মহান আল্লাহ মুমিনদের পরীক্ষা করেন ভয়-ভীতি, খাদ্যাভাব এবং জান, মাল ও শস্য-ফসলের সামান্য ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে (দ্র. আল-বাক্বারাহ, ২/১৫৫)। এই পরীক্ষাপদ্ধতি মহান আল্লাহর একটি চিরন্তন নীতি। এর মাধ্যমে তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে কে কোন পর্যায়ের তা পরখ করে দেখতে চান। এই পরীক্ষা বিভিন্নভাবে হতে পারে, যার অন্যতম হচ্ছে- প্রাকৃতিক দুর্যোগ। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বন্যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা আমাদের দেশে প্রায় প্রতি বছরই আঘাত হানে। দেশের নিম্নাঞ্চল সমূহ প্লাবিত হতে শুরু করেছিল। এর মধ্যে ভারত ফারাক্কাসহ অভিন্ন নদীর প্রায় সবগুলো বাঁধের স্লুইসগেট আকস্মিকভাবে খুলে দেয়ায় এই মুহূর্তে ডুবে গেছে বেশ কয়েকটি জেলা। এবার ভারতের বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে হঠাৎ করে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টিতে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে। বন্যা সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে ফেনীতে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, খাগড়াছড়ি এবং কক্সবাজার জেলা বন্যা-কবলিত হয়েছে। এসব জেলাগুলোতে বন্যায় এখন পর্যন্ত (শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত) ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। এতে জানানো হয়, বন্যা আক্রান্ত জেলার সংখ্যা ১১টি (ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মী পুর ও কক্সবাজার)। উপজেলা ৭৭ উপজেলা বন্যা প্লাবিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন/পৌরসভা ৫৮৯টি। ১১ জেলায় মোট ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৭৬৯ পরিবার পানি-বন্দি হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ২৯৯ জন, মারা গেছেন ১৫ জন। পুরুষ ১৩ জন, নারী ২ জন। মারা যাওয়ার মধ্যে কুমিল্লায় ৪, ফেনীতে ১, চট্টগ্রামে ৪, নোয়াখালীতে ১, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১, লক্ষ্মীপুরে ১ এবং কক্সবাজারে ৩ জন রয়েছেন। তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়েছে, পানি-বন্দি/ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় প্রদানের জন্য মোট ৩,১৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট ১ লাখ ১৫ হাজার ৩০ জন লোক এবং ১৮ হাজার ৯৬টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মোট ৬৩৯টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে। বন্যা আক্রান্ত জেলাসমূহের জেলা প্রশাসককে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বায়ক, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, মেডিকেল টিম ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে এক সঙ্গে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে সার্বক্ষণিক কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। তথ্য ও সহযোগিতার জন্য ০২৫৫১০১১১৫ নম্বর চালু রয়েছে। ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুর জেলার বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড ও বিজিবি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা এবং সচিব বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বন্যা উপদ্রুত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। উপদেষ্টা এখনও উপদ্রুত এলাকায় অবস্থান করছেন। শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বর্তমানে উপদ্রুত এলাকায় অবস্থান করছেন। মূলত ১৯৫৪ সাল থেকে এদেশে বন্যার দাপট শুরু হয়। তখন থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩২টি বড় ধরনের বন্যা আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ১৭টিকে মহাপ্রলয়ংকরী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয় ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে। বিশেষভাবে সিলেট অঞ্চলে ১৯৯৯, ২০০৪, ২০০৭, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ ইং সালে সিলেট, শুধু উল্লেখযোগ্য বন্যা হয়। তবে ২০২২-এর বন্যা ব্যতিক্রম; ১২২ বছরের ইতিহাসে সিলেট ও সুনামগঞ্জে এমন বন্যা হয়নি। এতে সিলেটের সাথে সড়ক, রেল ও আকাশপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। অতিরিক্ত দাবদাহে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা ভারতের চেরাপুঞ্জিতে এবার রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়। সেখানকার পানি সরাসরি বাংলাদেশের হাওড়ে এসে মিশে ভৈরব বা মেঘনা হয়ে সাগরে চলে যাওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে তা বাধাগ্রস্ত হয় এবং সিলেট বিভাগের সবকটি জেলায় প্রবেশ করে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে সিলেট বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে চলে যায়। প্লাবিত হয় উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা। এ বছর দেশের ১৮ জেলার প্রায় ৭৬ লাখ মানুষ বন্যার শিকার হয়েছে। এ বছরের বন্যায় বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। ২ লাখ ৭৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১৬ লাখ ঘর। বন্যায় মারা গেছে ১১৬ জন মানুষ। বহু গবাদি পশুও মারা গেছে এবং প্রায় ৮ লক্ষ গবাদি পশু আশ্রয় ও খাদ্য সংকটে ভুগছে। এ বছরের বন্যায় দেশে পৌনে ৬ লাখ শিক্ষার্থী বন্যাকবলিত, যাদের শিক্ষাকার্যক্রম দীর্ঘসময় ধরে বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রতিবছর বন্যার জন্য ভারত মোটেও দায় এড়াতে পারে না। বরং দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ ভারতের পানি আগ্রাসনের শিকার। আন্তর্জাতিক আইন, প্রতিবেশীর অধিকার সবকিছুকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাংলাদেশের ৫৪টি নদীর উৎসমুখে ফারাক্কা বাঁধ, টিপাইমুখ বাঁধসহ একাধিক বাঁধ ও ড্যাম নির্মাণ করে বাংলাদেশকে তিলে তিলে ধ্বংস করছে ভারত। বর্ষাকালে আমাদেরকে পানিতে ভাসিয়ে মারছে আর খরায় পানি আটকে দিয়ে বাংলাদেশকে মরুভূমি বানিয়ে দিচ্ছে। একসময় এদেশে ১২০০ নদীর কথা শোনা যেত, কিন্তু এখন ২০০ নদীও সচল নেই। সব শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। অনেকগুলোর চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায় না। ১৯৭১ সালের রেকর্ড অনুযায়ী ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ কমে এখন ৬ হাজার কিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি ধ্বংস হয়েছে। সেচের পানির অভাবে কোটি কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে জমির উর্বরাশক্তি কমে গেছে এবং পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের প্রায় ১৭ ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। ভারতের একপেশে নীতির কারণে আরো যে কত ক্ষতি আমাদের হয়েছে, তার হিসাব কয়জনে রাখে! মহান আল্লাহ আমাদেরকে যাবতীয় বালা-মুসিবত থেকে হেফাযত করুন। ফেনী-নোয়াখালীর কিছুকিছু এলাকায় টিনের ঘরের চাল এবং একতলা ভবন পর্যন্ত তলিয়ে যাওয়ার তথ্যচিত্র পাওয়া যাচ্ছে। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ এক নজিরবিহীন বন্যার সম্মুখীন হয়েছিল। এরপর প্রতিদশকেই বড় বন্যার অভিজ্ঞতা আমাদের থাকলেও এবারের বন্যা ৩৬ বছর আগের বন্যার কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশে বন্যার কারণ আন্তর্জাতিক নদী আইনের বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করে অভিন্ন নদীর উপর আধিপত্যবাদী ভারতের একতরফা বাঁধ নির্মাণ, যথেচ্ছ পানি প্রত্যাহার এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা প্রকল্প চালুর কথা বলে সেই ১৯৭৪ সালে একতরফা ফারাক্কা চালুর মধ্য দিয়ে ভারতের পানি আগ্রাসন শুরু হয়। এরপর একের পর এক প্রায় সবগুলো অভিন্ন নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করে ভারত। পানি নিয়ে ভারতের আধিপত্যবাদী মনোভাবের ফলে বাংলাদেশের নদণ্ডনদী, নৌপরিবহণ, প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, কৃষি অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। পতিত স্বৈরাচার হাসিনা রিজিমের সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশে ভারতের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার সম্ভাব্য সবকিছু বিনা বাক্যব্যয়ে আদায় করে নিলেও গঙ্গা ও তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিতে তারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল। ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেট ও চট্টগ্রামে চলমান ভয়াবহ বন্যার দুর্যোগ যতটা না প্রাকৃতিক, ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির আওতায় পানি আগ্রাসন তার চেয়ে বেশি দায়ী। দেড়মাস ধরে রাজপথে ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মুখে গত আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান, এমপি, মন্ত্রী ও প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় দেশে এক ধরনের স্থবিরতা ও অচলাবস্থা দেখা দিয়েছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার আগেই ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি নতুন সরকারের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। বন্যার্ত এলাকাগুলো এখনো ক্রমাবনতিশীল। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর দুর্ভোগে পড়ে উদ্ধার ও ত্রাণের অপেক্ষায় রয়েছে। খেতের ফসল, গোলার ধান-চাল, ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্পদ আকস্মিক বাণের পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পর নূন্যতম আশ্রয় ও খাদ্য-পানীয়ের চরম সংকটে পতিত হয়েছে তারা। সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে অবিরাম বৃষ্টিপাতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বন্যা দেখা দেয়ায় ফারাক্কাসহ উজানের বাঁধের সবগুলো স্লুইস গেট ছেড়ে দেয়ায় অভাবনীয় পানির তোড়ে অনেকগুলো বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ জনপদ পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যা উপদ্রুত এলাকাগুলো ইতোমধ্যে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও আশ্রয় নেয়ার মতো কোনো শুকনো বা উঁচু জায়গা নেই। বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় বন্যা উপদ্রুত সবচেয়ে খারাপ এলাকাগুলোর প্রকৃত অবস্থার তথ্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বন্যা উপদ্রুত এলাকায় মোবাইল ইন্টারনেট ফ্রি করে দেয়াড় ঘোষণা দিলেও বিদ্যুৎ না থাকায় তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বন্যায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বিকল্প ব্যবস্থায় তথ্য ও যোগাযোগ নেটওয়ার্ক চালু রাখার উদ্যোগ নেয়া আবশ্যক। সামগ্রিক অর্থে একটি ভগ্নস্তূপর উপর দাঁড়িয়ে দেশকে স্থিতিশীল করার প্রয়াস চালাচ্ছে সরকার। এহেন বাস্তবতায় এমন ভয়াবহ বন্যার দুর্যোগ নতুন সরকার ও দেশের মুক্তিকামী মানুষের সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের গুলিতে শত শত মানুষের মৃত্যুর রেশ কাটতে আরো অনেকদিন সময় লাগবে। এরইমধ্যে আকস্মিক বন্যায় বেশকিছু মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। শিশু-বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষগুলোকে যথাশীঘ্র উদ্ধার করে আশ্রয় ও প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করতে না পারলে আরো অনেক মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। জাতির এই ক্রান্তিকালে শুধু সরকারের পক্ষে এতবড় দুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে দেশের প্রত্যেক ধনী ও সামর্থ্যবান মানুষকে আর্ত মানবতার সেবায় এগিয়ে আসতে হবে। আটকে পড়া বন্যার্তদের উদ্ধার, আশ্রয় ও জরুরি খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী গণআন্দোলন পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। সেই ঐক্যকে কাজে লাগিয়ে জাতির সংকটকালীন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এই বন্যা শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এটি মানব সৃষ্ট দুর্যোগও বটে। এর পেছনে রয়েছে প্রতিবেশী দেশের আধিপত্যবাদী রাজনীতি। অতএব, এর ধারাবাহিকতায় আরো অনেক কিছু মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিতে হবে। খাদ্য মজুদ, খাদ্য নিরাপত্তা ও বাজার সিন্ডিকেটের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি এবং আকস্মিকভাবে ভারত থেকে চালসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য রপ্তানি বন্ধের মতো সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে আগেই বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সাগরে নিম্নচাপ ও বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেও বন্যার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। কুমিল্লা ও ফেনীর অস্বাভাবিক বন্যার পানি ঢাকাসহ মধ্যাঞ্চলে বিস্তৃত হলে এর প্রভাব সারাদেশেই পড়বে। আমাদের সবচেয়ে খারাপ আশঙ্কা মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। এখন দেশের স্থানীয় প্রশাসনে টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করছে। এহেন পরিস্থিতিতে যারা দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবেন, তাদেরকে জনগণ মনে রাখবে। এই মুহূর্তে পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি দেশের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডকে সর্বোচ্চ পরিষেবা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এই দুর্যোগকালে পতিত স্বৈরাচারের এজেন্টরা যেন দেশে পরিকল্পিত গোলযোগ সৃষ্টি করে ফায়দা হাসিলের ষড়যন্ত্র করতে না পারে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। এদিকে ভারতের ত্রিপুরায় বন্যার চাপ সামলাতে ১৯৯৩ সালের পরে ৩১ বছর পর এবার ত্রিপুরায় পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের ডুম্বুর বাঁধের সবকটি কপাট একযোগে খুলে দিয়ে বিনা নোটিশে ভারত পানি ছেড়ে দিয়েছে। এর ফলে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল আকস্মিক ও ভয়াল বন্যা কবলিত হয়েছে। যে কোন ভাটির দেশ যাতে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে, এর জন্য আগেভাগে জানিয়ে বাঁধ-ব্যারাজের পানি ছাড়াই আন্তর্জাতিক নিয়ম বা কনভেনশন। কিন্তু ভারত কখনোই সেই নিয়মের ধার ধারে না। যথেচ্ছ বাঁধ-ব্যারাজ খুলে পানি ছেড়ে দেয়। যা নেহায়েৎ অমানবিক। এতে করে ভাটিতে ভাসছে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী ভারতের এহেন নির্মম আচরণের প্রতিবাদে গত কয়েক দিন থেকে রাজধানী ঢাকা, রাজশাহীসহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ মিছিল করেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। ফাজিলপুর থেকে ফেনীর মধ্যবর্তী এবং কুমিল্লায় কয়েক জায়গায় রেললাইন ও রেলসেতু তীব্র ঢল-বানের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে করে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের ছুটি বাতিল করে সার্বক্ষণিক (স্ট্যান্ডবাই) বন্যা এলাকায় থাকার নির্দেশ দিয়েছে। তাছাড়া মাঠ প্রশাসনকেও বন্যার্তদের পাশে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকার বন্যা কবলিতদের জরুরি উদ্ধার ও শুকনো খাবার বিতরণের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর বিশেষ টিমও জরুরি ত্রাণ এবং উদ্ধার কার্যক্রমে সহায়তা করছে। এদিকে ভারতের সিকিমে তিস্তার সর্বোচ্চ উজানভাগে প্রচণ্ড- ঢল ও বন্যায় তিন দিন আগে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের একটি বাঁধ ধসে গেছে। এর ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষত রংপুর বিভাগ ফের বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানান, উত্তর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ এবং বর্ষার বাহক মৌসুমি বায়ুর সক্রিয় প্রভাবে দেশের অভ্যন্তরে এবং উত্তরপূর্ব ভারতে একযোগে অতি ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। আকস্মিক ও স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার এটি প্রধান কারণ। আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে, মাঝারি থেকে ভারী ও অতি ভারী বৃষ্টিপাত আরও অন্তত ৪৮ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে গতকাল জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৭টি নদণ্ডনদী ১৪টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে ফেনী নদী একটি পয়েন্টে, হালদা নদী দু’টি পয়েন্টে, গোমতী নদী দু’টি পয়েন্টে, কুশিয়ারা নদী ৪টি পয়েন্টে, মনু দু’টি পয়েন্টে, ধলাই একটি পয়েন্টে, খোয়াই দু’টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাছাড়া ফেনীর মুহুরি, কহুয়াসহ বিভিন্ন শাখা ও উপনদী, খাল বন্যায় ফুলে-ফুঁসে উঠেছে। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গতকাল দুপুরে এক তথ্য বিবরণীতে ৮ জেলায় ৪ লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে। এসব জেলায় প্রায় ২৯ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৮ জেলা বন্যা আক্রান্তের কথা জানালেও এখন পর্যন্ত তা ১১ জেলায় বিস্তার লাভ করেছে। এসব জেলার ৫৩টি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৬২টি ইউনিয়ন। তথ্য বিবরণীতে আবহাওয়া সংস্থাগুলোর বরাত দিয়ে বলা হয়, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও এর সংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসতে পারে। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদীগুলোর সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল থেকে পরবর্তী সময়ে উন্নতি হতে পারে। মন্ত্রণালয় জানায়, বন্যায় পানিবন্দি বা ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য মোট ১ হাজার ৫৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট ৭৫ হাজার ৬৬৮ জন লোক এবং ৭ হাজার ৪৫৯টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মোট ৪৪৪টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে। আর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণের জন্য মন্ত্রণালয় হতে এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৮২ লাখ নগদ টাকা ও ১৩ হাজার ৬০০ টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। ফেনী জেলায় বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী উদ্ধার কাজে নিয়োজিত রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রণালয় জানায়, সেনাবাহিনী থেকে ১৬০ জন সদস্য ৪০টি উদ্ধারকারী যান ফেনী জেলায় পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। নৌবাহিনীর ৭১ জন সদস্য ও আটটি উদ্ধারকারী যান কাজ করছে। যখন কলামটি লিখছে তখন ১৫ মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। পানি বন্দী মানুষ চরম দুর্ভোগে আছে। রান্না ঘরের চুলায় পানি ওঠায় রান্না-বান্না হয়নি অনেক পরিবারের। নিম্ন আয়ের মানুষের বিড়ম্বনা সীমাহীন পর্যায়ে রয়েছে। মোদ্দাকথা বাংলাদেশের বন্যা সংঘটনের জন্য দায়ী কারণগুলির মধ্যে রয়েছে নিম্ন উচ্চতাবিশিষ্ট ভূসংস্থান ভারি বৃষ্টিপাত হিমালয়ে তুষার গলন এবং হিমবাহের স্থানান্তর সংঘটন পলি সঞ্চয়নের ফলে নদণ্ডনদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া। বন্যার উপকারিতা আমাদের মাটির নিচে পানির পরিমাণ ঠিক মতো রাখতে হবে। বন্যা হলে তা রিচার্জ হয়। ফসল উৎপাদনে মাটির উর্বরতা কমে যায়। বন্যা হলে মাটিতে পলি পড়ে। মাটি রিচার্জ হতে বন্যার প্রয়োজন। তাই সীমিত বন্যার প্রয়োজন রয়েছে।”আবার বন্যার পানি রাস্তা ঘাটের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে দেয়। পানি বাড়তে নিলেই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলতে হবে। গবাদিপশুদের নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হবে। বন্যায় পানিবাহিত রোগ যেন না ছড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বন্যায় ভোগান্তি ঠেকানোর উপায় নেই কিন্তু ভোগান্তি কমানোর সুযোগ আছে। যার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ জরুরি। আশ্রয়কেন্দ্র বন্যার সময়ে অবধারিত স্থান কিন্তু ভুক্তভোগীদের তুলনায় সেই সংখ্যাও কম। করোনার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মানা জরুরি। সব কিছু বিবেচনা করে আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বোপরি বন্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারি, বেসরকারি, স্বেচ্ছাসেবী সবার এগিয়ে আসার পাশাপাশি বিত্তবানদের এগিয়ে আসা জরুরি। কারণ মানুষ মানুষের জন্য আর জীবন জীবনের জন্য।
লেখক: মো. হায়দার আলী; সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিষ্ট।