দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন সপ্তম। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম। বিশ্বব্যাংক বলছে, ❝শুধুমাত্র গ্রীস্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বছরে গড় ক্ষতির পরিমাণ ইতিমধ্যে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ( মোট জিডিপির শুন্য দশমিক ৭ শতাংশ )। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ২৭ শতাংশ মানুষ বর্তমানে বন্যার ঝুঁকিতে আছে। চলতি শতাব্দীতে উপকূলীয় বন্যার এই ঝুঁকি বেড়ে ৩৫ শতাংশ হতে পারে। বর্তমানে বন্যায় উপকূলীয় এলাকায় বছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়। তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে এবং বৃষ্টিপাত ৪ শতাংশ বাড়লে ২০৫০ সাল নাগাদ বঙ্গোপসাগরে সমুদ্র পৃষ্টের উচ্চতা ২৭ সেন্টিমিটার অথবা তারও বেশি বাড়তে পারে । সমুদ্র পৃষ্টের উচ্চতা এভাবে বাড়লে সম্পদহানির ঝুঁকি প্রায় দ্বিগুণ, বর্তমানে যা বছরে আনুমানিক ৩০০ মিলিয়ন ডলার।❞ সিপিআরডি বলছে, ❝প্রাকৃতিক দুর্যোগে গত ২০ বছরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি পরিবারের গড়ে ৪ লাখ ৬২ হাজার ৪৯১ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকা অঞ্চলের শরীয়তপুরে এই ক্ষতির পরিমাণ গড়ে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৩৩০ টাকা। আর বরেন্দ্র অঞ্চলে গড়ে ৩৩ হাজার ৭৬৯ টাকা ক্ষতি হয়েছে।❞ এছাড়াও উপকূলীয় অঞ্চলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাড়ছে। লবনাক্ততায় সুপেয় পানির সংকট বাড়ছে এবং কৃষি উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটছে। উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে নাজুক বেড়িবাঁধের কারণে এখানকার মানুষেরা বারোমাস আতংকে থাকে।
এছাড়াও বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যা প্রকট। পরিবেশ রক্ষা সূচক ২০২২: বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭ তম। বাংলাদেশ শব্দ ও বায়ু দূষণে শীর্ষে; ঢাকা শহর শব্দ ও বায়ু দূষণে বিশ্বে শীর্ষে। বাংলাদেশে ৩২ শতাংশ মৃত্যু পরিবেশ দূষণের সাথে সম্পর্কিত এবং বায়ু দূষণের কারণে বছরে জিডিপির ক্ষতি হয় ৯ শতাংশ। বিভিন্ন প্রকার দূষণজনিত কারণে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ২ লাখ ১৫ হাজার ৮২৪ জনের মৃত্যু হয়। এরমধ্যে শুধু বায়ু দূষণের কারণেই সর্বাধিক ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫১৫ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়াও কয়লার ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়া, দেশ জুড়ে বনাঞ্চল উজাড়, পাহাড়-টিলা কাটা, নির্বিচারে গাছ কাটা, নদী-খাল-জলাশয়, দখল-দূষণ-ভরাট করা, বন্যপ্রাণী হত্যা, দূর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা রয়েছে।
'সেইভ ফিউচার বাংলাদেশ'এর প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান সমন্বয়ক, জলবায়ু কর্মী নয়ন সরকার বলেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রিতে রাখার চুক্তি হয় কিন্তু বিশ্ব নেতাদের শূণ্য কার্যক্রমের ফলে তাপমাত্রা এখন ৩ ডিগ্রির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এদিকে জাতিসংঘ বলছে, ❝বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ১৭ শতাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। এর ফলে দেশের ২ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।❞ আমাদের দরিদ্র এবং নিরীহ বিপুল এই জনগোষ্ঠীর ঠাঁই কোথায় হবে? তাদের ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ কে দিবে? জলবায়ু শরনার্থীদের দায়ভার ধনী দেশগুলোকেই নিতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষয়ক্ষতির জলবায়ু ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। দেখুন, বাংলাদেশ বৈশ্বিক গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনের ক্ষেত্রে ০.৪ শতাংশ অবদান রাখে। এদিকে চরম তাপমাত্রা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবনাক্ততা বৃদ্ধি এবং নদী ভাঙনের ফলে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ভুগছে। জলবায়ু ঝুঁকিহীন, নিরাপদ এবং বাসযোগ্য এবং দূষণমুক্ত ভবিষ্যত চাই।
'সেইভ ফিউচার বাংলাদেশ'এর জলবায়ু কর্মী মাহাদী হাসান বলেন, আমি ১৯ বছরের তরুণ। আমি আমার শিশুকাল নিরাপদে পাড় করে এসেছি। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের তিন জনের একজন শিশুর জীবন ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে রয়েছে এমনকি তারা নিরাপদ নয়। ইউনিসেফের তথ্য মতে, ❝জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে বাংলাদেশের ২ কোটি শিশুর জীবন এবং ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে রয়েছে।❞ অথচ বৈশ্বিক উষ্ণতা সৃষ্টির পিছনে আমাদের শিশুরা কোনোভাবেই দায়ী নয় কিন্তু আমাদের শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। চারিদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে একের পর এক বিপর্যয় ঘটছে তারপরেও তাদের টনক নড়ছে না। বিশ্ব নেতারা শূণ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েই যাচ্ছে। পৃথিবী বাঁচানোর এই যাত্রায় শূন্য প্রতিশ্রুতি নয়, চাই কঠোর হস্তক্ষেপ, চাই জলবায়ু সুবিচার।
এমতাবস্থায় আজকের বৈশ্বিক জলবায়ু ধর্মঘটের আমাদের দাবিগুলোঃ প্রথমত, বিশ্ব নেতাদের কাছে দাবি, প্যারিস এগ্রিমেন্ট বাস্তবায়ন করতে হবে। *জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো বন্ধ করে বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রিতে রাখতে হবে। *জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে।লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড ঘটন করে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে জলবায়ু ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। *গরীব দেশগুলোকে অভিযোজন সক্ষমতা বাড়াতে প্রযুক্তিগত সহায়তা করতে হবে। সবশেষে এইবছর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া 'কপণ্ড২৮' যেনো গ্রিনওয়াশিং সম্মেলন কিংবা সম্মেলন ব্যর্থ না হোক।
দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবি, *জীবাশ্ম জ্বালানি নয় নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে অগ্রসর হতে হবে। *জলবায়ু শরনার্থীদের টেকসই পুর্নবাসন করতে হবে। *উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির স্থায়ী সমাধান করতে হবে। *অভিযোজন সক্ষমতা বাড়াতে হবে। *উপকূল জুড়ে টেকসই ব্লক বাঁধ নির্মাণ এবং বনায়ন তৈরি করতে হবে। *উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের জীবনমান উন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। *একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করতে হবে। *পানি দূষণ, শব্দ দূষণ ও বায়ু দূষণ রোধে পদক্ষেপ নিতে হবে। *পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর প্রকল্প এবং দেশজুড়ে পরিবেশ দূষণকারী কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। *এছাড়াও দেশের পাহাড়-টিলা, বনাঞ্চল, গাছ-পালা, বন্যপ্রাণী এবং নদী, জলাশয় রক্ষা করতে হবে এবং পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নিতে হবে।