বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশক থেকে বাংলা সাহিত্যে যে গণমুখী প্রগতিশীল ধারার সূত্রপাত. তার উৎস ভূমি নির্মাণ করেছে ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’। সংক্ষুব্ধ সমকাল ও স্বদেশের সঙ্গে, সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে সাহিত্যেও সপ্রেম ও গভীরতর সংযোগ স্থাপনই ছিল প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের মৌল লক্ষ্য। শ্রমজীবী মানুষকে সচেতন করা, বিপ্লবের জন্য শাণিত সেনানী হয়ে উঠতে সাহায্য করা এবং শোষণমুক্তির সংগ্রামে সামিল হওয়ার ডাক দেয়াই শিল্প সাহিত্যের প্রধান কাজ প্রগতি লেখক সঙ্ঘের সংগঠকেরা এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। ১৯৩৬ সালে ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’ স্থাপনের পর অল্প সময়ের মধ্যে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে সংগঠনের শাখা গঠিত হতে থাকে। প্রতিষ্ঠার তিন বছর ১৯৩৯ সালে, ঢাকায় স্থাপিত হয় প্রগতি লেখক সঙ্ঘের শাখা। প্রগতি লেখক সঙ্ঘের শাখা ঢাকায় কীভাবে গড়ে উঠেছিল কারা এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন, কীভাবে সঙ্ঘের বিস্তার ঘটে, এদেশের সংস্কৃতি আন্দোলনে কী ছিল এর ভূমিকা এসব বিষয় নিয়েই বর্তমান নিবন্ধ।
২.
১৯৩৬ সালে ভারত বর্ষের প্রগতিশীল শিল্পী-সাহিত্যিকরা সমবেত হন লক্ষেèৗ শহরে। পৃথিবীব্যাপী ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লেখকদের সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজন থেকে তারা গঠন করলেন ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’। এ সময় খণ্ডে গোটা পৃথিবীতে ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রগতিশীল মানুষ সংগঠিত হতে থাকে। একদিকে লক্ষেèৗতে প্রতিষ্ঠিত নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সঙ্ঘ, অন্যদিকে ফ্রাঙ্কো- ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে পৃথিবীর দেশে দেশে প্রগতিশীল মানবতাবাদী শিল্পী সাহিত্যিকদের অগ্রণী ভূমিকা পূর্ববাংলার শিল্পী-সাহিত্যিকদের আলোড়িত করে। ১৯৩৬ সালের শেষ দিকে ঢাকায় প্রগতি লেখক সঙ্ঘের শাখা খোলার জন্য রণেশ দাশগুপ্ত উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। কলকাতার সংগঠকদের সঙ্গে ঢাকার উদ্যোক্তাদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ১৯৩৭ সালের শেষ দিকে সঙ্ঘের শাখা স্থাপনের জন্য নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ জহীর, নিখিল বহ প্রগতি লেখক সঙ্ঘের সম্পাদক অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী এবং অন্যতম সংগঠক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ঢাকায় আসেন। এভাবেই শুরু হয় ঢাকায় প্রগতি লেখক সঙ্ঘ স্থাপনের প্রাথমিক প্রচেষ্টা। অভিন্ন সময়ে ঢাকায় অন্য একটি সংগঠন গড়ে ওঠে, যা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ১৯৩৮ সালের শেষ দিকে আন্দামান ফেরত মার্কসবাদে দীক্ষিত বিপ্লবী কমিউনিস্টরা ঢাকা শহরের দক্ষিণ ইমশুন্ডির জোড়পুর লেনে একটা অফিস প্রতিষ্ঠা করেন। ‘কমিউনিস্ট পাঠচক্র’ নামে গোপন ক্লাসের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণী ও যুবসমাজকে মার্কসবাদ লেনিনবাদের বিপ্লবী দর্শনে উদ্বুদ্ধ করাই ছিল এই পাঠকচক্রের মূল লক্ষ্য। ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির গোপন সংগঠন ‘কমিউনিস্ট পাঠচক্র’ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সতীশ পাকড়াশী জ্ঞান চক্রবর্তী, রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখ। প্রথম দিকে রণেশ দাশগুপ্ত এই পাঠচক্র পরিচালনা করতেন। ১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ্রের উপর কমিউনিস্ট পার্টি এই পাঠাগার পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করে। তখনকার ঢাকার প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবী ও লেখকেরা প্রগতি পাঠাগারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সাজ্জাদ জহির, সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ প্রগতি লেখক সঙ্ঘ গঠনের জন্য ঢাকায় এলে কিছুসংখ্যক লেখক উৎসাহ প্রকাশ করেন। অতঃপর প্রায় দু’বছর পর ১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকায় কমিউনিস্ট-হিউম্যানিস্ট-প্রগতিশীল লেখকদের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘প্রগতি লেখকও শিল্পী সঙ্ঘ’ এর ঢাকা শাখা। পূর্বোক্ত কমিউনিস্ট পাঠকচক্রের ‘প্রগতি পাঠাগার’ যারা পরিচালনা করতেন, তারাই এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, অমৃতকুমার দত্ত, জ্যোতিময় সেনগুপ্ত, সতীশ পাকড়াশী প্রমুখ শিল্পী-সাহিত্যিক চিন্তাবিদের প্রচেষ্টায় ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ’ নামে এই যে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠল, বয়সে সকলের চেয়ে ছোট হওয়া সত্ত্বেও সোমেন চন্দ্রই সেক্ষেত্রে পালন করেন প্রধান উদ্যোগীর ভূমিকা। তবে রণেশ দাশগুপ্তই ছিলেন ঢাকায় প্রগতি লেখক সঙ্ঘের শাখা স্থাপনের মূল স্থপতি।
১৯৩৯ সালে ঢাকা জেলা প্রগতি লেখক সঙ্ঘের একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত, সোমেন চন্দ্র, কিরণ শঙ্কর সেনগুপ্ত, অমৃতকুমার দত্ত, জ্যোতিময় সেনগুপ্ত, সতীশ পাকড়াশী প্রমুখ। ১৯৩৯ সালে সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হলেও, ১৯৪০ সালের মাঝামাঝি সময়ে গেণ্ডারিয়া হাইস্কুল প্রাঙ্গণে এক সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় প্রগতি লেখকও শিল্পী সঙ্ঘ উদ্বোধন করা হয়। এই সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন ‘বুদ্ধিও মুক্তি’ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ, ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এর সংগঠক কাজী আবদুল ওদুদ। সম্মেলনে রণেশ দাশগুপ্তকে সংগঠনের সম্পাদক এবং সোমেন চন্দ্রকে সহ-সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
১৯৪০ সালে এই সম্মেলনের সময় এবং তার অব্যবহিত পরে যারা প্রগতি লেখক সঙ্ঘের সঙ্গে জড়িত হন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন অচ্যুত গোস্বামী, সরলানন্দ সেন এবং নৃপেন্দ্র চন্দ্র গোস্বামী। সঙ্ঘের প্রথম অফিস স্থাপিত হয় জোড়পুর লেনস্থ ‘প্রগতি পাঠাগার’-এ প্রতি রোববার সকাল ১১টায় সঙ্ঘের বৈঠক বসত। কিন্তু ‘প্রগতি পাঠাগার’-এ সভার স্থান সংকুলান হতো না। তাই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পালাক্রমে বিভিন্ন সভ্যের বাড়িতে বসত সঙ্ঘের সাহিত্যবাসর। কখনো নারিন্দায়, কখনে দক্ষিণ মৈশুন্ডি, কখনো বা ২১নং কোর্ট হাউজ স্ট্রিটে কিংবা সূত্রাপুরের মাঠে সঙ্ঘের অধিবেশন বসত। কখনো আবার স্থানের অভাবে নিয়মিত সাহিত্যবাসর অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। এক পর্যায়ে অচ্যুত গোস্বামীর বাসায় সঙ্ঘের নিয়মিত বৈঠক বসত। অচ্যুত গোস্বামী তখন থাকতেন ২১নং কোর্ট হাউজ স্ট্রিটের তিনতলা একটা বাড়ির দ্বিতলে। ১৯৪৫-এর মার্চ মাস পর্যন্ত সঙ্ঘের অফিস হিসেবেও ব্যবহৃত হতো এই ২১নং কোর্ট হাউজ স্ট্রিটের বাড়িটি।
১৯৪০ সালের ডিসেম্বরের এক সন্ধ্যায় ঢাকার জগন্নাথ ইন্টার মিডিয়েট কলেজের অ্যাসেম্বলি হলে অনুষ্ঠিত হয় প্রগতি লেখক সঙ্ঘের বার্ষিক প্রীতি সম্মেলন। জাতিক আন্তর্জাতিক সঙ্কটের পটভূমিতে অনুষ্ঠানটি নানা কারণে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। উদ্যোক্তারা চেয়েছিলেন প্রগতিশীল লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ব্যাপক ঐক্য গড়ে উঠুক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কবি বুদ্ধদেব বসু এবং বার্ষিক কার্যবিবরণী উপস্থাপন করেন সম্পাদক রণেশ দাশগুপ্ত। সাহিত্যবাসরে কবিতা গল্প প্রবন্ধ পাঠ করেন নৃপেন ভট্টাচার্য, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, ভবানীপ্রসাদ দত্ত, অমৃতকুমার দত্ত, সোমেন চন্দ্র প্রমুখ। সাহিত্য বিষয়ক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অমলেন্দ্র বসু, নবেন্দু বসু এবং জুলফিকার আলী।
১৯৪১-এর অক্টোবর মাসে সদরঘাটের নিকটবর্তী ব্যাপ্টিস্ট মিশন হলে প্রগতি লেখক সঙ্ঘ ঢাকা জেলা শাখার দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন চিন্তাবিদ কাজী আবদুল ওদুদ। সাংগঠনিক সভায় রিপোর্ট পেশ করেন রণেশ দাশগুপ্ত। এই সম্মেলনে সোমেন চন্দ্র সঙ্ঘের সম্পাদক এবং অচ্যুত গোস্বামী সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। আমৃত্যু (৮ মার্চ, ১৯৪২) সোমেন চন্দ্র সঙ্ঘের সম্পাদক ছিলেন। এ সময় ঢাকার প্রগতি লেখক সঙ্ঘের উদ্যোগে উল্লেখযোগ্য যে কাজটি হয়, তা হচ্ছে সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’ গঠন। বস্তুত, প্রগতি লেখক সঙ্ঘের কর্মীরাই গঠন করেন ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’। এই সমিতির যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন প্রগতিশীল কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতীছাত্র দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’ ১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সদরঘাটের নিকটবর্তী ব্যাপ্টিস্ট মিশন হলে সপ্তাহব্যাপী এক চিত্র-প্রদর্শনীর আয়োজন করে। প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলা। সোভিয়েত সুহৃদ সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত এই চিত্র প্রদর্শনীর সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য সোমেন চন্দ্র বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনিই ছিলেন এই আয়োজনের সবচেয়ে পরিশ্রমী কর্মী-সংগঠক।
সোমেন চন্দ্রের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় অল্পদিনের মধ্যেই ঢাকা জেলা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ এবং সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি যৌথভাবে ফ্যাসিবাদবিরোধী জনমত গড়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। সোমেনই ছিলেন ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির প্রাণকেন্দ্র। তাই ফ্যাসিস্ট শক্তি প্রথমেই তাকে শনাক্ত করে হত্যার জন্য। এ প্রেক্ষাপটেই ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ ফ্যাসিস্ট শক্তির লেলিয়ে দেয়া আততায়ীর হাতে শহীদ হন সোমেন চন্দ্র। ঐ দিন ঢাকার সূত্রাপুরের সেবাশ্রম মাঠে ফ্যাসিবিরোধী এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এই সমাবেশে যোগদানের উদ্দেশে মিছিল নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় ফ্যাসিস্ট শক্তির ভাড়াটিয়া আততায়ীরা সোমেন চন্দ্রকে লক্ষ্মীবাজারের কাছে আক্রমণ করে। প্রকাশ্য রাজপথে রড ও ভোজালির আঘাতে সোমেন চন্দ্র শহীদ হন। এ সময় তিনি ঢাকা জেলা প্রগতি লেখক সঙ্ঘ ছাড়াও ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নেরও সম্পাদক ছিলেন। সোমেনের হত্যাকা- দেশের প্রগতিশীল শিল্পী-সাহিত্যিকদের আলোড়িত ও বিক্ষুব্ধ করে তোলে। হত্যাকারীদের ধিক্কার জানিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হতে থাকে প্রতিবাদ সভা।
প্রগতিশীল সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে লেখকদের সচেতন করার উদ্দেশ্যে ঢাকা জেলা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ মাঝে মাঝে বর্ধিত অধিবেশনের আয়োজন করত। এসব অধিবেশনে ঢাকা শহরের সব বয়সের লেখকেরা অংশগ্রহণ করতেন। এ পর্যায়ে ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯-এর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে প্রগতি লেখক সঙ্ঘের একটা কর্মকা- বিকাশ লাভ করে। সপ্তাহের প্রতি রোববার সকাল ১১টায় মধুর রেস্তোরাঁয় সঙ্ঘের সাহিত্যসভা অনুষ্ঠিত হতো। এ ক্ষেত্রে সক্রিয় সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন মুনীর চৌধুরী, শামসুর রহমান খান, সুলতানুজ্জামান খান, অরবিন্দ সেন, মদনমোহন বসাক, আমিনুল ইসলাম, হাসান হাফিজুর রহমান, কল্যাণ দাশগুপ্ত, আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, ওসমান জামাল, মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, এ এইচ শাহাদাৎ উল্লাহ প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের মূল সংগঠক ছিলেন তিনজন কল্যাণ দাশগুপ্ত, মুনীর চৌধুরী এবং অরবিন্দ সেন। মধুর রেস্তোরাঁয় সঙ্ঘের সদস্যদের সঙ্গে আড্ডা দিতে কখনও কখনও আসতেন আনোয়ারুল করিম, এনায়েত করিম, তাজউদ্দিন আজমেদ প্রমুখ বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদ।
প্রগতি লেকক সঙ্ঘ মাঝে মাঝে হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করতো। দুই নামে দেয়াল পত্রিকা বের হতো কখনো ‘ইশতেহার’ কখনো বা ‘স্কুলিঙ্গ’ দেয়াল পত্রিকা লেখার দায়িত্বে থাকতেন শামসুর রহমান খান। কখনও কখনও তাকে সাহায্য করতেন আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন।
বিভাগ উত্তর সময়ে সঙ্ঘের যখন কোনো স্থায়ী কার্যালয় ছিল না। তখন মাঝে মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের তৎকালীন ছাত্র (পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাঁচার্য) মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীর কক্ষেও কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভাগুলোতে নিয়মিতভাবে যারা উপস্থিত থাকতেন তাদের মধ্যে আছেন সরদার ফজলুল করিম, সানাউল হক, আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন, আবদুল মতিন, কামালউদ্দিন প্রমুখ। এ সময় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ করাচি থেকে ঢাকা আসেন। ঢাকায় সেবার তিনি উঠেছিলেন মোজাফফর আহমেদ চৌধুরীর কক্ষে। সে কারণেই এ পর্বেও সভাগুলোতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহও উপস্থিত থাকতেন এবং কখনও কখনও আলোচনায় অংশ নিতেন। এ সময় সাময়িকভাবে প্রগতি লেখক সঙ্ঘের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন মুনীর চৌধুরী, আর সহ-সম্পাদক ছিলেন আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন। ঢাকার প্রগতি লেখক সঙ্ঘের সদস্যদের ব্যাপক গ্রেপ্তার শুরু করে এবং নেতৃস্থানীয় প্রায় সকলকেই কারাগারে আটক করে। এ অবস্থায় নিরাপত্তার কারণে লেখক সঙ্ঘ নির্দিষ্টভাবে কোনো সদস্যকে সম্পাদক নির্বাচিত করেনি। সঙ্ঘের সভা আহ্বান, যোগাযোগ রক্ষা করা, পত্রিকা প্রকাশ ইত্যাদি কাজ পালাক্রমে তিন/চারজনকে করতে হতো।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সঙ্ঘের পঞ্চম সম্মেলন। এ সম্মেলনে নীতি এবং আদর্শগত কারণে সংগঠকদের মধ্যে মতান্তর দেখা দেয় এবং ক্রমে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। এ অবস্থায় কলকাতা তথা সারা ভারতবর্ষে সংগঠনটি ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হতে শুরু করে। কলকাতার এই বিরূপ হাওয়া ঢাকাতেও ঢেউ তোলে। নীতিগত প্রশ্নে ঢাকার সংগঠকদের মাঝেও মতান্তর দেখা দেয়, যা ক্রমে সংগঠনটিকে করে দেয় নিষ্ক্রিয়। রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে সংগঠকদের মধ্যে বিতর্কও এ নিষ্ক্রিয়তাকে ত্বরান্বিত করে। রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে বিতর্ক, কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে তাত্ত্বিক বিরোধ, মুসলিম লীগ সরকারের প্রচণ্ড দমননীতি প্রধানত এসব কারণে ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকার প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের অস্তিত্ব একবারে বিলুপ্ত হয়। কিন্তু সঙ্ঘের সঙ্গে জড়িত সাহিত্যিকরা নতুন পরিস্থিতিতেও সঙ্ঘবদ্ধ থাকতে চাইলেন। প্রধানত রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগত কারণে ঢাকার প্রগতি লেখক সঙ্ঘকে শেষ পর্যন্ত আর টিকিয়ে রাখা যায়নি। পরবর্তীকালে সংগঠনের সঙ্গে জড়িত সাহিত্য কর্মীরাই গঠন করেছিলেন ‘পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ বস্তুত প্রগতি লেখক সঙ্ঘের আদর্শ ও চিন্তাধারায় ঋদ্ধ হয়ে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ এরপর পূর্ববাংলার প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের ঐক্যবদ্ধ সংগঠন হিসেবে কাজ শুরু করে।
৩.
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সক্রিয় বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ পর্যন্ত নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকেছে ঢাকার প্রগতি লেখকও শিল্পী সঙ্ঘ। বলা যায়, চল্লিশের দশকের শেষাবধি ঐ সব কর্মকাণ্ডের ইতিহাসই সঙ্ঘের ইতিহাস। এরমধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্রকাশনার কাজ। ঢাকা থেকে লেখক সঙ্ঘের মুখপত্র বেরিয়েছে দুটি ‘ক্রান্তি’ এবং ‘প্রতিরোধ’।
ইতিপূর্বে ১৯৩৭ এ কলকাতা থেকে নিখিল বঙ্গ প্রগতি লেখক সঙ্ঘের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ‘প্রগতি’ নামে একটি সঙ্কলন গ্রন্থ। ঢাকা থেকে অনুরূপ একটি গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে এখানকার সঙ্ঘ। সেই উদ্যোগেরই পরিণতিতে ১৯৪০ এর শেষ দিকে প্রকাশিত হয় ‘ক্লান্তি’ প্রথম খ-। ‘ক্লান্তি’ প্রকাশিত হয় রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায়। উল্লেখ্য যে, এটিই পূর্ববাংলা থেকে প্রকাশিত প্রগতি সাহিত্যের প্রথম সঙ্কলন। ‘ক্লান্তি’ প্রথম সংখ্যায় মোট তিনটি প্রবন্ধ, দশটি কবিতা এবং চারটি গল্প পত্রস্থ হয়। উল্লেখযোগ্য লেখাগুলো হচ্ছে ১. রণেশ দাশগুপ্ত ‘নতুন দৃষ্টিতে উপন্যাস’, ২. অচ্যুত গোস্বামী ‘বাংলা কাব্যেও গতি’, ৩, নৃপেন্দ্র চন্দ্র গোস্বামী ‘সাহিত্যে সৌন্দর্যবাদ’, এবং ৪. সোমেন চন্দ্র ‘বনসুতি’, এছাড়া আরও ছিল আমেরিকার কবি চার্লস হেনরি নিউম্যানের দুটি কবিতা এবং চীনা লেখক চাং টিয়েন ইর লেখা একটি ছোটগল্পের অনুবাদ। গল্পটি অনুবাদ করেছিলেন অমৃতকুমার দত্ত। ১৪০ পৃষ্ঠার এই সঙ্কলনটির দাম রাখা হয়েছিল আট আনা। প্রকাশক ছিলেন প্রগতি লেখক সঙ্ঘ, ঢাকা শাখার পক্ষে সোমেন চন্দ্র। ‘ক্লান্তি’, একবারই মাত্র বেরিয়েছে।
সোমেন চন্দ্রের মৃত্যুর পর প্রগতি লেখক সঙ্ঘ নিয়মিত প্রকাশ করতো ‘প্রতিরোধ‘ শীর্ষক সাহিত্যপত্র। ‘প্রতিরোধ’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৯ বঙ্গাব্দে। পত্রিকার প্রচ্ছদে লেখা থাকত ‘মার্ক্সবাদী ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সাহিত্যের পাক্ষিপত্র’। ঢাকার প্রগতি লেখক সঙ্ঘের মুখপত্র ‘প্রতিরোধ’ পত্রিকা পূর্ববাংলার লেখক ও শিল্পী মহলে প্রগতিশীল চেতনা সঞ্চারে পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। ‘প্রতিরোধ’ চেয়েছিল সারা বাংলার প্রবীণ-নবীন লেখকদের মাঝে সামাজিক দায়বদ্ধতার চেতনা সঞ্চার করতে, তাদের সচেতন করে তুলতে। পত্রিকায় কারা নিয়মিত লিখবেন, তাদের নামের একটি তালিকা প্রথম সংখ্যা ‘প্রতিরোধ’ মুদ্রিত হয়। বিজ্ঞাপিত লেখক তালিকায় ছিলেন ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হুমায়ুন কবীর, বুদ্ধদেব বসু অমিয় চক্রবর্তী, সমর সেন, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অজিত দত্ত, রণেশ কুমার দাশগুপ্ত, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, দক্ষিণারঞ্জন বসু, সুধী প্রধান বিনয় কুমার ঘোষ, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, হিরণকুমার সান্যাল, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, সুবোধ ঘোষ প্রমুখ। এঁদের মধ্যে দু’তিনজন ছাড়া বাকি সবাই ‘প্রতিরোধ’ প্রতিকার কোনো না কোনো সংখ্যায় লিখেছেন। এছাড়াও যাদের লেখা ‘প্রতিরোধ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সোমেন চন্দ্র, সরদার ফজলুল করিম, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, অমৃতকুমার দত্ত, সরলানন্দ সেন, মুনীর চৌধুরী, গোপাল ভৌমিক, লীলাময় রায় (অন্নদাশশঙ্কর রায়), গোপাল হালদার, নবেন্দু ঘোষ, সন্তোষকুমার ঘোষ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, জীবানানন্দ দাশ, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ। প্রথম দু’বছর নিয়মিত প্রকাশের পর ১৯৪৪-এর শুরু থেকে ‘প্রতিরোধ’ প্রকাশ অনিয়মিত হয়ে পড়ে। এর আগেই ১৯৪৩ থেকে যুদ্ধের ফলে কাগজের দুর্মূল্য ও দুষ্প্রাপ্তির কারণে ‘প্রতিরোধ’ পাক্ষিকের পরিবর্তে মাসিক পত্রিকারূপে প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪৪-এর প্রথম থেকেই ঢাকা শহরে ব্যাপকভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। এ সময় লেখক সঙ্ঘের কর্মীরা দাঙ্গা প্রতিরোধেই সর্বশক্তি নিয়োজিত করেন, ফলে পত্রিকা প্রকাশ অনিয়মিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ১৯৪৪ সালের জুলাই থেকে ‘প্রতিরোধ’ প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়।
ঢাকার প্রগতি লেখক সঙ্ঘের কর্মকা- আলোচনা প্রসঙ্গে প্রতিরোধ পাবলিশার্সের কথাও উল্লেখ করতে হয়। প্রগতি লেখক সঙ্ঘের কর্মীরাই প্রতিষ্ঠা করেন ‘প্রতিরোধ পাবলিশার্স’ প্রতিরোধ পাবলিশার্স থেকে প্রথম দিকে যে সব গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, সেগুলো হচ্ছে-১. ক্লান্তি (সম্পাদক রণেশ দাশগুপ্ত), ২. সঙ্কেত ও অন্যান্য গল্প (সোমেন চন্দ্র), ৩. সাম্যবাদের ভূমিকা (অনিল মুখার্জী), ৪. মাও সে তুঙ (সরলানন্দ সেন), ৫. নতুন আঁচড় (কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত), ৬. কয়েকটি পাতা (অমৃতকুমার দত্ত), ৭. গণসঙ্গীত (সত্যেন সেন), ৮. গণসঙ্গীত (সাধন দাশগুপ্ত), ৯. সোভিয়েতের কয়েকটি গল্প (অনুবাদক : নৃপেন্দ্র চন্দ্র গোস্বামী) প্রভৃতি।
৪.
ঢাকা জেলা প্রগতি লেখক সঙ্ঘের এক যুগের ইতিহাস গৌরবোজ্জ্বল কীর্তিতে ভাস্বর। পূর্ববাংলায় বিশেষত ঢাকা শহরে আজ থেকে পঁচাত্তর বছর পূর্বের এই সংগঠনের ইতিহাস-বিন্যাস বস্তুত আমাদেরই পূর্বসূরি প্রগতিবাদী সাহিত্যকর্মীদের কর্মকাণ্ডের পরিচয় অনুসন্ধান, পূর্ববাংলায় প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা বিকাশের শিকড় অন্বেষা। বর্তমান আলোচনায় আমরা সেই পরিচয় অনুসন্ধান ও শিকড় অন্বেষায় প্রয়াসী হয়েছি।