প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে পরিচিত পাখি শকুন। বর্তমান বিশ্বব্যাপি পাখিটি মহাবিপন্ন বলে চিহ্নিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপি মহাবিপন্ন এবং বর্তমানে এদেশের অতি বিরল পাখিটি নাম রাজ শকুন। সারা বিশ্বে শকুন বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার পালন করা হয় আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস। লাখ লাখ বছর ধরে শকুন প্রকৃতি থেকে মরদেহ সরানোর কাজ করে রোগব্যাধি-মুক্ত পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমাদের প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা পালনকারী শকুনের অস্তিত্ব আজ বিপন্নপ্রায়। শকুন মৃত প্রাণীর মাংস খেয়ে বেঁচে থাকা একপ্রকার পাখি। প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী বলা হয় শকুনকে। প্রকৃতির সমস্ত বাসি, পচা, দুর্গন্ধযুক্ত মরা প্রাণীদের দেহ ওরাই খেয়ে পরিষ্কার করে ফেলে। রোগমুক্ত রাখে মানুষ এবং সমাজকে। প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে পরিচিত পাখি শকুন। প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করা বর্জ্যভুক প্রাণী শকুন। এটি শুধু প্রকৃতিকে পরিষ্কারই রাখে না, জীবাণুমুক্তও রাখে। মৃত প্রাণীর মাংস খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে শকুন। বিভিন্ন রোগের জীবাণু যেমন অ্যানথ্রাক্স, যক্ষèা রোগের সংক্রমণসহ অন্তত ৪০টি রোগের ঝুঁকি থেকে মানুষ ও পশু-পাখিকে রক্ষা করে। শকুন আকাশে উড়ে বেড়ানোর সময় নিচের সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পায় বলে প্রাণীর মৃতদেহ দেখে নেমে আসে। একদল শকুন মাত্র ২০ মিনিটে একটি গরুর মরদেহ খেয়ে শেষ করে দিতে পারে। প্রকৃতির এক উপকারী প্রাণী শকুন। এর শুদ্ধ নাম বাংলা শকুন। শকুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিবিশিষ্ট এক ধরনের শিকারি পাখি। ভৌগোলিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে শকুনকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। পুরাতন বিশ্বের দেশগুলো যেমন, ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার অবস্থিত শকুনগুলো অ্যাক্সিপিটারডাই পরিবারের অন্তর্গত। ঈগল, চিল এবং বাজপাখিও পুরাতন বিশ্বের শকুন প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। আরেকটি হল নতুন পৃথিবীর শকুন, যা ক্যাথারটিডি পরিবারের অন্তর্গত, আমেরিকার উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে অবস্থিত ওল্ড ওয়ার্ল্ড এবং নিউ ওয়ার্ল্ড শকুন একই বংশ এর অন্তর্গত না হলেও অভিন্ন বিবর্তন দ্বারা দুটি গোষ্ঠীকে চেহারায় আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। সারা বিশ্বে প্রায় ১৮ প্রজাতির শকুন দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রায় ছয় প্রজাতির শকুন রয়েছে। চার প্রজাতি স্থায়ী আর দুই প্রজাতি পরিযায়ী। এগুলো হলো-রাজ শকুন, গ্রিফন শকুন বা ইউরেশীয় শকুন, হিমালয়ী শকুন, সরু ঠোঁট শকুন, কালা শকুন ও ধলা শকুন। সব প্রজাতির শকুনই সারা বিশ্বে বিপন্ন। স্থায়ী প্রজাতির মধ্যে রাজ শকুন অতি বিপন্ন। ভারতীয় উপমহাদেশে এ রকম ছোট ছোট উদ্যোগে এখনো প্রায় ১১ হাজার শকুন টিকে আছে। আশির দশকে এ অঞ্চলে শকুন ছিল প্রায় চার কোটি। মাত্র দুই দশকে শকুন হারিয়ে গেছে ৯৯ ভাগ। এখন বেশির ভাগ বাংলা শকুন টিকে আছে ভারতে। বাংলাদেশে আছে মাত্র ২৬০টি। আইইউসিএনের জরিপে দেখা গেছে, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে পরিযায়ীসহ মোট শকুনের সংখ্যা ছিল ১০ লাখ। ২০১২ সালে তা মাত্র ৫৫০টিতে নেমে আসে। ২০১৬ সালে দেশে শকুন দেখা যায় ২৪০টি। ২০১৮ সালের বন বিভাগ ও আইইউসিএনের সর্বশেষ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে শকুন দেখা গেছে ২৬০টি। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের হিসাব মতে, ২০০৮ সালে শকুনের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৯৭২টি, যা সর্বশেষ ২০১৬ সালে নেমে এসেছে ২৬০টিতে। ৯৯ শতাংশ শকুন বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। শকুন নিয়ে দুটি জরিপের বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, এক হাজার ৭১২টি শকুন বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। ১৯৯০ দশকের গোড়ার দিক থেকে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালসহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় শকুন ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। একইভাবে আফ্রিকা এবং ইউরেশিয়ায় শকুন বিপন্ন। কৃষিতে অতিমাত্রায় কীটনাশক, ইঁদুর ও পোকামাকড় জাতীয় জীবজন্তু মারার জন্য বিষ মিশ্রিত খাদ্য প্রয়োগ, বায়ু শক্তি উৎপাদনের যন্ত্র এর পাখার সাথে সংঘর্ষে এবং উঁচু গাছ ক্রমাগত কেটে ফেলায় প্রজননের স্থানের মারাত্মক হ্রাস পাওয়ার কারণসহ মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কর্মের জন্য শকুন বিপন্ন প্রাণিতে পরিণত হয়েছে। শকুন দেখতে কুৎসিত। আকারেও বেঢপ। ভাগাড় কিংবা মৃত প্রাণীর আশপাশে এদের বিচরণ। মৃত প্রাণীর মাংস খেয়ে জীবন ধারণ করে। তাই গড়পড়তা মানুষের শকুনের প্রতি নাক সিটকানো ভাব আছে। উঁচু গাছে বা পাহাড়ের চূড়ায় শকুন বাসা তৈরি করে। শকুনের কোনো কোনো প্রজাতি বছরে ১-৩ টি সাদা ও ফ্যাকাশে ডিম পাড়ে।তবে সচরাচর শকুন বছরে একবার একটি ডিম পাড়ে এবং সেই ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্যের হার মাত্র ৪০ শতাংশ। অনেক সময় সেটিও ফোটে না। ফলে এদের প্রজননের হার খুব ধীর। বিষয়টি শকুনের বংশ বিস্তারের জন্যও হুমকি। শকুনকে প্রকৃতির ঝাড়ুদার বলা হয়, কারণ এরা মৃত প্রাণীর মাংস খেয়ে বেঁচে থাকে। ফলে প্রাকৃতিকভাবেই বহু জীবাণু ধ্বংস করে। শকুন পচা আবর্জনা, ময়লা এবং মৃত জীবজন্তুর পচে যাওয়া দেহ খেয়ে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে। তাদের পাকস্থলীতে নি:সৃত অ্যাসিড অত্যন্ত ব্যতিক্রম ক্ষয়কারী, যার ফলে তারা রোগজীবাণু ও ক্ষতিকর বিষাক্ত খাদ্য সহজ ও নিরাপদে হজম করতে সক্ষম। ফলে বোটুলিনাম টক্সিন হগ কলেরা ব্যাকটেরিয়া এবং অ্যানথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়ার এর মতো রোগজীবাণু খেয়ে আমাদের পরিবেশকে রোগমুক্ত করতে সহায়তা করে। শকুন ডাইক্লোফেনাক বিষক্রিয়ার কারণে কিডনি বিকল হয়ে মারা যায়। ডাইক্লোফেনাক হলো একটি নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগ যা ট্রমা এবং সংক্রামক রোগের কারণে প্রদাহ কমাতে দক্ষিণ এশিয়ায় গরু এবং মহিষের উপর ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বিষাক্ত ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা গবাদিপশুর মরদেহ খাওয়ার কারণে শকুন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রায় এত দশক গবেষণার পর পশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ডাইক্লোফেনাক-জাতীয় ওষুধ ব্যবহারের ফলেই শকুন হারিয়ে গেছে। তার মানে গরুর কোনো চিকিৎসায় এ-জাতীয় ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহারের ফলে গরু যদি মারা যায়, আর যদি ওই মরা গরু শকুন খায়, তবে সব শকুন বিষক্রিয়ায় নিমেষেই মারা পড়ে। ডাইক্লোফেনাকের পাশাপাশি কিটোপ্রোফেন, এসিক্লোফেনাক ও ফ্লুনিক্সিনি-জাতীয় ওষুধও শকুনের মৃত্যুর কারণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। পশু চিকিৎসায় বিশেষ করে গরুর চিকিৎসায় ব্যবহৃত দু’টি ওষুধ ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেন জাতীয় ওষুধের বহুল ব্যবহারের ফলেই মূলত শকুন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়া থেকে। এ দু’টি ওষুধ খাওয়া প্রাণীর গোশত খেলে তিন মিনিটের মধ্যে কিডনি বিকল হয়ে মারা যায় শকুন। কারণ শকুন এ ওষুধের বিক্রিয়া হজম করতে পারে না। ২০১২ সালে শকুন রক্ষায় ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তান সরকার মিলে একটি জোট গঠন করা হয়। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ ছাড়া তিনটি দেশে একযোগে পশুচিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ওষুধ নিষিদ্ধ করে। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয় ২০১০ সালে। কারণ এটি শকুনের জন্য খুবই ক্ষতিকর ছিল। পশু চিকিৎসার জন্য ব্যথানাশক নিরাপদ ওষুধ মেলোক্সিক্যাম আবিষ্কৃত হয়েছে। ওই ওষুধ ব্যবহারে শকুনের কোনো ক্ষতি হয় না। সম্প্রতি টলফামেনিক অ্যাসিডও শকুনের জন্য ভালো ওষুধ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। শকুন রক্ষায় দু’টি ওষুধ নিষিদ্ধ করা ছাড়াও সরকার ২০১৩ সালে জাতীয় শকুন সংরক্ষণ কমিটি গঠন করে। ২০১৪ সালে দেশের দু’টি অঞ্চলকে শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করা হয়। প্রথমটি সিলেট, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু অংশ এবং দ্বিতীয়টি খুলনা, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের কিছু অংশ। এ ছাড়া আইইউসিএনের সাথে সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় ২০১৫ সালে শকুনের প্রজননকালীন সময়ের জন্য দু’টি ফিডিং সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। একটি রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ও অপরটি সুন্দরবনে। শুধু স্বাস্থ্যকর পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য শকুন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না, মারাত্মক রোগজীবাণুসহ দূষিত বস্তু খেয়ে মানব স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে শকুন। প্রাকৃতিক ঝাড়ুদারকে টিকিয়ে রাখতে বিশেষ পরিকল্পনা নিতে হবে। শকুনের খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। শকুনের আবাসস্থল, বাসা খুঁজে বের করে তা সংরক্ষণ করতে হবে। প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে পরিচিত প্রাণীটিকে বাঁচাতে সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন। শকুন বাঁচাতে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট