বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়ছে। এই প্রেক্ষিতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে গুরুত্ব বাড়াচ্ছে সরকার। জোর দিচ্ছে প্রাকৃতিক উৎস- সূর্যের আলো ও তাপ, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈবশক্তি, শহুরে বর্জ্য ইত্যাদি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতার মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস ব্যবহার করে উৎপাদন সক্ষমতা মাত্র তিন শতাংশের মতো। জানা গেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এটা ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। বর্তমানে ৯টি সৌরশক্তিচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণকাজ চলছে, যাদের সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ৪৫০ মেগাওয়াট। এ ছাড়া একটি বায়ুচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পেরও কাজও চলছে, যেখান থেকে ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জুনে চট্টগ্রামের বারইয়ারহাটে ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, মোংলার ৫৫ মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র, পাবনায় ৬৪ মেগাওয়াট সৌর পার্ক, নেত্রকোনায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, কক্সবাজারের ইনানীতে ৫০ মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র, চাঁদপুরে ৫০ মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৩১৯ মেগাওয়াট। তবে সরকারের লক্ষ্য ২০২৩ সালের জুনে এগুলো থেকে কমপক্ষে আরও ২শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ করা। অন্যদিকে ২০৪১ সালের ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এক যুগে দেশের বিদ্যুৎ খাতে অভাবনীয় সাফল্যের দাবি করা হচ্ছে। এরইমধ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তবে এ সফলতা এসেছে মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি প্রযুক্তির ওপর ভর করে। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে অন্য সব জ্বালানির মতোই সমান গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের। কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সন্তোষজনক অবস্থান তৈরি করতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সঠিক রূপরেখা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিতকরণ ও তা দূরীকরণে সংসদীয় সাবকমিটি গঠন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশের সম্ভাবনা রয়েছে বেশ। কিন্তু সে অনুযায়ী অগ্রগতি অপেক্ষাকৃত ধীর। নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার দিক থেকে এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় পেছনে পড়ে আছে বাংলাদেশ। উৎপাদনে এগিয়ে থাকা দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, চীন ও মালয়েশিয়া। এশিয়ার মধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে চীন। গত ১০ বছরে দেশটি মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি সক্ষমতা বাড়িয়েছে। বর্তমানে চীনের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১১ লাখ ৬০ হাজার ৭৯৯ মেগাওয়াট। ২০১৩ সালে চীনের মোট সক্ষমতার ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ। দক্ষিণ এশিয়ায় গত এক দশকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে ভারত। দেশটির মোট উৎপাদন সক্ষমতার ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ। বিশেষত সৌর, বায়ু ও হাইড্রো বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে দেশটিতে। এ ছাড়া মালয়েশিয়া মোট সক্ষমতার ২৩ দশমিক ৩, আফগানিস্তান ৬৪ ও ফিলিপাইন ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছে। ২০২২ সালে বিশ্বে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের সবচেয়ে বেশি সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। গত বছর এ খাত থেকে ২৯৫ গিগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। একই সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির খরচও কমেছে। দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের সক্ষমতা সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৯৬৬ মেগাওয়াট। সে হিসাবে বিদ্যুতের মোট উৎপাদন সক্ষমতায় এর অংশগ্রহণ মাত্র ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। ২০০৮ সালে সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা ঘোষণা করে। সেই লক্ষ্য অনুযায়ী, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ২০১৫ সালে ৫ শতাংশ ও ২০২০ সালে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু তা অর্জন হয়নি। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ হিসেবে সৌরবিদ্যুতের পরিচিতিই বেশি। এ সৌরবিদ্যুৎ ছড়িয়েছে প্রধানত গ্রাম, মফস্বল ও চরাঞ্চলে। সোলার সিস্টেমের ওয়াটপ্রতি দাম যখন ৪৫০ কিংবা ৫০০ টাকা ছিল, তখন থেকেই এটি ব্যবহারে সাধারণ মানুষের আগ্রহ সামাজিক গ্রহণযোগ্যতারই সাক্ষ্য দেয়। ফলে দ্রুততার সঙ্গেই বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ সোলার হোম সিস্টেমের ব্যবহার শুরু হয়েছে। অথচ কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুতের দাম বিশ্বব্যাপী ৭২ শতাংশ কমে গেলেও বাংলাদেশে এ বিদ্যুৎ নীতিনির্ধারণী মহলে মূল ধারার ভবিষ্যৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। আর ঠিক এ কারণেই নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পূর্বঘোষিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়নি। অন্যদিকে প্রযুক্তি আর চিন্তার অভিনবত্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিদ্যুৎ দিনকে দিন পরিণত হচ্ছে, অতিক্রম করছে সব বাধা। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার জন্য এখন রয়েছে ভাসমান সৌরপ্রযুক্তি, কৃষিজমিতে ফলন আর সৌরবিদ্যুৎ একসঙ্গে করার জন্য ‘সোলার শেয়ারিং’ আর বিকেন্দ্রীভূত গ্রিড ব্যবস্থাপনার মতো সমাধান। অন্য সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো সৌর কিংবা বায়ুবিদ্যুৎ করতে বিশাল এলাকা অধিগ্রহণের কোনো প্রয়োজন নেই। পতিত অকৃষিজমি, দখল হয়ে যাওয়া নদীর পাড় এবং বাড়ির ছাদের মতো স্থানে সোলার প্যানেল আর বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ উপকূলবর্তী এবং অগভীর সমুদ্র এলাকা বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য খুবই উপযোগী। সেই সঙ্গে সৌর আর বায়ুবিদ্যুতের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য রয়েছে দাম কমতে থাকা ব্যাটারির সুবিধা। এভাবে শিল্প, কৃষি আর ব্যবসা-বাণিজ্যে এ বিদ্যুৎ ক্রমেই নিজের দখল বাড়াচ্ছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আমরা সৌর বিদ্যুৎ সম্প্রসারণে বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছি। কিন্তু আমাদের জমির স্বল্পতা রয়েছে। এজন্য অন্য যেসব জায়গায় সৌর বিদ্যুৎ স্থাপন করা সম্ভব সেগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, সৌর বিদ্যুতের জন্য আমরা একটা রোডম্যাপ তৈরি করতে চাই। নেট মিটারিং গাইডলাইন আকর্ষণীয় করা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা সংশোধন করার উদ্যোগ আমরা ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছি। কৃষিতে সৌর বিদ্যুৎ কীভাবে সম্প্রসারণ করা যায় সে বিষয়েও কাজ করছি।