নওগাঁর মহাদেবপুরে বামনসাতা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে অফিস সহকারি পদে চাকরির জন্য সভাপতিকে আট লাখ টাকা ঘুষ দিয়েও চাকরি না পেয়ে ঘুষের টাকা ফেরৎ পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে মিঠুন কুমার (২৬) নামে এক সংখ্যালঘু পরিবারের যুবক। দেশের পট পরিবর্তনের পরও টাকা ফেরৎ না পেয়ে মানষিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন তিনি। ওই যুবক উপজেলার উত্তরগ্রাম ইউনিয়নের শ্রীরামপুর গ্রামের শ্রী বিদ্যুৎ কুমারের ছেলে। ভূক্তভোগি মিঠুন কুমার জানান, ওই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির তদানিন্তন সভাপতি ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম তার পূর্ব পরিচিত। পাঁচ বছর আগে সাইফুল ইসলাম মিঠুনকে তার স্কুলে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দিয়ে আট লাখ টাকা চান। মিঠুন চাকরি পাবার আশায় নিজের সামান্য জমি বিক্রি করে সে টাকা সাইফুলকে দেন। ২০২৩ সালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলে মিঠুন অফিস সহায়ক পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে পরীক্ষার জন্য না ডেকেই ওই পদে সভাপতির নাতি তারেক হোসেনকে নিয়োগ দেন। এরপর থেকেই তিনি ওই টাকা ফেরৎ পাবার জন্য দ্বারে দ্বারে ধর্না দিচ্ছেন। তিনি সাইফুলের কাছে টাকা চেয়ে না পেয়ে তদানিন্তন নওগাঁ-৩ (মহাদেবপুর-বদলগাছী) আসনের এমপি ছলিম উদ্দিন তরফদারের কাছে গিয়ে অভিযোগ দিয়েছেন। গত নির্বাচনে এই আসনে সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী সৌরেন এমপি নির্বাচিত হলে তার কাছেও অভিযোগ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি একটি বৈঠক ডেকে সাইফুল ইসলামকে টাকা ফেরৎ দিতে বলেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের অনেক নেতা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু দেশের পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে সাইফুল সে টাকা ফেরৎ না দিয়ে পলাতক রয়েছেন। সবশেষ এ ব্যাপারে দুসপ্তাহ আগে মিঠুন মহাদেবপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। এ ছাড়া গত ১৫ সেপ্টেম্বর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর আরও একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন। সম্প্রতি অন্যত্র বদলী হওয়া তদানিন্তন মহাদেবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রুহুল আমিন জানান, বিষয়টি তদন্ত করার জন্য এএসআই আমিনুল ইসলামকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। জানতে চাইলে এএসআই আমিনুল ইসলাম জানান, তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুল হাসান সোহাগ জানান, বিষয়টি নতুন ইউএনও ব্যবস্থা নিবেন।
রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ওই স্কুলে গিয়ে জানা যায়, প্রধান শিক্ষকসহ একই পরিবারের মোট পাঁচজন চাকরি করছেন এখানে। ওই পরিবারেরই সদস্য ছিলেন স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। প্রধান শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক জানান, তার শ্যালক সাইদুল ইসলাম এখানকার ইংরেজি বিভাগের সহকারি শিক্ষক, শ্যালকের স্ত্রী সোহেনা পারভীন সহকারি প্রধান শিক্ষক, অপর শ্যালক তোরন নৈশ প্রহরী ও নাতি তারেক অফিস সহায়ক পদে কর্মরত রয়েছেন। তার অপর শ্যালক সাইদুল ইসলাম ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ছিলেন। তবে অভিযোগকারি মিঠুন কুমার চাকরির জন্য কোন আবেদনই করেননি বলে দাবি করেন এই প্রধান শিক্ষক।
প্রধান শিক্ষকের পাশের চেয়ারে বসা কম্পিউটার অপারেটর জানান, মিঠুন আবেদন করেছিলেন। কিন্তু আবেদনে ভূল আছে বলে তা আবার ফেরৎ নিয়ে গেছেন। টাকা লেনদেনের বিষয় প্রধান শিক্ষক কিছুই জানেন না বলেও দাবি করেন। সবরকম নিয়োগ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশমত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষকের কিছুই করার থাকেনা। তার শ্যালক সাইদুল ইসলাম এমপি ছলিম উদ্দিন তরফদারের ডিও লেটারে এই স্কুলের সভাপতি হয়েছিলেন বলেও জানান তিনি। মিঠুন জানান, তিনি ও আরো দুজন আবেদনকারিকে পরীক্ষার দিন ডাকা হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, এরআগেও এই স্কুলে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ করা হয়েছিল। এনিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় একের পর এক সংবাদ প্রকাশিত হয়। ফলে দীর্ঘদিন নিয়োগ বন্ধ ছিল। কিন্তু গোপনে আবার সেসব নিয়োগ দেয়া হয়। সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলামের মোবাইলফোন নম্বরে বার বার কল দেয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১০ বছর ছলিম উদ্দিন তরফদার এমপি থাকাকালে প্রতিটি স্কুল ও মাদ্রাসায় লক্ষ লক্ষ টাকার নিয়োগ বাণিজ্য হয়েছে। মূলত: ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির মাধ্যমে সেসব টাকা পৌঁছে যেত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত। অনেকেই মোটা অংকের টাকা দিয়েও চাকরি বঞ্চিত হয়েছেন। সেসব টাকা ফেরৎ না দেয়ায় এখন পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে একের পর এক অভিযোগ উঠছে। এমপি ছলিম উদ্দিন তরফদার ও এমপি সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী উভয়েই পলাতক থাকায় এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাবুল চন্দ্র বাবু ঘোষ, উত্তরগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রনজিত কুন্ডু, সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ প্রমুখ টাকা লেনদেনের বিষয়টি জানেন বলে সাংবাদিকদের জানান। এনিয়ে এমপি সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী বৈঠক করেছিলেন বলেও জানান তারা।