মহান ও নিবেদিত পেশা হিসেবে শিক্ষকতা সর্বজন স্বীকৃত। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেই মনে করা হয় শিক্ষকদের। পাঠদানে আত্ম-নিয়োগ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিহিত থাকা সুপ্ত মেধা জাগ্রত করা, দুঃস্থ ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিজের অর্থ ব্যয়ে দেশ সেরা হিসেবে গড়ে তোলা শিক্ষকও দেশে বিরল নয়। এ জন্যই সমাজে শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি সম্মানিত, শিক্ষার্থীরাও যুগে যুগে স্মরণ রাখেন তাদের। একটি জাতির অগ্রগতি কিংবা উন্নতির প্রধান সোপান হলো শিক্ষা। শিক্ষার ওপর নির্ভর করেই সে জাতি গড়ে ওঠে। তাই বলা হয়, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড।’ এ জন্য বিশিষ্টজনেরা বলেন, একটি জাতিকে ধ্বংস করতে হলে সে জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে আগে ধ্বংস করতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ বা জাতির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে তাদের অগ্রগতির পেছনে শক্তি হিসেবে শুধু অস্ত্র-সমারস্ত্র কাজ করেনি; বরং কাজ করেছে তাদের শিক্ষাদীক্ষা। আর এই শিক্ষা শব্দটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে শিক্ষকতা নামক মহান পেশা। আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থা তিন স্তরবিশিষ্ট। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় স্তর। দেশের সকল প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ বা সরকারি করা হয়েছে। গত বছর গুলিতে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে ব্যানার, পোস্টার নিয়ে তাঁরা আন্দোলন করছেন। যে যুক্তি দাঁড় করিয়ে তাঁরা আন্দোলন করছেন, সেগুলোকে তাঁরা ন্যায্য অধিকার হিসেবে মনে করছেন। তাদের দাবির সাথে সহমত প্রকাশ করে শিক্ষাবিদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ। কিন্তু অবস্থার কোন উন্নতি হয় নি। সবই ছিল পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী, স্বৈরাচারী শেখ হসিনা ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী, বর্তমানে রিমান্ডে ডা. দিপু মনির নাটক। বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে স্কুলে তালা ঝুলিয়ে গত বছর ১১ জুলাই থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন এমপিও শিক্ষকরা। কর্মসূচির শুরুর পর পুলিশ শিক্ষকদের লাঠিচার্জ করে সরিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করে। তারপরও শিক্ষকরা কর্মসূচিতে অনড় থাকেন। এর মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি তাদের সঙ্গে বৈঠক করে ক্লাসে ফেরার আহ্বান জানালেও তাতে সাড়া দেননি শিক্ষকরা। টানা ২১ দিন অবস্থান কর্মসূচির পর গত বছর ১ আগস্ট থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করেন শিক্ষকরা। ঘোষণা অনুযায়ী- ১ আগস্ট কাফনের কাপড় পরে অনশন করেন তারা। ওইদিন রাতে রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরি, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের সঙ্গে বৈঠকে বসেন শিক্ষক নেতারা। কিন্তু সবই নাটক, কাজের কাজ কিছুই হয় নি। মানুষের প্রচন্ড জ্ঞান তৃষ্ণা নিবৃত্তির প্রচেষ্টা থেকেই শিক্ষার যাত্রা। মানুষ আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক বা উপানুষ্ঠানিকভাবে যার কাছ থেকে শিখেছে, জেনেছে তিনিই শিক্ষক। শিক্ষক একাধারে মানুষ, সমাজ ও সভ্যতা বিনির্মাণের কারিগর। পিতা-মাতা সন্তানের জন্মদাতা হলেও প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকই সন্তানকে মনুষ্য রূপে গড়ে তোলেন। তাইতো সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সকল লেখক, কবি, সাহিত্যিক তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে শিক্ষকদের মর্যাদা সমুন্নত রাখার প্রয়াস চালিয়েছেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও আমরা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি। শিক্ষার প্রত্যেক স্তরে বৈষম্য ও অসংগতি প্রকট আকারে বিদ্যমান। সাধারণ শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা ও বিশেষায়িত শিক্ষার সাথে ন্যাশনাল ও ব্রিটিশ কারিকুলাম, ‘এ’ ‹লেভেল ‘ও’ লেভেলতো আছেই। আবার কিন্ডারগার্টেন সিস্টেম, ধর্মীয় শিক্ষার আলিয়া ও কওমী ধারাও আছে। বহু ধারা ও সিস্টেমে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ায় জাতির মন-মননও বহু ধারায় গড়ে উঠেছে। ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ঐকমত্যের পরিবর্তে মতানৈক্য এবং বিভাজনের পাল্লা ভারী হয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো, জাতি বার বার স্বৈরশাসন, নির্যাতন, নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে চাহিদা সম্পন্ন দক্ষ ও কর্মঠ জনবল তৈরির পরিবর্তে বেকারও মানসিক বিকারগ্রস্ত ও অকেজো লোক তৈরি হয়েছে বেশি। স্বাধীনতার পর যতগুলো শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে, কোনো শিক্ষা কমিশনই দেশে মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারেনি। বিজ্ঞানমনস্ক, কারিগরি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পন্ন জনবল তৈরির পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে অপরিকল্পিত, স্বেচ্ছাচারী মানহীন পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তকের বোঝা। সাথে যুক্ত হয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ভয়াবহ অপরাধ, যা শিক্ষার্থীদের মনে সৃষ্টি হয় চরম আত্মবিশ্বাসহীনতা আর হতাশা, তাদেরকে ধাবিত করে অনৈতিক অন্ধকার জগতের দিকে। ২০২৩ সালের নতুন কারিকুলাম পরিকল্পিতভাবে জাতিকে মেধাশূন্য করার গভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র আমাদের কাঁধে সওয়ার হয়েছিল। একদিকে সৎ ও যোগ্য নাগরিক তৈরির প্রত্যাশা অন্যদিকে কারিকুলামে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অনুপস্থিতি জাতিকে চরম ধোঁকায় ফেলে দিয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারসমূহ বহু ধারায় বিভক্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে একীভূতকরণ, সরকার কর্তৃক শতভাগ নিয়ন্ত্রণ, স্তর-পদবী, দক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুসারে শিক্ষকদের বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ, সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে পরিশোধের বিষয়টি বরাবরই এড়িয়ে গেছে। ফলে অদ্যাবধি শিক্ষকতা পেশায় মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। তুলনামূলক কম মেধাবী ও দলীয় পরিচয়ে অনেক অযোগ্য লোক শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছে। ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডিতে সভাপতি পদে রাজনৈতিক মনোনয়ন, রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অযাচিত হস্তক্ষেপ শিক্ষা ব্যবস্থাকে কলুষিত করেছে নিঃসন্দেহে। এসব কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা, দলীয় রাজনীতির প্রভাব, ঘুষ ও দুর্নীতি দিন দিন প্রসার লাভ করেছে। অধিকন্তু নোট ও গাইড বই অনুসরণ, প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্য আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রভাবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নিকট মানবিক গুণাবলি ও সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের চেয়ে জিপিও আর সার্টিফিকেট অর্জনই একমাত্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি-বেসরকারি পাহাড়সম বৈষম্য জাতির চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে চরম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। দেশের শতকরা ৯৭ নব্বই ভাগ শিক্ষার্থীর দায়িত্ব পালনকারী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা চরম বৈষম্যের শিকার যুগ যুগ ধরে। শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৮০ সালে বেসরকারি শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত করে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। মূল স্কেলের ৫০% সরকার থেকে অনুদান দেয়ার সিস্টেম চালু করা হয়। পরবর্তীতে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বছরে দুইটি উৎসব বোনাস (শিক্ষক মূল স্কেল এর ২৫% এবং কর্মচারী ৫০%) এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের আওতায় আনা হয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, অদ্যাবধি চাকরির নিরাপত্তা, পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বাসাভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, আপ্যায়ন ভাতা, বিনোদন ভাতা, বদলি ও প্রমোশন কোনটিই জোটেনি বেসরকারি শিক্ষকদের কপালে! আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই বেসরকারি শিক্ষকদের সন্তানের জন্য নেই কোনো শিক্ষা ভাতা, নেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোটা, নেই কোনো পোষ্য কোটা। যা অন্যান্য সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান। এসব সমস্যা সমাধানের একমাত্র সমাধান হলো বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের জাতীয়করণ। আমরা জানি, পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে শিক্ষকদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হয়। শ্রীলংকায় শিক্ষকদের মন্ত্রীর মর্যাদা দেয়া হয় আর আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র উচ্চতর বেতন স্কেল প্রদান করা হয়। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারে উপযুক্ত ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে শিক্ষা কমিশন গঠনের দাবি জানাচ্ছি। আমাদের শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সফলতার অন্যতম পদক্ষেপ হোক শিক্ষকদের সরকারি-বেসরকারি বৈষম্যের অবসান হোক, এটাই প্রত্যাশা। অন্তর্বর্তী সরকার, আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচিত সরকার, রাজনৈতিক সরকার, বেসরকারি শিক্ষকদের ব্যাপারে যেই লাউ সেই কদু। মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। সবার বেলায় ষোল আনা আর বেসরকারি শিক্ষকদের বেলায় চার আনা বা সিঁকিভাগ। ৯৮ ভাগ শিক্ষার্থীদের ভাগ্য গড়ে দেন বেসরকারি শিক্ষক সমাজ সেই শিক্ষক সমাজের ভাগ্যে শুধু মূলা আর মূলা, তাই তো ৫৩ বছর পরেও আজ বেসরকারি শিক্ষকদের ভাগ্যের পরিবর্তন সম্ভাব হচ্ছে না। তা হলে শিক্ষক সমাজ দ্রব্যমূল্যের আগুনের বাজারে কীভাবে বাঁচবে? বিশ্ব শিক্ষক দিবসে বেসরকারি শিক্ষক, কর্মচারীদের অনেক দাবি, আশা আকাক্সক্ষা, প্রত্যাশা কিন্তু তার প্রতিফলন ঘটেনি। তারা হতাশ হয়েছে। ক্ষোভ করে ফেসবুকে নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন। কেননা এমপিওভুক্তিতে শিক্ষক-কর্মচারীরা যে অর্থ পান, তা দিয়ে লাগামহীম দ্রব্যমূল্যের বাজারে তাদের পরিবার চালাতে কষ্ট হয়। এটি যেন দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিদের নজরে আসেনি। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের তুলনায় শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে আমাদের অবস্থান তলানীতে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা হাস্যরসের খোরাক হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। সর্বোচ্চ পর্যায়ে শিক্ষাখাতকে প্রাধান্য দেয়া, মাধ্যমিক শিক্ষাকে গতিশীল করা, মাধ্যমিক পর্যায়ে মেধাবিকাশে প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা চালুকরণ জাতীয়করণ ছাড়া সম্ভব নয়। বর্তমানে শিক্ষকতার পেশাটাকে মুখে মুখে সম্মানজনক পেশা বলা হলেও গ্রেড অনুপাতে বেতন, কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর বোর্ডের আচরণ, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা আর সিঁকি উৎসবভাতা, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষকদের উচ্চতর স্কুল থেকে বঞ্চিত রাখা কিন্তু অন্যটা প্রমাণ করে। আমরা যে শতভাগ অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার তা কিন্তু এই বেতন ও সামান্য সুবিধা প্রমাণ করে। এই পেশার এই অবমূল্যায়ন আর সিঁকি সুবিধা প্রত্যক্ষ করে মেধাবীরা এ পেশায় আসতে চায় না। এনটিআরসিএ নিয়োগ পেয়েও অনেক যোগদান করেনি। এতে আরও প্রমাণ হয় যে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। অন্যান্য চাকরি বঞ্চিত হলে একান্ত বাধ্য হয়ে তারা এ পেশায় এলেও বেতন, ভাতা ও মূর্খ পরিচালনা কমিটি দেখে পড়ানোর মানসিকতা পরিবর্তন করে তারা এটাকে চাকরি হিসেবে বেছে নেয়া সেবা হিসেবে নয়। এটা জাতির জন্য অশনিসংকেত। অভাবগ্রস্ত শিক্ষকরা মানসিক ভাবেও বিপদগ্রস্ত। অভাব যখন চারদিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে তখন নিদারুণ কষ্টের ভান্ডার থেকে সৃজনশীল কিছু পাওয়ার চিন্তাই বৃথা। তাই অতিশীঘ্র জাতীয়করণ না হলে এ শিক্ষা ব্যবস্থায় অরাজকতা বৃদ্ধি পাবে, শিক্ষায় প্রতিযোগিতা আরও কমবে এবং এসব সেক্টরে প্রচ- অসন্তুষ্টি দেখা দেবে। আমাদের দেশের চেয়েও অনুন্নত বেশ কয়েকটি এশিয়ান রাষ্ট্রে শিক্ষা খাতে সর্বনিম্ন জিডিপি ৩.৫০ বা ৪ শতাংশ সেখানে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হয়েও আমাদের জিডিপি ২.০৯ শতাংশ। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা, প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাণবন্ত করতে, আশানুরূপ ফলাফল পেতে জাতীয়করণ একান্ত প্রয়োজন। বিশাল বাজেটের আংশিক এবং প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের আয় জমা নিয়ে জাতীয়করণ করলে শিক্ষক/শিক্ষার্থী যেমন উপকৃত হবে তেমনি আমাদের শিক্ষায় আন্তর্জাতিক মান ও কৌশল অবলম্বন করে বাস্তবিক প্রয়োগ সম্ভব হবে। বেসরকারি শিক্ষকদের হাহাকার নিরসনে এবারই জাতীয়করণের মোক্ষম সুযোগ। ব্যয়ের অতিরিক্ত অর্থে জাতীয়করণ সম্ভব। মেধাবীদের শিক্ষকতায় আনতে, শিক্ষায় প্রাণ ফিরাতে জাতীয়করণের বিকল্প নেই। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড হলে শিক্ষকরা শিক্ষার মেরুদন্ড। কিন্তু আজ শিক্ষক সমাজ অবহেলিত ও বিভিন্নভাবে হয়রানি -নির্যাতনের শিকার। শিক্ষকদের চাকরির নিরাপত্তা, আর্থিক সচ্ছলতা, সামাজিক মর্যাদা নেই বলে মেধাবীরা এই পেশায় আসতে চান না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষকরা রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হয়ে চাকরি হারিয়ে পথে পথে ঘুরছেন। শিক্ষকদের চাকরির নিরাপত্তা নেই বলেই আজ শিক্ষার বেহাল অবস্থা। এলাকার কিছু কুচক্রী মহল, তথাকথিত কিছু শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ভুল বুঝিয়ে, প্রভাবিত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তাদেরকে ফিরিয়ে আনছে। স্থানীয় প্রশাসন, সেনাবাহনী বিষয়টি বুঝতে পেরে শিক্ষা উপদেষ্টার নির্দেশে এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে থাকায় বিষয়টি অনেকটা কমে গেছে। একশ্রেণীর সুবিধাবাদী, মামলাবাজ, চাঁদাবাজ নেতা মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি করতে ২০১৮ ইং সালের ঘটনা উল্লেখ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান যাদের কোন আওয়ামীলীগের পদ পদবি নেই, এমন কী আওয়ামীলীগের প্রাথমিক সদস্য পদ নেই তাদেরও মামলায় হয়রানি ও মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি করার জন্য আসামি করা হয়েছে। তবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ, সহকারী প্রধান, সহকারী শিক্ষক আওয়ামীলীগ দলীয় পদ-পদবি গ্রহণ করে মাদার অফ মাফিয়া অধীনে অনুষ্ঠিত সকল নির্বাচনে নিয়ম ভঙ্গ করে প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছেন। লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে হাজার হাজার ব্যালট পেপারে আগাম নৌকায় সীল মেরে আওয়ামীলীগ প্রার্থীদের বিশাল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ওইসব সুবিধাবাদী বিএনপির নেতারা রহস্যজনক কারণে কোন কথা বলছেন না। মামলা করলেও তাদের আসামি করছেন না। এমনকি পদপদবীধারী আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলালীগের নেতারা নিয়োগবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হাটঘাট, করিডোর, কাস্টম, সাব-রেজিস্টার অফিস, বালুমহল, জলমহল, খাসপুকুরসহ বিভিন্নভাবে কোটি কোটি কাল টাকার সম্পদ গড়েছেন তাদেরকে আসামি না করে বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মী, সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিষ্টসহ তৃণমূল বিএনপির কর্মী, শ্রমিক, কলেজ শিক্ষকেও আসামি করেছেন ফলে দলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এ নজিরবিহীন ঘটনাটি ঘটেছে রাজশাহীর গোদাগাড়ী মডেল থানায় দায়েরকৃত ২টি মামলায়। রাজশাহী জেলা কৃষকদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল হামিদ বাবলু গত ২৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ প্রায় ৪৫ জন নামসহ অজ্ঞাত আরো ৫০০-৬০০ জনের নামে মামলা করেন। বাদী নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য ও ব্যক্তিগত আক্রোশের জেরে বিএনপির ৬-৭জন নেতাকর্মীর নামে মামলা দিয়েছেন, সেখানে বিএনপির নেতা কলেজ শিক্ষক সুমনকে আসামী করা হয়েছে। একই কায়দায় গত ২৮/০৮/২৪ ইং তারিখে গোগ্রাম ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুর রউফ দিলীপ গোদাগাড়ী মডেল থানায় মামলা করেন যার নম্বর ৩২, ওই মামলায় ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে ৫০/৬০ কে আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় বিএনপি পরিবারের সদস্য, সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট, প্রধান শিক্ষক মোঃ হায়দার আলীসহ কয়েকজনকে অসৎ উদ্দেশ্যে জড়ানো হয়েছে। এ মামলার ভিলেন তথাকথিত বিএনপির নেতা প্রভাষক অব্দুল মালেক। অথচ যারা আওয়ামীলীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের পদধারী নেতাদের মামলায় আসামি করা হয় নি বাদীর বাড়ির পাশে অবস্থান করা নেতা যারা নির্বাচনী অফিস, বাড়ি ভাংচুর, আগুন দিয়েছেন ওই সব নেতাদের আসামি করা হয়নি। তথাকথিত বিএনপির নেতা মামলাবাজ, চাঁদাবাজ প্রভাষক আব্দুল মালেকের কূটকৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছেন যারা লাখ লাখ টাকা। এ কারণেই আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষকলীগ, আওয়ামীলীগের নেতা ও মেয়র, উপজেলার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, এমপি ফারুর চৌধুরীর ডান হাত বাম বলে খ্যাত, থিম ওমর প্লাজায় বসে কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য, খাস পুকুর বাণিজ্য, খাদ্য গুদামসহ বিভিন্ন প্রকল্প করে লুটে নিয়েছেন কোটি কোটি, ওমর প্লাজায় ফ্ল্যাট, দোকান বাড়ি কিনেছেন রহস্যজনক কারণে মামলার আসামি করা হয়নি। মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। অবিলম্বে মামলা থেকে ওই সাংবাদিক, বিএনপির নেতা কর্মী নাম প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মীরা গোদাগাড়ী উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে মিথ্যা মামলাবাজ ওই দুই নেতার বহিষ্কার দাবি করেছেন। উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালাম শাওয়াল, সাধারণ সম্পাদক আনারুল ইসলাম কেন্দ্রীয়কমিটিসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন। ওই সব সুবিধা নেতারা কেন্দ্র, বিভাগ, জেলা, উপজেলার সিদ্ধান্ত ছাড়ায় মামলা করেছেন। ব্যক্তিস্বার্থে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজির ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এ চিত্র শুধু গোদাগাড়ীতে নয়, দেশের অন্য অন্য স্থানে ঘটছে, বিএনপির দু’গ্রুপের সংঘর্ষে কয়েকজন মারা গেছে, যৌথবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছে অনেক বিএনপির নেতা। মারা গেছেন, আহত হয়েছেন অনেকে, কিছু সুবিধাবাদী নেতা বহিষ্কার হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, লুটপাট, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন মামলা হচ্ছে, অভিযোগও বিস্তর যা পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, আনলাইন নিউজ পোটাল, টিভি নিউজসহ বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে। শিক্ষক পেশা এমনই সবসময় হয়রানি, মামলার স্বীকার হতে হয়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সর্বপ্রথম বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের ১/১/১৯৮০ থেকে জাতীয় বেতনের স্কেলের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং ৫০% বেতন স্কেল প্রদান করেন। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ ১০%+১০% = ২০% প্রদান করেন। ১৯৯৪ সালের শিক্ষক আন্দোলনে তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ১০%, ২০০০ সনে আন্দোলনে তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০% এবং সর্বশেষ ২০০৬ সনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ১০% বেতন প্রদান করে ১০০% এ উন্নীত করেন। এখন চাকুরি জাতীয়করণের কোনো বিকল্প নেই। চাকুরি জাতীয়করণের জন্য সরকারের অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন নেই। বর্তমানে শিক্ষক কর্মচারীরা সরকার থেকে ১০০% বেতন পান। এজন্য সরকারকে প্রদান করতে হয় প্রতি মাসে প্রায় ১০০০ কোটি টাকা মাত্র। ১২ মাসে সরকারকে দিতে হয় ১২০০০ কোটি টাকা মাত্র। প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হলে সরকারকে প্রদান করতে হবে মোট প্রায় ১৭৮২০ কোটি টাকা প্রায়। বর্তমান সরকার বেতন বাবদ প্রদান করছে ১২০০০ কোটি টাকা। অতিরিক্ত প্রদান করতে হবে প্রায় ৫৮২০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারের আয় হবে প্রায় ৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। শিক্ষকগণ হচ্ছেন জাতির বিবেক ও মূল্যবোধ সংরক্ষণের ধারক ও বাহক। শিক্ষার সংস্কার, সম্প্রসারণ ও মান উন্নয়নে সরকার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিবেন বলে শিক্ষক সমাজ প্রত্যাশা করে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের কাছে বেসরকারি শিক্ষক সমাজের প্রাণের দাবি একটায় সেটা হলো বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একযোগে জাতীয়করণ করা। এ ঘোষণার অপেক্ষায় শিক্ষক সমাজ তীর্থের কাকের ন্যয় চেয়ে আছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের জন্য যে বিনিয়োগ হবে সেটা হবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ, মহৎ, বিনিয়োগ। এ কাজটি করতে পারলে জাতী আপনাদের আজীবন স্মরণ করবেন। লাখ লাখ শিক্ষা পরিবারের সদস্যগণ আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবেন।
লেখক : মোঃ হায়দার আলী