প্রথমেই যে পরিচয় আমি গর্বের সাথে দেই, আমি একজন বাংলাদেশী নাগরিক। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক। সারা পৃথিবীতে হাতেগোনা যে কয়েকটি জাঁতি সংগ্রাম করে, লড়াই করে রক্ত দিয়ে নিজেদের রাষ্ট্রের স্বাধীনতা নিয়েছে তাঁর মধ্যে একটি রাষ্ট্র আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ। আজ আমি যে ভূখ-ে স্বাধীন একজন নাগরিক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছি সেই রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি তাঁর জীবনের ৮০ ভাগ সময় এই দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। আর এই লড়াই করতে গিয়ে জেল-জুলুম সব কিছু মাথা পেতে নিয়েছেন। পরিবার, স্ত্রী সন্তান সব কিছুর উর্ধ্বে যিনি রেখেছিলেন তাঁর দেশকে। নির্ভীক, সাহসী, ন্যায়পরায়ন মানুষটা আমার কাছে এদেশের অস্তিত্বের নাম। যাকে ছাড়া বাংলাদেশ কল্পনা করা যায় না। সহজ ভাষায় পত্রিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুর আরেক নাম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব অচল, আর এই কারনেই হয়তো এই মানুষটাকে হত্যা করেই থেমে থাকেনি অপশক্তিরা, তাঁর নামটা মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাঁরা ভুলেই গিয়েছিল গাছের গোড়া শেকড় এর সাথে আটকে থাকে, আর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামক সেই গাছটার শেকড়।
আমার কাছে তিনি ন্যায়ের সংগ্রামের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এবং নির্ভীক সাহসিকতার আদর্শের নাম। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কারিগর ছিলেন তিনি, তাঁর জীবনের লড়াই আমার মনে করিয়ে দেয় আমার রক্তের ন্যায়ের তেজ। আজও বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ৭ মার্চ সেই ভাষন আমার রক্তে অন্যায়ের প্রতিবাদে অনুপ্রেরণা যোগায়। তাঁর বলা " আমাদের দাবায় রাখতে পারবা না" এটা পৃথিবীর সকল নিপীড়িত শোষিত মানুষের স্লোগান। তাঁর আত্মজীবনী পড়ে আমার সবসময় মনে হয়েছে তাঁর চিন্তা ভাবনার মাঝে সবসময় তারুণ্য ভর করতো, আমার মতে তিনি হয়তো কখনোই মানুষিক বার্ধক্য অনুভব করতেন না আর এজন্যেই হয়তো সবসময় কাজ করে যেতে চাইতেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের পাকিস্তান পিরিয়ড এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরের কয়েক বছর ছাড়াও তাঁর ছাত্র জীবনের একটা বড় অধ্যায় আছে তা ব্রিটিশ পিরিয়ডে আমরা সবাই মনে করি বঙ্গবন্ধু বুঝি ব্রিটিশ পিরিয়ডে শুধু পাকিস্তান এর জন্যেই আন্দোলন করে গিয়েছেন। কিন্তু এটি একদম ভূল ধারনা, তাঁর আরো উল্লেখ্য যোগ্য ভুমিকা ছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যা আমাকে অনেক বিষয়ে নতুন করে ভাবায়। তেমন ১৯৪০ এ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে হলওয়েল মনুমেন্ট ( যা নবাব সিরাজউদ্দৌলা কে অপমান করার জন্য বৃটিশ তৈরি করেছিল) অপসারণের জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এই আন্দোলন ঠেকাতে ব্রিটিশ যখন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে এরেস্ট করে তখন তাঁর বিরুদ্ধে উত্তাল হয়ে উঠেছিল বাংলার ছাত্র সমাজ, আর সেই উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই সময়ের ছাত্র নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইসলামিয়া কলেজ থেকে প্রায় কয়েক হাজার ছাত্র নিয়ে বিশাল মিছিল করে বিধানসভা ঘেরাও করতে গিয়েছিলেন সেদিন তিনি। " বিধানসভা ঘেরাও করো, সুভাষ কে ছিনিয়ে আনো, মুক্ত করো স্লোগানে সেদিন রাজপথ কেঁপে উঠেছিল। তখন পশ্চিম বঙ্গের সাবেক মূখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বিধানসভার নব্য বিধায়ক। উনিও অন্য বিধায়কদের সাথে মিছিল প্রতিরোধ করতে বেড়িয়ে এসেছিলেন। বিধায়কদের সাথে ছাত্রদের ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর ধাক্কায় জ্যোতি বসু পড়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু যখন কোলকাতা যান জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করে বিনয়ের সাথে ক্ষমা চেয়েছিলেন। জ্যোতি বসু অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, পরবর্তীতে তিনি সবাইকে বলেছিলেন সেই চল্লিশের দশকের ঘটনা আর ৭২ এ শেখ মুজিব ক্ষমা চাইতে এসেছ, সে অবশ্যই একজন গ্রেট লিডার। একটাই স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তখন তিনি বিশ্ব নেতা অথচ নিজের অতীতের আচরনের জন্য ক্ষমা চাইতে একটুও কুন্ঠাবোধ করেননি। এটা জানার পর আমার কাছে যেমন অবাক লেগেছিল তেমনি একটি শিক্ষা পেয়েছিলাম ক্ষমা শ্রেষ্ঠত্ব কে ছোট করে না বরং আরো উঁচু স্তরের মানুষ করে তোলে।
সাধারন মানুষের দুঃখ দুর্দশার মাঝে যে আবেগ তাঁর মধ্যে কাজ করতো সেটাই তাঁকে প্রতিবাদী করে তুলেছিল, তা তাঁর মনের গভীরে স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রেরনা কে জাগিয়ে তুলেছিল। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন অধিকার পেতে হলে নীরব থাকা যাবে না, জেগে উঠতে হবে এবং সবাইকে জাগাতে হবে। তাঁর নিজের ভেতরের স্বাধীনতার প্রজ্জল্যমান আলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে, পুরো দেশকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করতে হবে। তবেই স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হবে তা আমার কাছে আজকের তরুণ প্রজন্মের জন্য একতাবদ্ধ লড়াইয়ের শিক্ষা এবং অনুপ্রেরণা। তাঁর ৭ মার্চ এর ভাষা এর বড় প্রমান। " বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো" এই স্লোগান তিনি ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন একটা জাতির মানুষের মনের গভীরে। আমার কাছে বঙ্গবন্ধু গনতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে একজন মহান আদর্শিক মহাপুরুষ। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র কে ১০ মাসের মাথায় লিখিত সংবিধান উপহার দিতে পেরেছিলেন তিনি। তিনি সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা দিয়ে পুরো জাতিকে সাম্যবাদের পথ দেখিয়েছিলেন। আজীবন তাঁর রাজনীতি ছিল অসহায় মানুষের সেবা করা এবং যেকোন অন্যায় এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। বঙ্গবন্ধুর কে ধামাচাপা দিতে গিয়ে এদেশের বিশাল একটি তরুন সমাজ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়েছে। এই রাজনৈতিক দৈন্যতা থেকে এ জাতিকে ফেরাতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে তরুন সমাজ কে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাঁর হার না মানা সংগ্রামমুখর লড়াই এর জীবন আজ আর নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখার উপায় নাই।
বঙ্গবন্ধু মানেই আমার কাছে পুরো বাংলাদেশ। ফ্রিড্রেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন " আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিব কে দেখেছি"। হ্যা এই মানুষটা তার জীবনকে হাসি মুখেই বাঙালি জাতির জন্ম উৎসর্গ করেছিলেন, আর এজন্যেই বাঙালি জাতির জন্য আজীবন লড়াই করে গিয়েছেন। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে এদেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং স্বাধীনতা অর্জনও করেছিল। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তিনি ধ্বংসস্তূপ এই রাষ্ট্র কে নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাড় করাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু স্বাধীনতার কয়েক বছর পরেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে তাকে হত্যা করে এদেশের কিছু বিপথগামী আর্মি অফিসার, আর তাদের পেছনে নেতৃত্ব দেয় এদেশের স্বাধীনতা বিরোধী চক্রটি।
কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা বঙ্গবন্ধু কে হত্যা করে তাঁর আদর্শ কে কি হত্যা করতে পেরেছে ঐ স্বাধীনতা বিরোধী চক্রটি। না পারেনি কারণ একজন মহাপুরুষ এর শরীরের মৃত্যু ঘটে কিন্তু তাঁর আদর্শের কখনো মৃত্যু ঘটে না। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন অসাম্প্রদায়িক, গনতন্ত্রবাদী এবং শোষিত নিপীড়িত মানুষের নেতা। এজন্যেই আমার কাছে বঙ্গবন্ধু একটি দেশের নাম, আমি বাংলাদেশ কে বুঝতে বঙ্গবন্ধু কে বুঝি। বঙ্গবন্ধু মানে আমার কাছে অসাম্প্রদায়িক, গনতন্ত্রবাদী, সমাজতান্ত্রিক চেতনাবোধ সম্পন্ন, ন্যায়পরায়ন সাহসী এবং নির্ভীক একজন মানুষ।।