মহান ও নিবেদিত পেশা হিসেবে শিক্ষকতা সর্বজন স্বীকৃত। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেই মনে করা হয় শিক্ষকদের। পাঠদানে আত্ম-নিয়োগ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিহিত থাকা সুপ্ত মেধা জাগ্রত করা, দুঃস্থ ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিজের অর্থ ব্যয়ে দেশ সেরা হিসেবে গড়ে তোলা শিক্ষকও দেশে বিরল নয়। এ জন্যই সমাজে শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি সম্মানিত, শিক্ষার্থীরাও যুগে যুগে স্মরণ রাখেন তাদের। একটি জাতির অগ্রগতি কিংবা উন্নতির প্রধান সোপান হলো শিক্ষা। শিক্ষার ওপর নির্ভর করেই সে জাঁতি গড়ে ওঠে। তাই বলা হয়, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদ-।’ এজন্য বিশিষ্টজনেরা বলেন, একটি জাতিকে ধ্বংস করতে হলে সে জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে আগে ধ্বংস করতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ বা জাতির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে তাদের অগ্রগতির পেছনে শক্তি হিসেবে শুধু অস্ত্র-সমারস্ত্র কাজ করেনি; বরং কাজ করেছে তাদের শিক্ষাদীক্ষা। আর এই শিক্ষা শব্দটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে শিক্ষকতা নামক মহান পেশা। আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থা তিন স্তরবিশিষ্ট। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় স্তর। দেশের সকল প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ বা সরকারি করা হয়েছে। গত বছর গুলিতে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে ব্যানার, পোস্টার নিয়ে তাঁরা আন্দোলন করছেন। যে যুক্তি দাঁড় করিয়ে তাঁরা আন্দোলন করছেন, সেগুলোকে তাঁরা ন্যায্য অধিকার হিসেবে মনে করছেন। তাদের দাবির সাথে সহমত প্রকাশ করে শিক্ষাবিদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ। কিন্তু অবস্থার কোন উন্নতি হয় নি। সবই ছিল পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী, স্বৈরাচারী শেখ হসিনা ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী, বর্তমানে রিমান্ডে ডা. দিপু মনির নাটক। বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে স্কুলে তালা ঝুলিয়ে গত বছর ১১ জুলাই থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন এমপিও শিক্ষকরা। কর্মসূচির শুরুর পর পুলিশ শিক্ষকদের লাঠিচার্জ করে সরিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করে। তারপরও শিক্ষকরা কর্মসূচিতে অনড় থাকেন। এর মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি তাদের সঙ্গে বৈঠক করে ক্লাসে ফেরার আহ্বান জানালেও তাতে সাড়া দেননি শিক্ষকরা। টানা ২১ দিন অবস্থান কর্মসূচির পর ১ আগস্ট থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করেন শিক্ষকরা। ঘোষণা অনুযায়ী- ১ আগস্ট কাফনের কাপড় পরে অনশন করেন তারা। ওইদিন রাতে রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের সঙ্গে বৈঠকে বসেন শিক্ষক নেতারা। বৈঠকে শিক্ষকদের জাতীয়করণ বা বৈষম্য নিরসনের আশ্বাসে অনশন স্থগিত করে ক্লাসে ফেরার ঘোষণা দেন বাংলাদেশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) নেতারা। তারা গত বছর (২ আগস্ট) মধ্যে শিক্ষকদের ঢাকা থেকে এলাকায় ফেরার এবং বৃহস্পতিবার থেকে পুরোদমে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দেন। ঘোষণা অনুযায়ী তারা ক্লাসও করছেন। এ আন্দোলনের ফসল হিসেবে বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২ টি কমিটি গঠন করা হয়েছে, কর্মশালা হয়েছে, ৫% প্রণোদনা প্রদান করা হচ্ছে, এবারই প্রথম দেশে সরকারিভাবে সরকারি খরচে শিক্ষক দিবস পালন হতে যাচ্ছে, কিন্তু বেসরকারি শিক্ষকদের ভাগ্যে কোন পরিবর্তন হয় নি। সরকার আসে সরকার যায় কিন্তু বেসরকারি শিক্ষকদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন নাহি হয়। চিহ্নিত কিছু দালাল শিক্ষক নেতা হয়েছেন যারা শিক্ষকদের ১০% কর্তনকৃত টাকা লুটপাট করে নিজের পকেট মোটা করেন। নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য বাড়ি গাড়ি করেন, বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন। আর অবসর গ্রহণের পর শিক্ষক কর্মচারীগণ বছরের পর বছর অপেক্ষা করেন কিন্তু উৎকোচ দেয়ার পরেও অবসর কল্যাণের টাকা পান না। ওই সব টাকা না পেয়ে কেউ কেউ চিকিৎসা, খাদ্যাভাবে মৃত্যু বরন করেন। বেসরকারি শিক্ষক সমাজ কতটা অবহেলিত তা সহজে অনুমান করা যায়। জাতীয়করণ ছাড়া শিক্ষার মান উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভাব নয়। বেসরকারি শিক্ষক সমাজ সিকিভাগ ইদ বোনাস পায়, সরকারি স্কুল, কলেজ মাদ্রাসা, অন্য সব সরকারি বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তা, কর্মচারীগণ পূর্ণাঙ্গ ইদ বোনাস পেয়ে থাকেন। তারা বেতনের সময় বোনাস পেয়ে থাকেন। আর বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ ছাড়া কিছুই নেই। বিশ্বের এমন কোন দেশে নেই যেখানে এটা করা হয়। বেসরকারি শিক্ষক সমাজের জন্য এটা জাতীয় লজ্জা। পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বাড়িভাড়া ৪৫/৫০ ভাগ, মেডিকেল সরকারিদের মত দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টা পরিষদের সকল সদস্যগণকে ধন্যবাদ জানাবে, আনন্দ মিছিল করবেন, ওঁর জন্য জায়নামাজে দাঁড়িয়ে দোয়া করবেন। বিগত দিনে দালাল কিছু আমলা, মন্ত্রী, এমপি', পা চাঁটা, তেলবাজ নেতা যাদের কারণে বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক কর্মচারীগণ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বছরের পর বছর বঞ্চিত হচ্ছেন। ওইসব তেলবাজ পা চাঁটা ব্যক্তিত্বহীন লোকগুলি শিক্ষক সমাজের কাছে সারাজীবন মীরজাফর ও ঘোষটি বেগম হয়ে থাকবেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে সর্বমোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৫ হাজার ৫৬৫ টি। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা: ৬৮৪ টি। সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের সংখ্যা: ৬৩ টি। সরকারি কলেজের সংখ্যা: ৫৪ টি, সরকারি ডিগ্রি (পাস), অনার্স কলেজের সংখ্যা: ৪৪৬ টি। সরকারি স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) কলেজের সংখ্যা: ১৯৮ টি এবং সরকারি স্নাতকোত্তর (কামিল) মাদ্রাসার সংখ্যা : ০৩ টি। দেশে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২০ হাজার ৯৬০ টি। বিপরীতে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৬৮৪ টি। সরকারি-বেসরকারি মিলে মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ। শিক্ষক প্রায় সাড়ে ৫ লাখ। ৯৭ ভাগ শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়া-লিখা করে।। মাধ্যমিক শিক্ষকদের যে বেতন-ভাতা, তা দিয়ে দ্রব্যমূল্যের অগ্নি বাজারে পরিবার চালানো বেশ কষ্টসাধ্য। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বেতনের ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা, ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া এবং ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। একই কারিকুলামের অধীনে থেকেও সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বিশাল বৈষম্য। দেশের ৯৭ ভাগ শিক্ষার্থীগণকে পাঠদানকারী শিক্ষক কর্মচারীরা বর্তমানে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। তাদের দৈন্যদশায় রেখে শিক্ষার বাস্তব উন্নয়ন কোনোভাবে সম্ভাব নয়। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এখান থেকে বেরিয়ে বেসরকারি শিক্ষকদের অর্থনৈতিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতেই হবে। শিক্ষাকে জাতির মেরুদন্ড আর শিক্ষকরা সেই মেরুদ-ের রূপকার। তাদের শেখানো পাঠ-পঠনে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীরা। মুখে ‘শিক্ষকতা মহান পেশা’ স্বীকার করে শিক্ষকদেরও যে সংসার আছে, মৌলিক চাহিদা আছে, সেদিকে তাকানোর সময় হয় নি কোন সরকার বাহাদুরের। জাতীয়করণের ব্যাপারে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি প্রায় বলে থাকেন এটা ব্যাপক গবেষণার ব্যাপার। ওই সব শিক্ষকদের ব্যাপারে অসত্য, বিভ্রাট কথা বলতেন তিনি। বাংলাদেশের শিক্ষা জাতীয়করণ নিয়ে আলোচনা-আন্দোলন-গবেষণা বহুদিনের। দিনে দিনে তা কেবল জটিল হচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষকরা সেই সরকারি তিরিশ টাকা অনুদান দিয়ে শুরু করে আজ মূল বেতনের একশ’ ভাগ সরকারি কোষাগার থেকে পাচ্ছেন। ১০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া, ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, স্কেলের সিকি ভাগ ইদ বোনাস এটিও সহজে হয়নি, কোনো সরকার ইচ্ছে করেই এটি দিয়ে দেয়নি। এটি শিক্ষকদের বহুদিনের আন্দোলনের ফসল। দেশে প্রাইমারি শিক্ষা জাতীয়করণের গোড়া পত্তন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। তখন আমাদের জিডিপির আকার ছিল প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার, এখন তা ৫০০ বিলিয়নের ওপর। বহু বছর ধরে মাত্র ৩১৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল সরকারি। সরকার যে-সব উপজেলায় সরকারি বিদ্যালয় ছিল না সেগুলোকে সরকারি ঘোষণা করায় বর্তমানে সংখ্যাটি ৬৮৪। অর্থাৎ এগুলোর পুরো দায়দায়িত্ব সরকারের, বাকি প্রায় বিশ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয় বেসরকারি। মাধ্যমিক পর্যায়ের আরো ৯ হাজারের মতো মাদ্রাসাও রয়েছে। দেশের শিক্ষার দায়িত্ব সরকারের। অথচ দেখা যায়, ১৬ বছর ক্ষমতায় থেকে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার এমন কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকারি করেছেন যেগুলি তার বাপ, মা, ভাইয়ের নামে ওই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সরকারি করার কোন যোগ্যতা নেই। অথচ করা হয়েছে। মন্ত্রী এমপি কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে নিজের খেয়াল খুশিমতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারীকরণ করেছেন। এলাকার কোনো প্রভাবশালী নেতা তার এলাকার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার অবস্থা যতই খারাপ থাকুক না কেন জাতীয়করণ করে ফেলেছেন। তা আরেক ধরনের ব্যাপক বৈষম্য তৈরি করেছে। গ্রামীণ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বেশি অবহেলার শিকার। এগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়, নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষক নেই। ভালো শিক্ষকরা সেখানে যেতেও চান না। জাতীয়করণ করা হলে অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীর শিক্ষার অধিকার ও মান নিশ্চিত সম্ভব হবে বলে একটি মত রয়েছে। আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণের অন্তরায়। যতদিন পর্যন্ত একটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ হতে ৩৫ এ সীমাবদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হবো ততদিন আমরা শিক্ষার শতভাগ সুফল পাবো না। শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ না করে দুই বা ততোধিক শাখায় পাঠদানের ফলেও শিক্ষার মান ক্রমশ নিম্নগামী হচ্ছে। দেশে প্রচলিত কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইংরেজি ভার্সনের উপর সরকারের যথাযথ নিয়ন্ত্রণ নেই। এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল কারিকুলামের বাইরে গিয়ে স্বেচ্ছাধীনভাবে অতিরিক্ত বিষয়ের পাঠদান করে শিক্ষার্থীদের মেধা-মনন নষ্ট করছে। উপরন্তু বাজারের গাইড বইগুলো শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল প্রতিভার প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দেখভালের দায়িত্ব কখনো রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের উপর কখনো স্থানীয় সমাজপতিদের উপর দেয়ার কারণে সঠিক তত্ত্বাবধান ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা বাঞ্ছনীয়। শিক্ষকদের জীবনমানের বৈষম্যের অবসান না ঘটিয়ে শিক্ষার উন্নয়ন কী একটি তথাকথিত নতুন কারিকুলাম শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকের উপর চাপিয়ে দিয়ে শিক্ষার উন্নয়ন করে সম্ভব? মোটেই সম্ভাব নয়। আমরা ভুলে যাই, মায়ের পুষ্টি সাধন নিশ্চিত না করলে, শিশু অপুষ্টির শিকার হবে। হচ্ছেও তাই। এই বৈষম্যের কারণে শিক্ষকতায় মেধাবীরা আসছে না। বৈষম্য বিনাশ না হলে এ জাঁতি মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। তাকে নির্ভর করতে হবে অন্যের ওপর। আর আমাদের শিশুদের নিয়ে চলতে থাকবে নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যেখানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমগাছ চট্টগ্রামে রোপণ করলে ফলের গুণাগুণ বজায় থাকে না, সেখানে আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা কীভাবে ভাবলেন, ইউরোপ আমেরিকার শিক্ষা পদ্ধতি আমাদের দেশে খুব সহজেই খাপ খাইয়ে নেবে। তাছাড়া জমিতে ভালোভাবে চাষাবাদ না দিয়ে ফসল রোপণ করে ভালো ফসল আশা করা দিবা স্বপ্নের নামান্তর। যতদিন নীতি-নির্ধারকগণ শিক্ষাকে উত্তম বিনিয়োগ মনে করবেন না, ততদিন শিক্ষার বেহাল দশা কাটবে না। আমরা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার তাগিদে মাতৃভাষার পুষ্টি সাধন না করে বিদেশি ভাষা চর্চায় ব্যস্ত আছি, যা আমাদের মেরু-অস্থির ক্ষয় সাধন করছে। শিক্ষা যে আমাদের মৌলিক অধিকার, এটি প্রায়শই উপেক্ষিত। শিক্ষাকে সর্বজনীনভাবে গড়ে তুলতে না পারলে জাতীয় উন্নয়ন সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে হবে না। রুচিশীল জাঁতি গঠনের জন্য দৃশ্যমান উন্নয়নের চেয়ে মনোজাগতিক উন্নয়ন বেশি প্রয়োজন, আমাদের তা বুঝতে হবে। শিক্ষা উপেক্ষিত হলে আমাদের পাশ্চাত্যের দাস হয়ে কাল কাটাতে হবে। এক হিসাব বলছে, দেশের ৩০ হাজার প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলে সরকারের অতিরিক্ত এক হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে আন্দোলনের সময় প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের চেয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের স্কেল অনুযায়ী শতভাগ বেতন প্রদান এবং অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়টিই বেশি গুরুত্ব পায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে (২০০৯-১৪) সরকার গঠন করলে এমপিওভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে এবং জাতীয়করণ করা হলে সরকারের অতিরিক্ত ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এসব হিসাব আলোচনাতেই থেকেছে। সমস্যার সমাধান হয়নি। হিসাবের নিষ্পত্তিও হয়নি। বিভিন্ন সময় আন্দোলনে আরো নানান কথা যোগ হয়েছে। আন্দোলনকারীরা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করে কোনো সাফল্যের নিশানা না দেখে এখন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেই পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আসে। এ রকম সময়ে আকস্মিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করে দেয়া হয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষকরা একে তাদের আন্দোলন মাঠে মার খাওয়ানোর অভিসন্ধি বলে ভাবছেন। একপর্যায়ে শিক্ষামন্ত্রী এ সময়ে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিকে অযৌক্তিক-অবাস্তব বলেও মন্তব্য করেছেন, যা প্রকারান্তরে গত বছর ১১ জুলাই থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের বাড়তি আঘাত দেয়া। এমনিতেই বাংলাদেশের শিক্ষাখাত অনেকটা মুমূর্ষু। এখন সমন্বিত একমুখী শিক্ষাক্রম দিয়ে একে মারার সাঁড়াশি পর্ব চলছে। কিন্তু এর পক্ষে আনন্দদায়ক, পরীক্ষামুক্ত, হাতেকলমে, সকল বিষয়ে জানা, কর্মমুখী, বৈশ্বিক চাহিদা, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ইত্যাদি যে-সব গালভারি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল, সেগুলোই হলো সেই দাওয়াই, যার চমক-ধাঁধা দেখিয়ে দেখিয়ে রোগীর কংকাল-হাড্ডি আরো উন্মুক্ত করা হয়েছিল! শিক্ষার যে আক্ষরিক অথবা অন্তর্নিহিত অর্থ তা আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অপ্রতুল। যে কোনো শিশুর বেড়ে ওঠার পথপরিক্রমায় সামাজিকীকরণে যে কয়টি প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেগুলোর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত। সেখানে এখনো কর্মমুখী শিক্ষা অনুপস্থিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জীবনের চলার পথে কী কী প্রয়োজনে এবং সেগুলো কীভাবে করতে হবে তা শেখানোর ব্যবস্থা নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কেবল পড়তে, লিখতে বা হিসাব করতে শেখা পর্যন্ত সীমিত রাখায় কর্মমুখী শিক্ষার দিকটি অগ্রাহ্যই থেকে যাচ্ছে। দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য রান্না-বান্না, ট্র্যাফিক রুলস, প্রাথমিক চিকিৎসা, আত্মরক্ষা, ঘরদোর গোছানো, জামা-কাপড় কাচা, নৈতিক শিক্ষা, খেলাধুলা, সঙ্গীত, নৃত্য, সাঁতারসহ নিত্য জরুরি পর্বগুলো এখানে অনুপস্থিত। শিক্ষার এই ফাঁকা ব্যবস্থা জাতির মেরুদন্ডকে মোটেই পোক্ত করছে না। বাংলাদেশি নাগরিকদের শিক্ষার প্রতি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বগুলো বর্ণনা করা হয়েছে সংবিধানে। সেসব বিবেচনা করে রাষ্ট্র শিক্ষকদের দিকে তাকিয়ে তাঁদের অধিকার, দাবিদাওয়ার বিষয়টি আরও গুরুত্বসহকারে দেখে সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে দ্রুত শিক্ষা জাতীয়করণের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এমন প্রত্যাশা রইল। শুধু দেশই নয় বরং সারাবিশ্বে ড. মোহম্মদ ইউনুসের গ্রহণযোগ্যতা অপরিসীম। আশাকরি দেশের সর্বস্তরের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সক্ষম হবে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সকল ধরনের অসংগতি নিরসন এবং একটি গ্রহণযোগ্য ও জনসমর্থিত শিক্ষা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত হবে বলে দেশবাসীর দৃঢ় বিশ্বাস। উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরা প্রত্যেকেই যোগ্য ও উচ্চ মেধার অধিকারী, তাদের নেতৃত্বে দেশ নতুন আঙ্গিকে সজ্জিত হবে। সকল বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে পাহাড়সম বৈষম্য দূর করতে পারেন, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী, শিক্ষক থেকে দেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস আর এ সাহসী পদক্ষেপটি ঘোষণার অপেক্ষায় বেসরকারি শিক্ষক সমাজ তীর্থের কাকের ন্যয় চেয়ে আছেন।
লেখক: মো. হায়দার আলী
সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিষ্ট