আদিকাল থেকে পরিবার ও সমাজে কন্যা শিশুরা অবহেলিত। সারাবিশ্বেই নানা কারণে কন্যা শিশুরা বেশ অবহেলিত। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মর্যাদা, ভালোবাসা সব দিক থেকেই বলতে গেলে তারা বঞ্চিত। শুধু যে আমাদের দেশের চিত্র এমন তা কিন্তু নয়। সারাবিশ্বেই কোনো না কোনো জায়গায় প্রতি মুহূর্তে অবহেলার শিকার হচ্ছে কন্যা শিশু। পরিবার ছাড়াও সামাজিকভাবেও তারা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। গৃহ পরিবেশে একজন পুত্র সন্তানকে যেভাবে গুরুত্ব সহকারে আদর-যতেœ লালনপালন, শিক্ষার প্রতি যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেভাবেই একজন কন্যা শিশুর মানসিক নিপীড়নের হাত থেকে মুক্ত করাই হল কন্যা শিশু দিবসের অন্যতম উদ্দেশ্য। ৩০ সেপ্টেম্বর সারাদেশে পালিত হচ্ছে জাতীয় কন্যা শিশু দিবস। প্রতিবছর ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক শিশু সপ্তাহ পালন করা হয়। শিশু সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন ৩০ সেপ্টেম্বরকে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কন্যাশিশুদের সুরক্ষা, শিক্ষার অধিকার, পরিপুষ্টি, আইনি সহায়তা ও ন্যায় অধিকার, চিকিৎসা সুবিধা ও বৈষম্য রোধ, নির্যাতন থেকে রক্ষা, নারীর বিরুদ্ধে হিংসা ও বাল্যবিবাহ বন্ধে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে পালন করা হয়। বাংলাদেশের সমাজে যাতে মহিলারা ভেদাভেদ বা বৈষম্যের শিকার না হন, সেদিকে লক্ষ্য রেখে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ২০০০ সালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কন্যাশিশু দিবস পালনের আদেশ জারি করে। ৩০ সেপ্টেম্বর কন্যাশিশু দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। একটি দিন শুধু কন্যা শিশুদের জন্য উৎসর্গ করা। অনেকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম গুলোতে স্ট্যাটাস দিয়েই কন্যা শিশু দিবস পালন করছেন। দেশে বিভিন্ন আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়। বিভিন্ন আনুষ্ঠানে কন্যা শিশুদের প্রতি বৈষম্য দেখানো চলবে না, তাদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করার আহ্বান জানানো হয়। কন্যাশিশু দিবসের বিভ্রান্তির জায়গা। একটি জাতীয় কন্যা শিশু দিবস ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয়। আর একটি আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস ১১ অক্টোবর যেটি জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলো পালন করে। আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস পালন করা হয় ১১ অক্টোবর। বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন দিনে দিবসটি পালন করে থাকে। কানাডা প্রথম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস পালনের প্রস্তাব দেয়। পরে ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর তারিখে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর প্রথম আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস পালন করা হয়। প্রথম আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল বাল্য বিবাহ বন্ধ করা। পৃথিবীজুড়ে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে এ দিবসটি পালন করা। সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্রসহ সমস্ত স্থানে নারী পুরুষের ভেদাভেদ দূরীকরণ হলো কন্যা শিশু দিবস অন্যতম উদ্দেশ্য। ২০১১ সালে জাতিসংঘ কন্যা শিশু দিবসের ঘোষণা দেওয়ার পর ২০১২ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস পালন করা হয়। শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৯৭৪ সালে প্রথম শিশু আইন প্রণয়ন করা হয়। এর ১৫ বছর পরে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ঘোষণা দেয়। এর পরের বছর বাংলাদেশ সেই সনদে সই করে। কন্যা শিশুদের শিক্ষার অধিকার, পরিপুষ্টি, আইনি সহায়তা ও ন্যায় অধিকার, চিকিৎসা সুবিধা ও বৈষম্য থেকে সুরক্ষা, নারীর বিরুদ্ধে হিংসা ও বলপূর্বক বাল্যবিবাহ বন্ধে কার্যকর ভূমিকা পালনের লক্ষ্যে এ দিবসের সূচনা হয়। কন্যা শিশুরা আমাদের সমাজে কতটা অসহায় তা সহজেই প্রতীয়মান। প্রতিদিন দেশে নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কন্যা শিশুদের বাল্য বিবাহ দেওয়ার প্রচলন এখনও দেশে বিদ্যমান। দরিদ্রতা ও নিরাপত্তার অভাবে পিতা-মাতা কন্যা শিশুদের বিয়ে দিয়ে দেয়। কম বয়সে বিয়ের ফলে কন্যা শিশুরা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে। যার কারণে পরবর্তীতে মা ও শিশু দুজনেই মারাতœক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এতে তাদের দহিক ও মানসিক ভাবে বিকাশে বাধাগ্রস্ত হয়। বিশ্বজুড়ে নারী ও কন্যা শিশুদের প্রতি অব্যাহত সহিংসতা ও নৃশংসতার ঘটনা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ শিশু, যাদের বয়স আঠারো বছরের কম। আর শিশুদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ কন্যা শিশু যাদের পিছনে রেখে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কন্যা- জায়া- জননীর বাইরেও কন্যা শিশুর বৃহৎ জগৎ রয়েছে। স্বাধীনভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করা ছাড়াও পরিবার, সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রীয় কর্মকা-ে নারীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন করা সম্ভব। এ জন্য কন্যাশিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তাসহ বেড়ে ওঠার সব অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের কন্যা শিশুরা দেশের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদের নিরাপদে বেড়ে উঠতে দিতে হবে। কন্যা শিশু সুরক্ষা পেলে সব বৈষম্য দূর হবে। কন্যা শিশুদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সাফল্য অর্জন করেছে। বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে নেওয়া হয়েছে কঠোর আইন। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে। অভিভাবকদের সবচেয়ে বেশী সোচ্চার হতে হবে কন্যা শিশুদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। কন্যা শিশুর অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে পুরুষের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রকাশ ঘোষ বিধান; সাংবাদিক ও কলামিস্ট