দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বা আইটি খাতে উন্নয়নের গল্প শোনানো হলেও প্রকৃতপক্ষে এই খাতে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে টানা কয়েকদিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ভাবমূর্তিরও সংকটে পড়েছে এই খাত। ফ্রিল্যান্সার ও উদ্যোক্তারা বলছেন, ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। আগামীতে যেন এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সরকারের কাছে সেই প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান খাত সংশ্লিষ্টদের। উদ্যোক্তারা জানান, টানা পাঁচদিন ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন থাকায় বিদেশি গ্রাহকদের অর্ডারের বিপরীতে দেয়া যায়নি ডেলিভারি। তাতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। সঠিক সময়ে সাড়া দিতে না পেরে গ্রাহকের নেগেটিভ রিভিউয়ে মার্কেটপ্লেসে রেটিং কমেছে অনেক ফ্রিল্যান্সারের। কিভাবে ধকল কাটিয়ে উঠবেন সেই দুশ্চিন্তায় আছেন তারা। জানা যায়, বর্তমানে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং, সফটওয়্যার তৈরি ও ডিজাইনসহ নানামুখী কাজে যুক্ত প্রায় ৩ লাখ মানুষ। এ খাত থেকে বছরে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় কমবেশি ২শ’ কোটি ডলার। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিস -বেসিসের তথ্য অনুযায়ী, ইন্টারনেটের না থাকায় শুধু সফটওয়্যার রপ্তানিতে ক্ষতি প্রায় ৫শ কোটি টাকা। এজন্য বেসিস সংশ্লিষ্টরা নিরাপদ ইন্টারনেট নিশ্চিত করারর কথা বলছেন। তাদের দাবি, বিদেশের ক্যাবল কাটা গেলেও দেশের ভেতরে বাণিজ্য বন্ধ হবে না, প্রিপেইড মিটার বন্ধ হবে না, ই-কমার্স বন্ধ হবে না -এমন নেটওয়ার্ক ডিজাইন নিরাপদ ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে হবে। এদিকে আউটসোর্সিংয়ের সমস্যার পাশাপাশি দেশের আইটি পণ্য রপ্তানিও কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত টেলিযোগাযোগ, কম্পিউটার ও তথ্যসেবা অর্থাৎ আইসিটি সেবা রপ্তানির পরিমাণ ৫৩১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার; যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ২ শতাংশ কম ছিল। আইটি পণ্য রপ্তানির বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে এ খাতে আয় চলতি অর্থবছরেও কমতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ বড় বড় আইটি প্রতিষ্ঠান তৈরিতে ব্যর্থ হওয়ায় তা সরকারের রপ্তানি বহুমুখীকরণ প্রচেষ্টার জন্য অশনিসংকেত। দেশের আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে অন্য খাত থেকে। এ খাত থেকে আয় কমার কারণ চিহ্নিত করে বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলেন, সফটওয়্যার সেবায় নেতিবাচক পরিস্থিতি খারাপ সংকেত। ডলারের বেশি দাম হওয়ায় রপ্তানিকারকরা লাভবান হচ্ছেন। গত দুই বছরে ডলারের দাম ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। রিজার্ভ ক্রমাগত কমতে থাকায় টাকা আরও দুর্বল হতে পারে এমন আশঙ্কায় রপ্তানিকারকদের অনেকে তাদের আয় দেশে আনছেন না। এদিকে দেশি আইটি প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত স্টার্টআপগুলোর সঙ্গে কাজ করে। কারণ তাদের সস্তায় আউটসোর্সিংয়ের প্রতি ঝোঁক বেশি। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে স্টার্টআপগুলো তহবিল পেতে সমস্যায় পড়ছে। ফলে, তারা নতুন প্রযুক্তি পণ্যের আপগ্রেড বা প্রসার বন্ধ করে দিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা সায়েন্স ও ব্লকচেইনের মতো উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব আইটি পণ্য রপ্তানি কমার আরেক কারণ। এদিকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের অগ্রগতির সূচকে প্রতিবেশীসহ সমমানের অর্থনীতির দেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) গত জুন মাসেআইসিটি ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স (আইডিআই) ২০২৪ প্রকাশ করে। সূচকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৭০ দেশের আইসিটি পরিষেবার অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়। ২০২২ সালে সংগ্রহ করা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সূচকটি করা। আইডিআই ২০২৪-এ ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ৬২। গত ডিসেম্বরে আইডিআই ২০২৩ প্রকাশিত হয়। এতে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৬১ দশমিক ১। অর্থাৎ বাংলাদেশের সামান্য অগ্রগতি হয়েছে। সূচকে মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভিয়েতনাম, ভুটানের চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। প্রতিবেশীদের মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তান কিছুটা পিছিয়ে। সূচকে ভারতের তথ্য নেই। এবারের সূচকে বৈশ্বিক গড় স্কোর ৭৪ দশমিক ৮। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের গড় স্কোর ৬৪ দশমিক ৮। বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় পড়েছে। সে হিসেবে বৈশ্বিক গড় ও নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের গড় স্কোর থেকে বাংলাদেশ পিছিয়ে। সূচকে ১০টি নির্দেশকের মধ্যে ৭টিতেই বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের গড় স্কোরের চেয়ে পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে মোবাইল নেটওয়ার্ক কাভারেজে (থ্রি-জি ও ফোর-জি)। এ ছাড়া মোবাইল ইন্টারনেট ট্রাফিক সাবস্ক্রিপশনে (জিবি) নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর গড় সূচকের চেয়ে বাংলাদেশ ভালো করেছে। তবে এশিয়া প্যাসিফিকের চেয়ে পিছিয়ে আছে। আইডিআই সূচকে মূলত ‘সর্বজনীন সংযোগ’ ও ‘অর্থবহ সংযোগ’-এই দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সর্বজনীন সংযোগে মানুষ, পরিবার, কমিউনিটি ও ব্যবসা সংযুক্ত। সর্বজনীন সংযোগে বাংলাদেশের স্কোর ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ। সর্বজনীন সংযোগের তিনটি নির্দেশক হলো ব্যক্তির ইন্টারনেট ব্যবহার, পরিবারে ইন্টারনেট ব্যবহার ও প্রতি ১০০ জনের মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। এই তিনটিতেই বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে।