দেশপ্রেম! যাদের মধ্যে আছে তাদের সাথে এ বিষয়ে আলাপ করা যায়। এদেশের কৃষক দেশপ্রেমিক। গ্রীষ্মের কড়া রোদ, বর্ষার অঝোর ধারা এবং হাড়কাঁপানো শীত উপেক্ষা করেও তারা সোনালি ফসল ফলানোর স্বপ্নে বিভোর। কিন্তু যাদের ছেলে-মেয়ে বিদেশে পড়ে এদেশে না ফেরার উদ্দেশ্যে, শুধু খাবার খরচ রেখে যাদের আয়-বেতনের সব টাকা ডলার-পাউন্ড-রুপিতে পরিবর্তন হয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়, তাদের সাথে দেশপ্রেমের আলাপ করা বৃথা। তাদের থেকে দেশপ্রেমের ওয়াজ শোনা সময় হত্যা করার শামিল। যে ইন্ডিয়ান-শ্রীলঙ্কান কিংবা পাশ্চাত্য-আমেরিকান বাংলাদেশে কাজ করে এবং মাসের শেষে সব পয়সা পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেয় সেই মানুষগুলোর থেকেও যারা বাংলাদেশি হয়ে এদেশের কৃষক মজুরের রক্ত-ঘামে অর্জিত অর্থ কানাডা-আমেরকিায় অবৈধভাবে পাচার করে, তাদের মত বেইমান আজও কৃষক-মজুর হতে পারেনি! আমাদের দেশে কিছু সংখ্যক মানুষের মুখে দেশপ্রেমের আলোচনার অর্থ সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে, চোখে ধুলা দিয়ে নিজের ও পরিবারের আখের গোছানো। এখানে রাজনীতি করে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে বিদেশে শত শত বাড়ি কেনা যায়, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটে লাখ কোটি টাকা মুনাফা করে বিদেশের ব্যাংকে মজুদ রাখা যায় কিংবা জনগণের সেবার নামে শুষে খেয়ে বেগমপাড়া বানানো যায়। জনতার সামনে যারা বড় গলায় দেশপ্রেমের কথা বলেছে, সভা-সেমিনারে জুনিয়রদের দেশপ্রেমের দীক্ষা দিয়েছে তাদের অনেকেই দেশটাকে হরিলুটের নেতৃত্ব দিয়েছে। স্বাধীনতার তেপ্পান্ন বছরে দেশের অর্থনৈতিক ভিত এখনো মজবুত হয়নি। এই দেশের অভ্যন্তরে এখনো দৃশ্যমান যে সম্পদ তারচেয়ে এদেশের কতিপয় মানুষের বিদেশে অদৃশ্যমান সঞ্চয় বেশি। নয়তো বিগত দেড় দশকে ৯৩ বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচারের সংবাদ শুনতে হতো না। বিশ্বের ৯০ টি দেশের সম্মিলিত রিজার্ভের চেয়েও বাংলাদেশ থেকে ১৬ বছরে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে। ভাবতে পারছেন? এই অর্থপাচারের সক্ষমতা কাদের আছে! দেশপ্রেমের গল্প শুনিয়ে এই জাতিকে আর সান্ত¡না দেওয়া যাবে। দেশপ্রেমিক হিসেবে যদি কাউকে সম্মান জানাতেই হয় তবে সেটা পরিবার-পরিজন ছেড়ে বাংলাদেশে থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমানো কয়েক কোটি রেমিট্যান্স যোদ্ধাকে স্যালুট জানাতেই হবে। অমানুষিক পরিশ্রম এবং অমানবিক জীবনযাপন করে যে শ্রমিকরা তাদের আয়ের সবটুকু অর্থ বাংলাদেশে প্রেরণ করে, সেই তাদের টাকাতেই মূলত বাংলাদেশ এখনো টিকে আছে। কী দুর্বিষহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে বছরের পর বছর একজন শ্রমিক মরুভূমির নির্জনতার মাঝে, ভিনদেশি চরিত্রের ও বহুভাষীর মাঝে ছোট-বড় সব ধরনের ফুট-ফরমায়েশ খেটে অর্থ আয় করে দেশে পাঠায় তা দেশপ্রেমের ধ্বজাধারী অনেক নালায়েক কল্পনাও করতে পারে না। গার্মেন্টসের শ্রমিকদের রাত-দিন একাকার করে করা পরিশ্রম, কৃষক-শ্রমিকের নিরলস প্রচেষ্টা যদি স্বার্থহীন না হতো তবে যারা দেশপ্রেমের বুলি আওরে নিজেদের আখের গোছায়, তারা কবেই এদেশটাকে বিক্রি করে পগারপার হত- তা আন্দাজের বাইরে! এখনো এখানে গুড় আছে বলে কয়েকটি শ্রেণি দেশপ্রেমের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে এদেশে রয়ে গেছে। আমেরিকা-কানাডায় বাড়ি খুঁজছে! উদ্দেশ্য পূরণ হলেই ঘটিবাটিসহ চম্পট দেবে। যতদিন সুযোগ আছে ততদিন লুটেপুটে খাওয়ার জন্য এখানে ওঁৎপেতে আছে। তাদের চিহ্নিত করা জরুরি। যারা মাইক পেলে লম্বা লম্বা বুলন্দ আওয়াজে দেশপ্রেমের গল্প শোনায় তাদের অনেকের বাস্তবতাই দেশদ্রোহিতার শামিল। শতকোটি টাকার দুর্নীতির গল্প, অর্থপাচার কিংবা দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ না করা- কোন অঙ্কেই এসব দেশপ্রেম ফ্রেমে ফালানো যায় না। এদেশের কোন ভবিষ্যৎ নাই ভাবনায় যারা সন্তান-স্ত্রীকে স্থায়ীভাবে বিদেশে পাঠাতে ব্যস্ত, তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের ঈমান খুঁজতে যাওয়া কিংবা দেখতে চাওয়া উচিত হবে না। দুর্নীতি করে কামাই করা অর্থ যদি দেশের গ-িতে থাকে তাতেও কিছু কর্মসংস্থান তৈরি হয়। দুর্নীতিবাজ নৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এই দুর্নীতিতে দেশ ততোটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। অথচ বৈধ-অবৈধ পথে অর্জিত অর্থ যখন দেশ থেকে পাচার হয়ে যায় তখন দেশের সক্ষমতার মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়ে। অত্যন্ত বিস্ময়ের যে, রাজনৈতিক পক্ষ বিপক্ষের কারণে যে আমেরিকাকে অপছন্দ করি, স্বাধীনতা-শোষনের প্রশ্নে যে বৃটিশ আমাদের ঐতিহাসিক শত্রু, জাতীয়তার পক্ষ-বিপক্ষের বিতর্কে যে ইন্ডিয়ার সাথে সম্পর্ক টেকসই হয়নি কিংবা সাংস্কৃতিক বিতর্কে যে দেশগুলোকে অপসংস্কৃতির তীর্থস্থান ঠাহর করি- আমাদের অর্থপাচারের গন্তব্য, আমাদের ভবিতব্য জীবনের আশ্রম সেই দেশগুলোই। এদেশের অনেক কথিত দেশপ্রেমিকের সন্তান, যারা তাদের বর্তমান ঠিকানায় আর কোনদিনই বাংলাদেশ লিখবে না, তারা সেসব দেশে বড় হচ্ছে, পড়াশুনা করছে। আমাদের কাগুজে দেশপ্রেমের চেয়ে বিশ্বাসের দেশপ্রেম যখন পাতলা হয়েছে তখন থেকেই এদেশের ভাগ্য বদলের লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি বিঘিœত হয়েছে। যৌবনকালে এদেশ হাতিয়ে যাদের অবসরকাল-বৃদ্ধকাল আমেরিকা-কানাডার পরিবেশে কাটবে বলে স্থির ছিল, তারা কোনদিনই এদেশকে মন থেকে ভালোবাসেনি। দেশ পরিচালনার দায়িত্বের সিংহভাগ যেহেতু এই শ্রেণির হাতে থেকেছে সেহেতু অন্যকেউ এদেশে নির্ভরতা-নির্বিঘেœ বসবাস করুক, সিস্টেমেটিক গোছানো দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তৈরি হোক- সে পরিস্থিতি উদয় ঘটেনি বরং স্বয়ংক্রিয়ভাবে যা ভালো তাও নষ্ট করার খেলা চলেছে। অথচ শাসক-সেবকদের মধ্যে যদি সত্যিকারের দেশপ্রেম থাকতো তবে উন্নত দেশের সিস্টেম এদেশেও রান করতো। বিদেশে পড়তে গিয়ে শিক্ষার্থীরা আবার দেশগঠনে ফিরে আসত। শিশুরা জন্ম থেকেই যে দেশের সবকিছু নড়বড়ে দেখে সেদেশের প্রতি তরুণ-যুবকদের প্রেম দানা বাঁধবে না- এটাই স্বাভাবিক কিনা? ছদ্মবেশী দেশপ্রেমিকদের লুটপাট এবং নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার খেসারত গোটা জাতিকেই দিতে হচ্ছে। এটা আরও কতদিন চলবে জানি না। তবে এই অধর্মের লাগাম টানার বসন্তকাল চলছে।
লেখক : রাজু আহমেদ