গত বছর যখন দেশে গেলাম,বুবনদের বাসার সেই কাঁঠালীচাঁপা গাছের দিকে চেয়ে আমার কত কিছু যে মনে পড়ে গেল। ও বুবনের গাছ তুমি এত বড় হয়ে গেছ বুবনের মতই ! মনে পড়ে তোমার বুবনকে? কত ছড়া শুনিয়েছে তোমাকে ,কত গান শোনাতো ,ও কাঁঠালীচাঁপা মেয়েটিকে মনে পড়ে ?
বুবন যে শুধু আমার স্কুল সহপাঠী ছিল তা নয় ,সে ছিল আমার প্রতিবেশী। সে সবার তুলনায় কিছুটা অন্যরকম ছিল বলেই ওকে আমার কেন যেন ভাল লাগতো। আমরা সবাই যখন রান্নাবাটি খেলতাম হাড়ি পাতিল নিয়ে তখন সে কিছুতেই মেয়েদের মত রান্নাতে রাজি হতো না। সে বলত সে হবে ছেলে,সে বাজার ঘাট করবে। (মানে ফুল পাতা এগুলো জোগাড় করা ) ছেলেদের কাজগুলো বেছে নিতো বেশীরভাগ সময়। কিন্তু আমরা মাঝে মাঝে রাজী হতাম না।ওকে বলতাম তোমাকেও রান্না করতে হবে ,আজ আমরা বাজার করবো। ও অবশ্য রাগ করতো না কিন্তু বোঝা যেত যে অনিচ্ছাসত্ত্বেও করছে।
পুতুল খেলা নিয়েও একবার তুলকালাম হল আমাদের সবার সাথে। সে কিছুতেই পুতুল বিয়ে দেবে না। ওরা ছিল মেয়ে পক্ষের পুতুল দল। কিন্তু পুতুল বিয়ে না দিলে কি পুতুল খেলায় মজা আছে? কে কাকে বোঝাবে। অবশেষে পরিকল্পনা করলাম মজার খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হবে সবার বাড়ি থেকে। বিশাল আয়োজন করে পুতুল বিয়ে হবে। বুবন দেখলাম কিছুটা রাজী হল শেষমেষ। কিন্তু পুতুল বিয়ের দিন বুবন ভীষন কাঁদলো। কান্না থামানোই যাচ্ছে না। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে সে চোখের পানি একটি পাত্রে জমাচ্ছিল। সে পাত্র থেকে একটা কাঁচের বোতলে নিয়ে রাখলো। আমি তো অবাক। কি ব্যাপার বুবুন? কেন জমাচ্ছ ? সে উত্তর দিল;
: আমি সহজে কাঁদি না,আম্মু পেটালেও না। তাই যখন কাঁদি তখন পানি জমিয়ে রাখি।
ও কি স্মৃতি জমালো ? এমন আমি আর দেখিনি কখনো !
কষ্টের ব্যাপার হল পুতুল বিয়ের পর থেকে সে আমাদের সাথে আর খেলতে আসতো না। সেই থেকে শুরু হল তার কাঁঠালীচাঁপা গাছের সাথে জীবন।
দুপুরে বেশীর ভাগ সময় কাঁঠালীচাঁপা গাছের ডালে বসে থাকে ও।হাতে কাগজ-কলম,ছড়ার বই দেখতাম। কি কী যেন পড়তো ,লিখতো ,গান গাইতো গাছের উপরে বসে। ওকে ডাক দিলে বলতো ,"আমি পড়ালেখা করছি ,খেলবো না। এ গাছটা আমার ঘর।"
কিছুদিন পর দেখি গাছের নীচে একটি চারকোনা গর্ত খুঁড়ে সেখানে পানি জমিয়ে পুকুরের মত করেছে। চারপাশ আবার মাটি দিয়ে লেপে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলে বলল ,"এটা আমার পুকুর ,পোনা ছেড়েছি।"
গাছের উপর থেকে একটা দড়ি ফেলে রাখতো সেই বানানো পুকুরের পানিতে। সে নাকি মাছ ধরছে।
ওর জীবন কাটতে লাগলো ওই গাছের সাথে। গাছের গায়ে আবার নিজের নাম খোদাই করা ''বুবনের বাড়ী”।
এর কিছু কাল পর বুবনকে দেখা যেতো পাঁড়ার ছেলেদের সাথে হলুদ গেঞ্জি স্কার্ট পরে ফুটবল খেলছে। আমার চোখ ছানাবড়া। আমরা তখন ক্লাস ৭ এ পড়ি। এত বড় মেয়ে গোলকিপার হয়েছে। ভীষন আনন্দ চোখে মুখে। তুমুল খেলছে সে। ছেলের দল ওকে ডাকা সুরু করেছে বব।পু রো টম বয় হয়ে গেল। শ্যামলা ছিল,রোদে পুড়ে হয়ে গেল কালো কুঁচকুঁচে।
গত বছর ঢাকায় হঠাৎ করে মগবাজার মোড়ে বুবনের সাথে আমার দেখা হয়ে যায় কাকতালীয় ভাবে। ওর সাথে ওর ছোট্ট মেয়েকে দেখলাম। কি সুন্দর যে হয়েছে মেয়েটাটা। ওর সাথে ওদের বাসায় চলে গেলাম। গিয়ে দেখি ঘরের দেয়ালগুলো আর আস্ত নেই। আঁকাআঁকিতে ভরা। বাচ্চাটা এঁকেছে বোঝাই যাচ্ছে। খেয়াল করে দেখলাম সাইন পেন দিয়ে ফুলের মতো গাছের মতো কি কী যেন এঁকেছে।
আমি বুবন কে ডেকে বললাম ,"তোর মেয়ে এ ফুলগুলো এঁকেছে?"
ও বলল ,"হু"... ও যেন একটু লজ্জা পেল। আমি জিগেশ করলাম "কি ফুল ?"
বলল ,"কাঁঠালীচাঁপা "।
আমি বললাম ,"শুধু কি ও এঁকেছে না তুই ও এঁকেছিস?"
বুবন বলল ,"হু আমি এঁকেছি।"
বললাম ,"তুই মেয়েকে এ ফুল আঁকা শিখিয়েছিস ? তোরা দুজন তো ঘরের দেয়াল শেষ করে ফেলেছিস। হা হা হা হা।"
বুবন ভীষন হাসছিল আমার সাথে ,আর ওর বাবুটাও না বুঝে হি হি করছিল আমাদের সাথে। আমি বললাম ,"খুব ভাল করেছ ,দাও আমাকে কালার পেনসিল দাও। আমিও একটা কাঁঠালীচাপা ফুল এঁকে দেই তোমার দেয়ালে।"
আমি ওদের দেয়ালে আঁকতে যেই গেছি অমনি ওরা মা, মেয়ে মহা উৎসাহে আমার সাথে আবার আঁকতে লেগে গেল। বাইরে শহরের দানবীয় ব্যস্ততা ছাপিয়ে বুবনদের বাড়িতে ফুলের ঘ্রানে যেন মৌ মৌ করছে চারপাশ।