বাংলাদেশের উপকূলে, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে বসবাস করা মানে হচ্ছে নিত্য সুপেয় পানির সন্ধান ও সরবরাহে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। সেখানে প্রায় সকল পানির উৎসগুলো লবণাক্ততার কারণে পানের অযোগ্য। তাই স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে বিশুদ্ধ পানি এখন একটি বহুমূল্য পন্যের নাম। উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় চার কোটি মানুষের বসবাস। এদের সবাইকে দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করতে বিশুদ্ধ পানির জন্য প্রাকৃতিক উৎস, যেমন পুকুর, নদী এবং টিউবওয়লের উপরে নির্ভর করতে হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে এসব পুকুর এবং অন্যান্য জলাধারগুলোতে লবণাক্ততার পরিমান দিন দিন বেড়েই চলছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সুপেয় পানির সমস্যা এতটাই প্রকট যে বলা হয়, দক্ষিণবঙ্গে শুধু মায়েদের চোখের জলটুকুই বিশুদ্ধ, বাকি সব লবণাক্ত জল। দক্ষিণবঙ্গের বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা জেলার উপকূলীয় উপজেলাগুলোর চিত্র দেখলেই তা জানা যায়। এসব অঞ্চলে গেলে স্বাভাবিকভাবে মনে হবে পানির অভাব নেই। এটাও সত্য কথা, আসলেই পানির অভাব নেই। কিন্তু সামান্য কিছু বাদ দিয়ে অধিকাংশ জায়গার পানিই লবণাক্ত। শুধু সুপেয় পানি পান করার জন্য এসব অঞ্চলের মানুষের যেতে হয় কয়েক কিলোমিটার দূরে। এত দূর যাওয়ার পরও সব জায়গায় নলকূপ নেই। নির্দিষ্ট কিছু জলাশয়, যেগুলো সরকারি পুকুর নামে পরিচিত, সেখানের পানি পান করে মানুষ। এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে সরকারি পুকুরের পাশে খাল থাকে। খালের পানি লবণাক্ত, যার ফলে পুকুরের পানিও কিছুটা লবণাক্ত থাকে। কিন্তু গ্রামের সাধারণ মানুষের কিছুই করার নেই। ওই পানিই খেতে হয়। কারণ, দূরের সুপেয় পানির নলকূপ থেকে পানি আনতে জায়গাভেদে ২৫০-৩৫০ টাকা নেন ভ্যানচালকেরা। গ্রীষ্মকালে আরও বেশি নেন। যদিও সরকার পানি সংরক্ষণ করে রাখার ট্যাংক দিচ্ছে গ্রাম পর্যায়ে, যাতে বৃষ্টির পানি সারা বছর ব্যবহার করা এবং পান করতে পারে মানুষ। তবে এটা এখনো সবাই পায়নি। সুপেয় পানির অভাব দূর করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগে নেওয়া হয়েছিল একটি প্রকল্প। বিভিন্ন জায়গায় সরকারি পুকুর করা এবং পুকুরের পাশে ফিল্টার স্থাপন করা হয়। কিন্তু নিয়মিত তদারকির অভাবে অনেক সময় সেগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনেই দেখা যায়, অনেক জায়গায় সংস্কার করার পর সরকারি পুকুরগুলোতে মানুষের নামা বন্ধ করে নিজেদের সুবিধামতো পুকুরে মাছ এবং পাড়ে সবজি চাষ করেছে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী। তবে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বিপদে পড়েন যখন সরকারি পুকুরগুলোতে নির্দিষ্ট দিনে টিকিট দিয়ে মাছ ধরা হয়। অন্তত ৭-১০ দিনের মধ্যে তখন আর ওই পানি খাওয়া যায় না। এই মাছ চাষ এবং মাছ শিকারের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীসহ অনেকে জড়িত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগে নেওয়া প্রকল্পকেও যদি এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, তাহলে সুপেয় পানির জন্য দক্ষিণবঙ্গের মানুষের হাহাকার দূর কীভাবে হবে? এ বিষয়ে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কেননা দক্ষিণবঙ্গে দিন দিন পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। আবার নলকূপ স্থাপন করলেও সেই পানিতে আর্সেনিক পাওয়া যায়। ফলে সেই পানি পানের অযোগ্য। আর লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে বর্গাচাষিদের আয় বছরে ২১ শতাংশ কমেছে। আইসিডিডিআরবির গবেষণায় জানা গেছে, লোনাপানির কারণে দক্ষিণাঞ্চলের নারীদের গর্ভপাতের হার অন্য জায়গার তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। এটা খুবই চিন্তার বিষয়। তাই সরকারের উচিত দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। তা না হলে দক্ষিণবঙ্গের মানুষের পানির জন্য হাহাকার দূর হবে না।