক্তিপূজা ‘ক্রিয়েটিভ’ নয়, মর্বিড। তবে আসলে কোনটি ‘মার্বিডিটি’ আর কোনটা ‘ক্রিয়েটিভিটি’, এটা নিরূপন করা খুব কঠিন কাজ। সমালোচকের কাজ সমালোচকেরা করতেই থাকবেন; শহীদ রায়হানদের কাজ শহীদ রায়হানরা করইে যাবেন।
চারটি ব্যাপারে শহীদ রায়হান আপোসহীন। বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং শিল্প বা আর্ট। তার ‘মনোলোক’ এর বাইরেও তিনি স্বকীয়তার এই ধারাবহতায় নিমগ্ন। মহান মুক্তিযুদ্ধের দ্রোহ, প্রমত্ততা, অনুসন্ধিৎসা ও স্বপ্নচারিতায় লীন হয়ে তিনি খুঁজে পেতে চান বিশালতা ঔদার্য, সারল্য ও সাহসিকতা। দেশাত্নবোধের উজ্জ্বল বিভায় আলোকিত হতে চান নিজে, আলোকিত করতে চান পরিবেশ ও পরিবেষ্টনীকেও। ‘মনোলোকে’র সংলাপে, গাঁথুনি ও বিন্যাসে, চরিত্র চয়ন ও উপস্থাপনে লেখক যেন নিত্যবর্তমান এবং তার আবেগও তেমন নিত্যবহমান। এই অবেগ-তাড়িত অন্তঃর্দৃষ্টি তার বিশ্বাস ও বোধেরই প্রতিধ্বনি, তার অন্তর্চৈতন্যেরই বিশ্বস্ত প্রতিচ্ছবি। আমি চলচ্চিত্ররূপ ‘মনোলোক’ এর দর্শক প্রিয়তার অনেক বড় আশাবাদ ব্যক্ত করছি এবং সাহিত্যকে আরও এরকম মৌলিক সৃজনী দিয়ে ঋণী করে রাখা বা ঋণী করে রেখে যাবার জন্য স্নেহানুজ শহীদ রায়হানের প্রতি জোর দাবী রাখছি। (লেখক: খন্দকার হাসনাত করিম (পিন্টু) সাংবাদিক, কলাম লেখক, চিত্র পরিচালক ধানমন্ডি, ঢাকা)