নিঃশেষের পথে বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের মজুদ। মার্কিন কোম্পানি শেভরন ওই গ্যাস ক্ষেত্রটি পরিচালনা করে। বর্তমানে ওই গ্যাস ফিল্ড থেকে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ১ হাজার ২ মিলিয়ন ঘনফুট বা ৩৯ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করা হয়। আর বিবিয়ানা থেকে গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে দেশের জ¦ালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। হিসাব অনুযায়ী, বিবিয়ানায় গ্যাসের মজুদ থাকার কথা প্রায় ছয় ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। এরই মধ্যে সেখান থেকে উত্তোলন ছয় টিসিএফ ছাড়িয়েছে। শেভরনের পক্ষ থেকে গত বছর মার্কিন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে বাংলাদেশে অতিরিক্ত ৪৮১ বিলিয়ন কিউবিক ফুট (বিসিএফ) গ্যাস মজুদের কথা জানানো হয়। আর ওই মজুদও বিবিয়ানার। এরই মধ্যে ওই গ্যাসেরও সিংহভাগ উত্তোলন হয়েছে। ফলে নিঃশেষের কাছাকাছি দেশের গ্যাস উত্তোলনে শীর্ষে থাকা ক্ষেত্রটির মজুদ। পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জাতীয় গ্রিডে প্রতিদিন দেশে উত্তোলিত গ্যাস ছাড়াও এলএনজি যুক্ত হওয়ার কথা দৈনিক ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ওই এলএনজির পুরোটাই আমদানিনির্ভর। আর এর সরবরাহ ব্যবস্থাপনার কেন্দ্রে রয়েছে ভাসমান দুটি টার্মিনাল বা এফএসআরইউ। এর মধ্যে একটি প্রায় সাড়ে তিন মাস অচল পড়ে ছিল। ফলে জাতীয় গ্রিডে দিনে ৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি সরবরাহ দেয়া যায়নি। বর্তমানে টার্মিনালটি সচল হলেও এখন এলএনজি আমদানি না থাকায় ওই সরবরাহ বাড়ানো যাচ্ছে না। এলএনজির সরবরাহ না থাকায় এরই মধ্যে চাপে পড়েছে দেশের শিল্প, বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন। গ্যাস মজুদের প্রাথমিক প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী, বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রে মোট মজুদের পরিমাণ ৮ হাজার ৩৮৩ বিসিএফ। তবে এ গ্যাসের পুরোটাই উত্তোলনযোগ্য নয়। গ্যাস রিকভারি ফ্যাক্টর অনুযায়ী এ ধরনের গ্যাস ক্ষেত্রে মোট মজুদের ৭০ শতাংশ উত্তোলনযোগ্য। সূত্র জানায়, বিবিয়ানায় চিহ্নিত মজুদের বাইরে দেশে গ্যাসের আর কোনো বড় মজুদ আছে কিনা সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। জ¦ালানি বিভাগ কিংবা পেট্রোবাংলা থেকে বিবিয়ানায় নতুন মজুদ শনাক্ত হওয়ার বিষয়ে কোনো ঘোষণাও দেয়া হয়নি। তবে সেখান থেকে উত্তোলনযোগ্য আরো ১-২ টিসিএফ মজুদ পাওয়া গেলে তা দেশের জ¦ালানি খাতে গ্যাস সংকটের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। শেভরনের পক্ষ থেকে গ্যাস মজুদের একটি প্রতিবেদন পেট্রোবাংলায় জমা দেয়া হয়েছিল। সেখানে গ্যাসের রিজার্ভের একটি তথ্য জানানো হয়েছে। তবে সেটি খুব বেশি নয়। এটি জ¦ালানি বিভাগে পাঠানো হয়েছে। তবে সেখান থেকে এখনো কোনো প্রতিউত্তর পাওয়া যায়নি। তবে হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রে প্রমাণিত গ্যাসের মজুদ ৫ হাজার ৭৫৫ বিসিএফ। এর বাইরে বিবিয়ানায় গ্যাস মজুদের নতুন কোনো তথ্য প্রকাশ হয়নি। মার্কিন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে জমা দেয়া শেভরন করপোরেশনের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, রিজার্ভের ব্যবস্থাপনার ফলে বাংলাদেশে তাদের অধীন গ্যাস ক্ষেত্রে মজুদ বেড়েছে ৪৮১ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। সুনির্দিষ্টভাবে সেখানে শেভরন কোনো গ্যাস ফিল্ডের কথা উল্লেখ না করলেও এ মজুদ বিবিয়ানা ফিল্ডেরই। সে অনুযায়ী সেখানে মোট মজুদ ৬ হাজার ২৩৬ বিসিএফ। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৫ হাজার ৯৭৫ বিসিএফ এবং জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিবিয়ানা থেকে আরো অন্তত ৮৭ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হবে। সব মিলিয়ে চলতি মাস পর্যন্ত ৬ হাজার ৬২ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হবে। ফিল্ডটিতে আর অবশিষ্ট থাকবে ১৭৪ বিসিএফের মতো। সূত্র আরো জানায়, বিবিয়ানায় গ্যাস উৎপাদন যে হারে হচ্ছে, তাতে কিছুটা কমবেশি হলেও এ ফিল্ড থেকে আর বড়জোর এক থেকে দুই বছর গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যাবে। দেশের জাতীয় গ্রিডে বর্তমানে সরবরাহ দৈনিক ২ হাজার ৫৯০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে বিবিয়ানা ফিল্ডের সরবরাহ ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের ওপরে রয়েছে। উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে ধরে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শেভরনও। তবে জাতীয় গ্রিডে এ মুহূর্তে বিবিয়ানার গ্যাসের কোনো বিকল্প নেই। এখানে উৎপাদন আগামী দুই-এক বছরের মধ্যে কমে এলে তা দেশের গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় ধস ডেকে আনতে পারে। কারণ এত বৃহৎ সক্ষমতার জোগানের বিকল্প ব্যবস্থা নেই পেট্রোবাংলার। তখন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হলে আমদানিনির্ভরতা বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু দ্রুত জ¦ালানি সরবরাহ আইন স্থগিত থাকায় এখন আগের মতো চাইলেও দ্রুততার সঙ্গে এলএনজি আমদানি করা যাচ্ছে না। এদিকে সিলেট অঞ্চলে কাজের পরিধি বাড়াতে ২০২২ সালের অক্টোবরে পেট্রোবাংলার সঙ্গে তিনটি চুক্তি করে শেভরন। চুক্তির আওতায় কোম্পানিটি বিবিয়ানায় নতুন জায়গা পায়। মৌলভীবাজার ও জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রের গ্যাস ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির মেয়াদও বাড়িয়ে নেয় কোম্পানিটি। বর্তমানে জালালাবাদ ও বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রের সঙ্গে চুক্তির সময়সীমা রয়েছে ২০৩৪ সাল পর্যন্ত। আর মৌলভীবাজার গ্যাস ক্ষেত্রের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে ২০৩৮ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে গত বছর বিবিয়ানায় মূল্যায়ন কূপ (বিবিয়ানা-২৭) খনন করা হয়। তবে বিবিয়ানায় রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা হলে আরো মজুদ বাড়ার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রে উত্তোলনযোগ্য প্রকৃত মজুদ নির্ণয় ও নতুন করে কূপ খনন কার্যক্রম আরো জোরদার করা প্রয়োজন। গ্যাস ক্ষেত্রটির অনাবিষ্কৃত এলাকায় নতুন করে খনন কার্যক্রম চালালে সেখানে আরো গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে দেশে গ্যাস সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ নিচ্ছে। এরই মধ্যে চাপে পড়েছে শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সার কারখানার উৎপাদন। বিপাকে পড়েছেন শিল্পোদ্যোক্তারাও। বিশেষ করে উৎপাদনমুখী বৃহৎ শিল্পগুলো। দেশে উৎপাদনমুখী শিল্পের সঙ্গে জড়িত মোট কর্মসংস্থানের ৬৮ শতাংশই বৃহৎ শিল্পে। কাঁচামালের ৬৩ শতাংশ ও বিদ্যুৎ-জ¦ালানির ৫৬ শতাংশই ব্যবহার করে এ শিল্পগুলো। বৃহৎ শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সিরামিক ও বস্ত্র শিল্পের কারখানাগুলো। কখনো কখনো সিরামিক খাতের কারখানাগুলোয় উৎপাদন ক্ষতি ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রচুর কাঁচামালও নষ্ট হচ্ছে। গ্যাস সংকটের কারণে বস্ত্র শিল্পেও উৎপাদন সক্ষমতার সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ব্যবহার করা যাচ্ছে। এ নিয়ে শিল্পোদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে পেট্রোবাংলার কাছে নানাভাবে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবিও জানানো হয়েছে। গ্যাসের গড় পিএসআই পর্যাপ্ত না হওয়ায় কারখানাগুলোর অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন মেশিনারি নষ্ট হওয়ার অভিযোগও তুলেছেন তারা। বিদ্যুৎ খাতেও সংকট বড় আকার ধারণ করেছে। দেশে বর্তমানে দিন ও রাত মিলিয়ে গড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। প্রয়োজনীয় গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় প্রায় সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্ধেক বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। সংকট রয়েছে কয়লা ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও। ফলে দেশজুড়ে লোডশেডিংয়ের তীব্রতা বাড়ছে। একইভাবে ব্যাহত হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার সার কারখানার উৎপাদন। এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে দুটি কারখানার উৎপাদন। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না হলে যথাসময়ে কৃষককে সার সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। এমনকি চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা থেকে সার উৎপাদন কম হবে সাড়ে তিন লাখ টন। ফলে ঘাটতি পূরণে সরকারকে ব্যয় করতে হবে অতিরিক্ত ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার পরিচালক প্রকৌশলী কামরুজ্জামান খান জানান, দুটি এলএনজি টার্মিনালই এখন সচল। তবে দুটি টার্মিনালের জন্য পর্যাপ্ত এলএনজি না থাকায় আপাতত একটি টার্মিনাল কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আগামী ৫-৬ অক্টোবর থেকে দুটি টার্মিনাল দিয়েই এলএনজি সরবরাহ দেয়া যাবে।