জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেওয়া শান্তিরক্ষীদের অবদান স্মরণ করতে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হয় আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস। প্রতিবছরের ন্যায় ২৯ মে এ বছরও যথাযোগ্য মর্যাদায় এ দিবসটি পালন করা হবে এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী বিশ্বের সব দেশের শান্তিরক্ষীদের অসামান্য অবদানকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। দিবসটি উপলক্ষে ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জে শহীদ শান্তিরক্ষীদের নিকটাত্মীয় ও আহত শান্তিরক্ষীদের সংবর্ধনা এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ওপর বিশেষ উপস্থাপনার আয়োজন করা হবে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বিটিভি ওয়ার্ল্ড সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। শান্তিরক্ষীদের অবদানে আজ বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে শান্তি ও সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী শান্তিরক্ষী মিশনে যোগ দেয় ১৯৯৩ সালে। আর পুলিশ নামিবিয়া মিশনের মধ্যদিয়ে ১৯৮৯ সালে শান্তিরক্ষী মিশনে যাত্রা শুরু করে।
পুরুষের পাশাপাশি বাংলাদেশি নারী শান্তিরক্ষীরাও নিজেদের যোগ্যতার সাক্ষর রাখছেন। শান্তি রক্ষা মিশনে ২০০৫ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত জনবলের হিসাবে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। নানা ভয়-শঙ্কা ও প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিগত সংঘাত মোকাবিলায় তারা রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যেমন বিভিন্ন দেশের রাস্তাঘাট, স্থাপনা নির্মাণ ও চিকিৎসাসেবায় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা অনুকরণীয় দায়িত্ব পালন করছেন। আর্থিক সুযোগ সুবিধাসহ যতটুকু কাজের সুযোগ পান তাতেই সন্তুষ্ট তারা। তাদের অনেকেই বলছেন, দায়িত্ব পালন করার সময় ওই এলাকায় টাঙানো থাকে বাংলাদেশের পতাকা। এতেই তারা গর্ববোধ করেন। ভিনদেশে মানুষের সেবা করতে পারছেন এটাই বড় ব্যাপার। নিজেদের মাধ্যমে বাঙালি কালচার, মূল্যবোধ তুলে ধরতে পারছেন অন্যান্যের সাথে। যখন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের দীর্ঘ ইতিহাসের শুরু জাতিসংঘের জন্মের মাত্র তিন বছর পর ১৯৪৮ সালে থেকে। তখন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৮ সালে। সে সময় এ দেশের উর্দি পরা সদস্যদের ইরান ও ইরাকের মধ্যে অস্ত্রবিরতি পর্যবেক্ষণে মোতায়েন করা হয়েছিল।শান্তিরক্ষা মিশনের এই যাত্রাটা দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল এর জন্য আমরা গর্বিত, এই দীর্ঘযাত্রা থেকে শিক্ষা ও নিতে পারি।
১৯৪৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়ে প্রাণ দেওয়া বিভিন্ন দেশের ৪ হাজার ৬৫ জন নায়ককে আজ আমরা শ্রদ্ধা জানাই, যাঁদের মধ্যে ১৫৯ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীও রয়েছেন। ২০২০ সালের মে মাস থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ আটজন নিবেদিতপ্রাণ শান্তিরক্ষী হারিয়েছে। শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ গঠনের দায়িত্ব পালনের সময় ১১ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী আহত হয়েছেন। শান্তিরক্ষা মিশনে সেনা ও পুলিশ সদস্য পাঠানো বৃহত্তর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ গত ৩৫ বছরে সাহসিকতা, সক্ষমতা, নির্ভরতা, নেতৃত্ব ও পেশাদারত্বের মাধ্যমে অত্যন্ত মর্যাদা অর্জন করেছে। বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬৬৯ জন শান্তিরক্ষী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বর্তমানে মালি, দক্ষিণ সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের মতো কঠিন কিছু জায়গাসহ ১০টি মিশনে বাংলাদেশের ৬ হাজার ৭৪২ জন শান্তিরক্ষী কাজ করছেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের শান্তিরক্ষা এজেন্ডার প্রতি সমর্থন জানিয়ে এবং নারী শান্তিরক্ষীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ নারী শান্তিরক্ষী পাঠাতে শুরু করেছে। আজ পর্যন্ত ২ হাজার ৩৪ জন বাংলাদেশি নারী শান্তিরক্ষী শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে কাজ করছেন ২৮৪ জন নারী শান্তিরক্ষী।
‘আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হলো, যারা প্রতিদিন গভীরভাবে প্রোথিত জেন্ডার-সংক্রান্ত মনোভাব ভেঙে চলেছেন এবং তরুণ নারী ও কিশোরীদের অপ্রচলিত পথ ও সুযোগ গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে চলেছেন।’ ফলে শান্তিপ্রিয় জাঁতি হিসেবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়।’ বিশ্বের বিরোধপূর্ণ স্থানে জাতিসংঘের ডাকে শান্তি স্থাপন করা, এজন্য আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর জরুরি দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হচ্ছে। জাতিসংঘকে শান্তি স্থাপনে সহায়তা দেওয়া এবং পাশাপাশি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আমাদের সুশিক্ষিত ও পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী থাকাটা অন্যতম শর্ত। যা বর্তমান শতাব্দীতে তৃতীয় প্রজন্মের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম বহুমাত্রিক ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই ‘দেশের প্রতিরক্ষা ও প্রশিক্ষণ আর জনগণের জন্য ভালোবাসা’- এই বিষয়গুলো কেন্দ্র করেইকৃতিত্ব ও সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আঘাত, সংঘাত, ভয়ভীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবিলা করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা শান্তির বার্তা নিয়ে বিশ্বমানবতার সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর।