মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার আভা রানীর ছেলে সমীর প্রসাদ সাহা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এই অপরাধে চোখের সামনে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় স্বামী হরিদাস সাহাকে গলা কেটে হত্যা করে পাকহানাদার বাহিনী। বছর তিনেক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ছেলে সমীরও। অন্য দুই ছেলে দুই মেয়ে অনেক আগেই ভারতে চলে গেছেন। স্বামীর ভিটে মাটি একাই আগলে রেখেছেন আভা রানী। সেই ভিটেতে এবার হাত পড়েছে দখলবাজদের।
মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি ইউনিয়নের রথখোলা গ্রামের আভা রানীর বয়স এখন প্রায় ৮৫ বছর। আক্ষেপ করে তিনি বললেন, এই দেশের জন্য স্বামীকে হারিয়েছি, প্রাণের ভয় না করে ছেলে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশ ছেড়ে ভীনদেশে অনিশ্চিত জীবন কাটিয়েছি। তার প্রতিদান কি এরকম হতে পারে?
আভা রানীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, স্বামী হরিদাস সাহা ছিলেন স্থানীয় বালিয়াটি ঈশ্বর চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের কেরানী। পাশাপাশি কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মীও ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাদের বড় ছেলে কাউকে না জানিয়ে সমীর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বাড়ি ছাড়েন। স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে খবর পেয়ে যায় পাকবাহিনী। সমীরকে না পেয়ে হরিদাস সাহাকে গলা কেটে হত্যা করে। ওই রাতেই আভা রানী পরিবারের সবাইকে নিয়ে পালিয়ে যান। অনেক কষ্টে ভারতে পৌছান। তবে বড় ছেলে সমীর দেশের ভেতরে থেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দেশ স্বাধীন হলে ৫০ শতাংশ জমির ওপর স্বামীর ভিটে বাড়িতে ফিরে আসেন। তিনি জানান এই ৫০ শতাংশ জমির মধ্যে ৪৮ শতাংশ হচ্ছে ্ক্রয় সুত্রে তার স্বামীর নামে। বাকি দুই শতাংশ ভূমি সরকার অর্পিত ঘোষনা করেন। তবে কবে অর্পিত হয়েছে তা আমি জানি না। ৭৩ সালের আগে সরকারের কাছ থেকে স্বামীর নামে লিজ নেয় বলে দাবী করেন এই মুক্তিযোদ্ধার মা। সমীর জীবিত অবস্থায় কেউ দখল করতে আসেনি। সে মারা যাওয়ার পর দখল হলো কেন এই প্রশ্ন আভা রানীর।
তিনি বলেন, বছর তিনেক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় সমীর মারা যাওয়ার পরথেকে তাঁর স্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষীকা জোসনা সাহা তাঁর বাবার বাড়িতে থাকেন। এদের কোন ছেলে মেয়ে নেই। সমীরের মুক্তিযোদ্ধা ভাতা স্ত্রীই গ্রাহণ করেন। আমি বেঁচে আছি বয়স্ক ভাতার ওপর। একাই বর্তমানে স্বামীর ভিটে মাটি আক্রে আছি। কিন্তু গত ৫ মে প্রতিবেশি বাছেদ মিয়া লিজের দুই শতাংশ জমির ওপর জোর করে ঘর তোলেন। বাধা দিলে ধাক্কা দিয়ে আমাকে ফেলে দেয়, র্দুব্যবহার করে। বাংলাদেশের দোহাই দিয়েও ঘর তোলা থামাতে পারি নাই। বাধ্য হয়ে স্বামীর স্মৃতির রক্ষার জন্য ইউএনওর সাহেবের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দখলদার আঃ বাছেদ সাটুরিয়া উপজেলা ইউএনওর গাড়ি চালক। ছেলে ছিল সহকারি কমিশনার ভূমি কর্মকর্তার গাড়ি চালক। এই প্রভাব খাটিয়ে তিনি ওই জমি নিজের নামে লিজ নেন। তবে আঃ বাছেদ দাবি করেন বৈধ ভাবেই তিনি লিজ নিয়েছে এবং বৈধ ভাবেই জমিতে ঘর তুলেছেন। আভা রানীর গায়ে হাত তোলা হয়নি বলেও তিনি দাবি করেন।
বালিয়াটি ৮ নম্বর ইউপি সদস্য মো. জহিরুল হক বলেন, ইউনিয়ন পরিষদে আভা রানীর জমি নিয়ে একটি অভিযোগ এসেছিল। পরিষদ সিদ্ধান্ত দিয়েছিল আগামী তিন মাসের মধ্যে যে বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারবে জমি তার হবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত না মেনে আগেই বাছেদ জমির ওপর ঘর তোলেন। তিনি আরও বলেন জন্মেরপর থেকেই দেখে আসছি ৫০ শতাংশ জমি আভা রানীর পরিবার ভোগ দখল করে খাচ্ছে। হঠাৎ করে বাছেদ কি ভাবে এই জমির মালিক হলো তা সন্দেহজনক।
সাটুরিয়ার অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক সমরেন্দু সাহা লাহোর তাঁর ‘বালিয়াটির যত কথা’ বইতে হরিদাস সাহার হত্যাকান্ড এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার বিষয়ে বিষদ আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন এই পরিবারের একজন শহীদ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ করেছে একজন ছেলে। পুরো পরিবারটি মুক্তিযুদ্ধের সময় চরম অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। অথচ সেই পরিবারের জমি দখল হয়ে যাবে এটা মেনে নেয়া যায় না। তিনি মনে করেন এই শহীদ পরিবারটিকে সম্মান জানাতে কেবল আইনগতভাবে নয় মানবিক দৃষ্টিতেও বিষয়টি বিবেচনা করা উচিৎ।
অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সাটুরিয়া সহকারি কমিশনার (ভূমি) খায়রুন্নাহার। তিনি বলেন বিষয়টি আমরা আইনানুগ ভাবে তদন্ত করে দেখছি। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারটির প্রতি আমাদের নিশ্চয় সহানুভতি থাকবে।