সরকারি চাকুরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করতে হবে- এই দাবিটি দেশের কত শতাংশ চাকুরি প্রার্থীর? প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় সার্টিফিকেটের ২৪-২৫ বছর বয়সের মধ্যেই মাস্টার্স শেষ হয়। দেশের খুব কম সংখ্যক সরকারি চাকুরিতে মাস্টার্স ম্যান্ডেটরি। বিদ্যমান ব্যবস্থায় চাকুরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০। এই কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। চাকুরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০। সার্টিফিকেটের ৩০ বছর মেয়াদের মধ্যে আবেদন করে কেউ কেউ ৩৩ বছরেও চাকুরিতে প্রবেশ করতে পারে। কেননা বিভিন্ন স্তরের পরীক্ষা-বাছাই, ভেরিফেকেশন-মেডিকেলের যাচাই শেষে পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং অন্যান্য অনেক এজেন্সির এই যাত্রা শেষ করতে ৩/৪ বছরের অধিককালও লাগে। কাজেই যে চাকুরি প্রার্থী সম্পূর্ণ বেকারত্বের ৫/৭ বছরের প্রস্তুতিতে চাকুরি বাগাতে পারেনি, ৩৫ এর পক্ষে তাঁর দাবি জোড়ালো। সাম্প্রতিক সময়ে ৩৫ এর পক্ষে বিক্ষিপ্ত কিছু আন্দোলনও হয়েছে। এই আন্দোলনের কারণ হিসেবে কারোনাকালের ক্ষতি, শিক্ষাজীবনের সেশন জটকে দায়ী করা হয়েছে। দাবি যে সম্পূর্ণ অমূলক তাও বলা যাচ্ছে না। তবে এই দাবিতে হুট করে ৩৫ বছর করে দেওয়া বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সমাজিক বাস্তবতায় আরও অধিক যৌক্তিক নয়। প্রস্তাবিত পঁয়ত্রিশ : বাস্তবায়নের পূর্বেই বিবেচনা প্রয়োজন! যে চাকুরি প্রার্থী সার্টিফিকেটের ৩০ এর মধ্যে চাকুরির ব্যবস্থা করতে পারেনি সে ৩৫ বছরের মধ্যে পারবে- দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এমনটা ঘটার সম্ভাবনা সামান্য। চাকুরি প্রাপ্তির বয়সভিত্তিক পরিসংখ্যান অন্তত ৩৫ এর পক্ষে সাফাই গাইছে না। এ দেশের যুবকদের শারীরিক সক্ষমতা, পড়ার ধৈর্য বয়সের ফ্রেমে ওঠানামা করে। ২৫ বছরের তরুণের সাথে ৩৫ বছরের যুবক প্রিলিমিনারির গাইড, রিটেনের বিশাল সিলেবাস আয়ত্ত করে টিকে যাবে- কাজটা সহজ হবে না। কারণ মস্তিষ্কের মুখস্থ ক্ষমতা এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতার স্তর আলাদা। তাছাড়া চাকুরি না পেয়ে অন্য কোন কাজে নিজেকে জড়ানো যাবে না, বেকার অবস্থায় পরিবার নির্ভর থাকতে পাবে, প্রতিষ্ঠিত না হয়ে বিয়ে করা যাবে না- এইসব চরিত্র আমাদের জাতীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছে। এসবে যে-সব সামাজিক জটিলতা বাড়াবে, জিডিপিতে অবদান কমাবে- সেসব বিবেচনা করে ৩৫ এর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। ৩৫ এখনো চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত নয় বরং সুপারিশ। বাস্তবতার আলোকে চাকুরির বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হবে বলেই আশা করছি। কোচিং ব্যবসায়ীরা এবং একটি মহল ৩৫ এর আন্দোলন/দাবির পালে হাওয়া দেবে। কারণ এখানে ব্যবসায়িক ধান্ধা আছে। ৩০ বছরের একজন বেকার স্বপ্ন ছোঁয়ার জন্য গাইড বই নিয়ে সারাদিন কর্মহীন বসে থাকে- রাষ্ট্রের জন্য এই চিত্রও আশাপ্রদ নয়। বরং যখন চাকুরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হবে তখন এক বিশাল জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ কোন কাজে না জড়িয়ে সরকারি চাকুরির আশায় চাতকের মত প্রহর কাটাবে। পড়ার টেবিলের সাথে জুড়ে থাকা চেয়ার শুষে নেবে যৌবন! যাতে পারিবারিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দেশের অগ্রগতি ব্যাহত হবে এবং বেকারত্বের অভিশাপে রাষ্ট্র ধুঁকবে। এমন তো নয় যে, সার্কুলারের চাহিদায় যে পদসমূহ শূন্য থাকে তা ৩০ বছরের বেকারের দ্বারা পূর্ণ হচ্ছে না। সরকারি চাকুরি প্রদানের যে সামগ্রিক সীমাবদ্ধতার সংখ্যা তা চাকুরির বয়স ২৭ বছর থাকলেও পূরণ হয়ে যাবে! আবার অন্যদিকে চাকুরিতে প্রবেশের বয়স উন্মুক্ত করে দিলেও সবাই চাকুরি পারে না। কাজেই সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট হয় এমন কোন কাজেই রাষ্ট্রের মদদ দেওয়া উচিত হবে না। অনেকেই বিভিন্ন দেশের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশের চাকুরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির স্বপক্ষে যুক্তি দিচ্ছে। তবে সেই সকল দেশের সাথে বাংলাদেশের সামগ্রিক বাস্তবতা ভিন্ন। বিশ্বের কোথাও কেবল টার্গেটকৃত চাকুরির জন্য সার্টিফিকেটের পূর্ণ মেয়াদকাল পর্যন্ত পাবলিক লাইব্রেরিতে বই নিয়ে বসে থাকে না। বাংলাদেশেও যদি চাকুরিতে প্রবেশের জন্য লক্ষ্য সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয় অর্থাৎ একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ কতবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে- তবে যে বিপুল সংখ্যক বেকার কেবল স্বপ্নের পূরণের আশায় বাস্তবতা উপেক্ষা করে তাদের দ্বারা জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে আরও অবদান নিশ্চিত হবে। পঁয়ত্রিশের সাথে পঁয়ষট্টির সখ্যতা জুড়ে গেছে। উল্লেখযোগ্য কোন দাবি ছাড়াই ৫৯ থেকে অবসরের বয়স ৬ বছর বেড়ে ৬৫ করার সুপারিশ এসেছে। বেকারত্বের যে নিষ্ঠুরতা সেটাকে আরও বৃদ্ধি করা ছাড়া এই প্রস্তাবের ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য আছে বলে আপাতত দৃশ্যমান নয়। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, শারীরিক ক্ষমতা বেড়েছে কি কমেছে সেটা ডাক্তার এবং ফার্মেসি জানে কিন্তু অবসরের বয়স ৬৫ করলে তাতে রাষ্ট্রের উপকারের চেয়ে অপকার বেশি হবে। এই দেশের প্রধানতম যে বেকারত্ব সমস্যা সেটাকে, অবসরের বয়স বৃদ্ধ করলে, আরও তীব্রতর করা হবে। কারণ চাকুরি প্রবেশসীমার বয়স বৃদ্ধি সংক্রান্ত এই সুপারিশ যদি আলোর মুখ দেখে তবে এখন থেকে ০৬ বছরে বিদ্যমান ক্ষেত্রে চাকুরি প্রার্থীদের জন্য কোন পোস্ট ফাঁকা হবে না। মধ্যবর্তীরা উচ্চপর্যায়ে প্রমোশন পাবে না এবং জুনিয়রাও পদ-পদবীতে সিনিয়র হতে পারবে না। যেহেতু সিস্টেমের মস্তিষ্ক থেকে অবসর না নেওয়াতে পায়ের দিকে শূন্যপদ নাই। ৫৯ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে যারা অবসরে যাবে সেই সংখ্যাকে হিসাব করে যদি শূন্যপদ সৃষ্টি করা হয় এবং সেই সংখ্যক পদ ০৬ বছরে ধাপে ধাপে স্বাভাবিক সার্কুলারের শূন্য পদের সাথে যুক্ত করা হয় তবেই কেবল ৬৫ নিয়ে ভাবা যাবে। এমন কোন ব্যবস্থা না করে অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর চিন্তা থেকে নয়তো থামতে হবে। জীবন কেবল চাকুরির জন্য না। আয়ুর অনেকখানি উপভোগের জন্য। অথচ আমরা সমস্ত জীবন জুড়ে কেবল চাকুরিই করতে চাই। কেন চাই তা জানি না! যারা এই জাতির সবচেয়ে অভিজ্ঞ সন্তান তারা যদি তরুণদের সুযোগ না দেয় তবে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সম্ভাবনা বিফলে যাবে। যদি অবসরের ক্ষেত্রে ৬৫ বছরের সীমানায় রাষ্ট্র উন্নীত হতে চায় তবে যারা ৩৫ এর জন্য আন্দোলন করছে তাদের সাথেই অন্যান্যদের মিশেলে উল্টো আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ৩৫ ও ৬৫ বিরোধী বিবৃতি, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমন্বায়ক সারজিস আলমের এ সংক্রান্ত ফেসবুক স্ট্যাটাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনোভাব ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে। যদিও ৬৫ চূড়ান্ত নয় বরং সুপারিশ তবুও পরিস্থিতি ঘোলাটে হওয়ার পূর্বেই সন্তোষজনক সমাধান হোক। সংস্কারের নামে এমন কিছুর প্রত্যাশা করাও ঠিক হবে না যা বাংলাদেশের বাস্তবতার সাথে আপাতত খাপ খাচ্ছে না। কাজেই প্রস্তাবিত পঁয়ষট্টি : বাস্তবায়নের পূর্বেই বিবেচনা প্রয়োজন! পঁয়ত্রিশ এবং পঁয়ষট্টি যে প্রস্তাবনা মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত হয়েছে- তা বেকারদের এবং সরকারি কর্মজীবীদের আশার অংশ। যারা ৩৫ দাবি করছে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত এবং যারা ৬৫ নিয়ে কথা বলছে তাদের দাবির পক্ষেও যুক্তি আছে। তবে সেটা একবারেই ৩০ থেকে ৩৫ কিংবা ৫৯ থেকে ৬৫ হওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। করোনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কিংবা করোনার মধ্যেই চাকুরিতে আবেদনের বয়স ২০২০ সালের ২৫ মার্চের মধ্যে ফুরিয়ে গিয়েছিল তাদেরকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বিসিএসসহ অন্যান্য অনেক চাকুরিতে আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজটের দৈর্ঘ্য খুবই সামান্য। যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজটের অভিযোগ প্রবল ছিল সেখানেও ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে কোর্সের মেয়াদ প্রায় স্বাভাবিক সময়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সেখানে সেশনের মেয়াদ শেষ বা না হোক, ক্লাস হোক বা না হোক- পূর্ব নির্ধারিত একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসরণে পরীক্ষা হবেই। কাজেই চাকুরিতে আবেদনের বয়সসীমা কোনোক্রমেই ৩২ এর বেশি করা উচিত এবং যৌক্তিক হবে বলে মনে হয় না। বয়সসীমা এর বেশি করলে সামাজিক শৃঙ্খলা, বৈবাহিক রীতি এবং জিডিপিতে সেটার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। উল্লেখ্য যে, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং অন্যান্য চাকরিপ্রার্থীদের চাকুরিতে আবেদনের বয়সসীমা সীমা একই হওয়া আবশ্যক। যারা ৬৫ এর পক্ষে তাদের অবসরসীমা একলাফে ৫৯ থেকে ৬ বছর বৃদ্ধি করে ৬৫ করা যৌক্তিক হবে না। বরং এটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। অবসরের বয়সসীমা বড়জোড়া বিদ্যমান ব্যবস্থার সাথে ১ বছর যোগ করে ৬০ বছর করা যেতে পারে। এবং পূর্ণাঙ্গ পেনশনের মেয়াদ ২০ বছর নির্ধারণ করলে যে কোন কর্মজীবী তার ইচ্ছানুযায়ী পেনশনে যেতে পারে। আসলে জীবন তো উপভোগের জন্য। মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে চাকুরি করে। সহজ কথায় বললে স্বেচ্ছায় চাকর হয়। স্বল্পায়ুর জীবনে বহুমাত্রিক কাজ-কারবার থাকুক। কেবল গতানুগতিক একটি কাজে জীবনের ৩৫-৪০ বছর কাটিয়ে দিলে আগত জেনারেশনের জন্য সম্ভাবনার পথে জট তৈরি হবে।
রাজু আহমেদ, কলাম লেখক