বরগুনায় ব্রিজ ভেঙে মাইক্রোবাস খালে পড়ে মাদারীপুর জেলার শিবচরের একই পরিবারের নিহত ৭ জনের মরদেহ শনিবার (২২ জুন) গভীর রাতে বাড়িতে এসে পৌঁছায়। রোববার (২৩ জুন) সকাল থেকেই মরদেহ দাফনের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে নিহতদের বাড়িতে।
দূর্ঘটনায় শিবচর উপজেলার ভদ্রাসন ইউনিয়নের সাহাপাড় গ্রামের মরহুম ফজলুর রহমান খানের স্ত্রী ফরিদা বেগম, ছোট ছেলের স্ত্রী রাইতি আক্তার(৩০), তার মা রুমি বেগম(৪০) মারা যান। এ ছাড়া একই উপজেলার পার্শ্ববর্তী ক্রোকচর এলাকার আবুল কালাম আজাদ এর স্ত্রী মুন্নি বেগম(৪০), তার দুই মেয়ে তাহিয়া(৭) ও তাসদিয়া(১১) এবং বাবুল মাতুব্বরের স্ত্রী ফাতেমা আক্তার(৪০) ঘটনাস্থলেই মারা যান।
রোববার সকাল থেকেই শিবচরের ভদ্রাসন সাহাপাড়া গ্রামে, ক্রোকচরে এবং উমেদপুরে মরদেহ দাফনের কাজ ও কবর খননসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে নিহতদের বাড়িতে। বিয়ের আনন্দের রেশ নিয়ে রোববার বাড়ি ফেরার কথা ছিল তাদের। অথচ শোকের চাদরে ঢেকে দিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন তারা। রাতে মরদেহ বাড়িতে পৌঁছালে শোকের মাতম উঠে। স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তান হারিয়ে পাগল প্রায় বাবা আবুল কালাম আজাদসহ পরিবারের সদস্যরা। অন্যদিকে ৯ মাসের বাচ্চা রেখে মারা যাওয়া সোহেল খানের স্ত্রী ও শ্বাশুড়ির বাড়িতে কান্নার রোল। সোহেল খানের মাও মারা গেছেন একই সাথে।
এলাকাবাসী জানান, সান্ত¡না দেওয়ার মতো কেউ নেই। আপনজনের প্রত্যেক পরিবারেই এখন শোকের মাতম, আহাজারি। মোঃ মাসুম নামের স্থানীয় এক যুবক বলেন, তিন বাড়িতে মাতম চলছে। স্বান্তনা দেবার মতো কেউ নাই। সকাল থেকেই পাড়া-প্রতিবেশীরা আসছে বাড়িতে। কবর খনন চলছে। এক সাথে একই পরিবারের এত মানুষের মৃত্যুতে এলাকাবাসীও থমকে গেছে। পুরো গ্রামের মানুষের মধ্যেই এখন শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
তিনি আরও বলেন, সকাল দশটার পর জানাজা শেষে মরদেহ নিজ নিজ কবরস্থানে দাফন করা হবে।
এদিকে মোঃ দুলাল নামের স্থানীয় আরেক ব্যক্তি বলেন, দূর্ঘটনায় এই পরিবারের ছোট ছেলে সোহেল খানের মা মারা গেছে। আবার তার স্ত্রী এবং শ্বাশুড়িও মারা গেছে। এত শোক সইতে পারা কষ্টের! একবার মায়ের লাশের কাছে আরেক বার স্ত্রী-শ্বাশুড়ির লাশের কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। ওর ৯ মাসের বাচ্চাটা বেঁচে আছে। মা, নানী এবং দাদী সবই গেলো। বাবা ছাড়া এই শিশুটিকে লালনপালন করার কেউ রইলো না। পুরো বাড়ির বাতাস যেন থমকে আছে!'
দূর্ঘটনায় আহত মরহুম ফজলুর রহমান খানের ছেলে সাবেক সেনা সদস্য মাহবুব খান সবুজের স্ত্রী দিশা জানান, ব্রিজ ভেঙে মাইক্রোবাস খালে পড়ে যাওয়ার পর আমরা জানালার কাঁচ ভেঙে বের হয়ে আসি। ব্রিজ যখন ভেঙে পড়ে তখন বলা হলেও ড্রাইভার দরজার লক খুলে দেয়নি। ড্রাইভার নিজে বের হয়ে যায় কিন্তু দরজার লক খুলেনি! মাহাবুবের ছোট ভাই সোহেল খান জানান, আমার স্ত্রী-শ্বাশুড়ি মারা গেছে। আমার বাচ্চাকে উদ্ধার করতে পারলেও স্ত্রীকে উদ্ধার করতে পারিনি। আমাদের সব শেষ।
এদিকে, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে মোট ৭০ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করা হয়েছে। এই মর্মান্তিক নিহতদের ঘটনায় উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন গভীর শোক ও দু:খ প্রকাশ করেছে।
ভদ্রাসন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রহিম বেপারী বলেন, আমার জীবনে এক সাথে একই পরিবারের সাত জনের মৃত্যু প্রথম দেখলাম। এটা খুবই দু:খজনক। আমরা এলাকাবাসী খুবই মর্মাহত। যে ব্রীজটি ভেঙ্গে এই দূর্ঘটনাটি ঘটেছে এটা প্রশাসনের গাফিলতি ছিল বলে আমি মনে করি। এ ঘটনায় যাদের কর্তব্যে অবহেলা ছিল সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে আমি তাদের শাস্তির দাবী করছি।
শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, সড়ক দূর্ঘটনায় একই পরিবারের ৭ জন নিহতের ঘটনা আসলে খুবই দু:খজনক। আমরা নিহতদের দাফন কাফনের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দশ হাজার টাকা করে মোট সত্ত্বর হাজার টাকা দিয়ে তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি।
উল্লেখ্য, শনিবার দুপুরে বৌভাতের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বরগুনার আমতলী পৌর এলাকায় বরের বাড়িতে যাওয়ার সময় হলদিয়া- চাওড়া সীমান্তবর্তী চাওড়া হলদিয়া খালের ওপর লোহার ব্রিজ ভেঙে মাইক্রোবাস পানিতে পড়ে ডুবে যায়। এ দুর্ঘটনায় একই পরিবার ৭ জনসহ ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত সাতজনই মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার বাসিন্দা।