গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাবে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং বন্দরের মাধ্যমে। প্রতি বছর এই আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সামলাতে জাহাজ ভাড়া বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয় বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের। এই খরচ সাশ্রয় এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে তৈরি হচ্ছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। বন্দরে ইতোমধ্যে একটি চ্যানেল তৈরি করে তাতে ১১৪টি জাহাজ নির্মাণসামগ্রী নিয়ে আসা-যাওয়া করেছে। আগামী ২০২৬ সালের ২৬ জানুয়ারি এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে শূন্য দশমিক ৬ থেকে ১ মিলিয়ন (এক মিলিয়ন সমান ১০ লাখ) টিইইউএস (টোয়েন্টি ফিট ইক্যুইভেলেন্ট ইউনিটস) এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ২ দশমিক ২ থেকে ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন টিইইউএস কনটেইনার কার্গো হ্যান্ডেল করা সম্ভব হবে। এতে বার্ষিক আয় হবে ১২ শ’ থেকে ১৫ শ’ কোটি টাকা।
অবশেষে গভীর সমুদ্র বন্দরের দীর্ঘদিনের উচ্চাকাক্সক্ষা স্বাধীনতার ৫২ বছর পর ধীরে ধীরে বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানির ক্রমবর্ধমান পরিমাণ পরিচালনা করতে এবং দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের উপর চাপ কমাতে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এর অর্থায়নে বাংলাদেশ কক্সবাজারে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন এবং একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছে মাতারবাড়ি। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নত করা, বিনিয়োগ বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহায়তার নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে, যা বাংলাদেশ, উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল ও ভুটানের পাশাপাশি আশপাশের অন্যান্য অঞ্চলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বিস্তৃত করার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। এই বন্দর একটি উল্লেখযোগ্য ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে কাজ করবে, যা বাংলাদেশের সঙ্গে আঞ্চলিক অন্যান্য দেশের সংযোগ স্থাপন করবে, বাণিজ্য ও ব্যাবসায়িক কার্যক্রম বাড়িয়ে তুলবে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ইউরোপে কোনো পণ্য পাঠানো হয় না। কার্গো কনটেইনারগুলো প্রথমে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও কলম্বোর বন্দরে নেওয়া হয়। পরে এটি একটি বড় জাহাজে করে (মাদার ভেসেল) ইউরোপে পাঠানোর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ফলে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন অনেক বেশি ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হয়ে ওঠে।
গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ শেষ হলে রপ্তানিপণ্য সরাসরি মাতারবাড়ী থেকে ইউরোপ বা আমেরিকার যে কোনো বন্দরে যেতে পারবে। ফলে খরচ কমে যাবে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য শিপিং করতে ৪৫ দিন সময় লাগে। মাতারবাড়ী বন্দর চালু হলে সেখানে পণ্য যেতে সময় লাগবে মাত্র ২৩ দিন।চট্টগ্রাম থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত সামুদ্রিক দূরত্ব ৩৪ নটিক্যাল মাইল; পায়রা বন্দর ও মোংলা বন্দর থেকে মাতারবাড়ীর দূরত্ব যথাক্রমে ১৯০ ও ২৪০ নটিক্যাল মাইল। ফলে মাতারবাড়ীতে মাদার ভেসেল (একটি বিশাল কনটেইনার জাহাজ) থেকে পণ্য খালাসের পর দ্রুত সড়ক ও সমুদ্রপথে অন্যান্য বন্দরে নিয়ে যাওয়া যাবে। মাতারবাড়ী বন্দর পুরোপুরি চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক অবদান রাখবে। জাইকার মতে, চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় মাতারবাড়ী টার্মিনাল সমুদ্রপথে সরবরাহ করা প্রতিটি ২০ ফুট লম্বা কনটেইনারে ১৩১ ডলার ও একটি ৪০ ফুট কনটেইনারে প্রায় ১৯৭ ডলার সাশ্রয় করবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গভীর সমুদ্রবন্দর দেশের অর্থনীতিকে ২-৩ শতাংশ বৃদ্ধি করবে।
বাণিজ্য বিধিনিষেধ এবং সীমান্ত জুড়ে বাধার কারণে কিছুকিছু অঞ্চল প্রায়শই প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যেমন-উত্তর-পূর্ব ভারতের আটটি রাজ্য তাদের সংযোগগত দূরত্ব, উচ্চ পরিবহন খরচ এবং সীমাবদ্ধ ট্রানজিট বিকল্পের কারণে ভারতের অর্থনৈতিক কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ। কারণ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির প্রভাব আগামী বছরগুলোতে অর্থপূর্ণ উপায়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে পৌঁছাতে পারে। পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলোতে ট্রানজিট প্রবেশাধিকারের মাধ্যমে শুধু উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারত নয়, নেপাল, ভুটান ও বঙ্গোপসাগরের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোও বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল করতে পারে, যা স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে একটি গেম চেঞ্জারের ভূমিকা রাখবে। মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনালকে দেশের ও প্রতিবেশী দেশগুলোর পণ্য পরিবহনের কাজে লাগানো যাবে। শুরুতে নৌপথের পাশাপাশি সড়কপথে যোগাযোগ-সুবিধা থাকবে। এরপর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন মাতারবাড়ী বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হলে রেলপথেও যোগাযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে সমুদ্রপথের বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। মাতারবাড়ী থেকে সরাসরি বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে বড় জাহাজ ও চলাচল করতে পারবে।