বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশেও এ প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বাংলাদেশসহ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে মানসিক রোগের প্রকোপ অনেক বেশি। আত্মহত্যা একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা যা ব্যক্তি, পরিবার এবং সম্প্রদায়ের উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশ মানসিক রোগ চিহ্নিতকরণ ও চিকিৎসা গ্রহণ তেমন একটি হয় না। ফলে আত্মহত্যার হার দিন দিন বাড়ছে। আত্মহত্যার রয়েছে সামাজিক, আবেগীয় ও আর্থিক প্রভাব। যখন মানুষ জীবনে আর কোনো আশার আলো দেখতে না পেয়ে নিরাশ, হতাশ, হতোদ্যম হয়ে পড়ে, আর কোনো উপায় নেই বলে নিজেকে অসহায়, নিরুপায় মনে করে, তখন তার মনে আত্মহত্যার চিন্তা জাগে। যার ফলে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সবকিছু অন্ধকার, বিবর্ণ মনে হয়। প্রতিনিয়তই সংবাদপত্রে আত্মহত্যার খবর দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাবা কিংবা মা সন্তানদের হত্যা করে নিজে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। সমাজে প্রতিষ্ঠিত অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিও সাময়িক হতাশা কিংবা অসুবিধায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে আত্মহননের মতো ভুল পথে পা বাড়ান। আত্মহত্যার অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে, হতাশা, ব্যর্থতা, অবহেলিত বা প্রতারিত হওয়া, লোকলজ্জার ভয়, দীর্ঘ অসুস্থতা ইত্যাদি। অনেক কিশোর ও যুবক-যুবতির প্রেমে ব্যর্থতা, ধর্ষণের শিকার হওয়া, অ্যাকাডেমিক পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল করতে না পারা, এমনকি নিকটজনদের সঙ্গে অভিমান করেও আত্মহত্যা করে ফেলে। বিশ্বে আত্মহত্যা প্রতিরোধে ২০০৩ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থা দিবসটি পালন করে আসছে। সম্প্রতি এক গবেষণার দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৩ হাজার থেকে ৬৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। পৃথিবীতে প্রতিবছর ৭ থেকে ৮ লাখ লোক আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করে। এ ছাড়া বিশ্ব আত্মহত্যার ৭৭ শতাংশ ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়। বাংলাদেশে প্রতিদিন ২৮ থেকে ৩৫ জন আত্মহত্যা করে। এ সংখ্যা আরও বাড়ছে। তদুপরি যত মানুষ আত্মহত্যা করে, তার চেয়ে ২০ গুণ বেশি মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তার মানে, বছরে বিশ্বে ১ কোটি ৬০ লাখ লোক আত্মহত্যার চেষ্টা করে। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের ছেলে মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সর্বোচ্চ। আশার কথা হচ্ছে আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য। মানসিক রোগ সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি ও আগে থেকেই এগুলো চিহ্নিত করে চিকিৎসা দিলে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সহায়ক হবে। আত্মহত্যার অন্যতম ঝুঁকি হচ্ছে, ডিপ্রেশন, মদ ও মাদকাসক্তি, সিজোফ্রেনিয়া ও পূর্বে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে তেমন ব্যক্তিরা। আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে তেমন ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমরা টিটকারি করা, অবহেলা বা অবজ্ঞা করা। আত্মহত্যার চেষ্টাকারী আবেগীয় ও মানসিকভাবে অতি দুর্বল। একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে, পরবর্তী সময় তাদের আত্মহত্যা করার হার ছয় গুণ বেশি। তারা সামান্য কারণে ভেঙে পড়ে, হতাশ হয়, ক্ষুব্ধ হয় ও গ্লানিতে ভুগে। তারা আশাহীনতায় মনে করে মুক্তির একমাত্র উপায় নিজেকে মেরে ফেলা। এ চিন্তায় তাড়িত হয়ে তারা আত্মহত্যা করে। পরিবার ও স্কুলে তেমন ঝুঁকিপূর্ণ ছেলেমেয়েদের চিহ্নিত করতে হবে এবং তাদের আচরণ যত বিরক্তিকর, অসহ্য মনে হোক না কেন; ঘৃণা, অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য করে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করা ঠিক হবে না। তাদের দরকার যতœ, স্নেহ, সহায়তা ও ভালবাসা। পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে। সন্তান যেন নিজের যেকোনো অনুভূতি, সমস্যা বা বিপদের কথা খোলা মনে মা-বাবার সঙ্গে শেয়ার করতে পারে, এমন পারিবারিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। সন্তান মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত মনে হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। পৃথিবীর বুকে জন্ম নেওয়া প্রতিটি প্রাণীকেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে। তাই বলে আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে প্রাণ বিসর্জন কোনো মতেই কাম্য নয়। পৃথিবীর সব ধর্মেরই বিধান হলো, আত্মহত্যা মহাপাপ। আত্মহত্যা মারাত্মক অপরাধ। এটা হলো জঘন্যতম পাপ। মানুষ নানা কারণে আত্মহত্যা করতে পারেন। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা সংঘটিত হয় ডিপ্রেশন বা বিষণœতার জন্য। আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে সমাজ ও রাষ্ট্রের বড় ভূমিকা রয়েছে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকেও যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্তান-সন্তাতিদের পারিবারিক, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দেওয়া শুরু করতে হবে শৈশব থেকেই। আত্মহত্যায় মৃত্যুর বেশির ভাগই প্রতিরোধযোগ্য। আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারে মিডিয়ার দায়িত্বশীলতা ও সংবেদনশীল রিপোর্টিং করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মানসিকতা বোঝা এবং তাদের সঙ্গে মানসিক বিকাশে সহায়ক আচরণ করা। কর্মক্ষেত্রে অযাচিত মানসিক চাপ এবং যৌন হয়রানির মতো ঘটনা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি দেশের সুশীল সমাজ ও মিডিয়ায় গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে আত্মহননের কুফল বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে সমাজের এই মারাত্মক ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট