যারা রাজনীতি করেন, রাজনীতি বোঝেন, কিংবা রাজনীতির খ্োঁজ খবর রাখেন তাদের কাছে সাহারা খাতুন নামটি অতি পরিচিত।
‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে সাহারা খাতুন এক নিবেদিত রাজনীতিবিদের নাম। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মহিলা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তিনি। রাজনীতি ও আইনপেশা দুটোতেই সমান দক্ষতার সাক্ষর রেখেছিলেন তিনি। পাশাপাশি রেখেছেন নারীর কল্যাণে প্রশংসনীয় ভূমিকা।
২০২০ সালের ৯ জুলাই তারিখে রাতে থাইল্যান্ডের বামরুদগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে যান রাজপথে নিবেদিত বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক এই সৈনিক। কিডনি, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন সাহারা খাতুন।
স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পতিত জিয়া-এরশাদের সামরিক দুঃশাসন আর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পতন আন্দোলনে সব সময় মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। গণতান্ত্রিক আন্দোলন-মিছিল-মিটিং, পিকেটিং-এ নেতৃত্ব দিতে গিয়ে অসংখ্যবার গুরুতর আহত হয়েছেন সাহারা খাতুন। ২০০৪ সালে ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন তিনি। কারাগারে যেতে হয়েছে অনেকবার।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট কাল রাতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনীতির পট পরিবর্তন হলেও আদর্শচ্যুত হননি তিনি। বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারীদের বিরূদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনে আইনঅঙ্গনের পাশাপাশি রাজপথের প্রতিটি কর্মসূচীতে অগ্রভাগে থেকে সাহসী নেতৃত্ব দিয়েছেন সাহারা খাতুন।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের দু:শাসনের বিরূদ্ধে সকল আন্দোলন-সংগ্রামে তার সাহসী উপস্থিতি অনুপ্রাণিত করতো তৃণমূলের নেতাকর্মীদের।
১/১১ -এ সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে মাইনাস ফর্মুলার ষড়যন্ত্র রাজনীতির বিরূদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর ছিলেন সাহারা খাতুন। ঐ সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চাপ ও ভয়ে দলের অনেক নেতারাই রাজনীতি করা, না করার দোটানায় ঘুরপাক খেলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি শতভাগ আস্থা ও বিশ্বাসে অটুট ছিলেন সাহারা খাতুন।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অগণতান্ত্রিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে রাখার বিরূদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা। যার ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রোসানলে কারাগারে যেতে হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যাসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে। দলের নেতাকর্মীরা তখন দিশেহারা। চোখে-মুখে অন্ধকার। দলের, দেশের আর গণতন্ত্রের ভবিষ্যত কী? কেউই জানে না- ঠিক সেই সময় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পক্ষ অবলম্বন ও তার নি:শর্ত মুক্তির দাবীতে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) জননেতা জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলের অন্যতম সংগঠক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন সাহারা খাতুন।
শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনেই নয়, পেশাগত জীবনেও সফল ছিলেন তিনি। আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন সাহারা খাতুন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার থেকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গ্রেপ্তারকৃত নেতাকর্মীদের আইনি সহায়তা প্রদানে সবখানেই ছিল তার সাহসী অংশগ্রহণ। বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভানেত্রীসহ বিভিন্ন নারী সংগঠনে সম্পৃক্ত থেকে নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবেও কাজ করেছেন এই মহীয়সী নারী।
একজন সাহারা খাতুন একদিনে তৈরী হয়নি। শত সংগ্রাম আর ত্যাগ-তিতিক্ষায় জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছেন নিজেকে। বিয়ে, সংসারের প্রথাগত পথে না হেঁটে আজীবন মাঠেই জনগণের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছেন সাহারা খাতুন। সাহসী নেতৃত্ব দিয়েছেন আন্দোলন-সংগ্রামে আবার ভালোবাসার মমতায় মাতৃস্নেহে আগলে রেখেছেন নেতাকর্মীদের।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ঐ যে তার মাঠে নামা, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অসুস্থ শরীরেও মাঠের রাজনীতিই করে গেছেন সাহারা খাতুন। তাইতো তার মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার শোকবার্তায় বলেছিলেন, দলের দু:সময়ে নেতাকর্মীদের সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করেছেন সাহারা খাতুন। তার মৃত্যুতে দেশ একজন সৎ জননেতাকে হারালো আর আমি হারালাম একজন পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাকে।
চলমান রাজনীতির এই স্রােতধারায় সৎ ও আদর্শবান রাজনীতিবিদের বড় অভাব। সাহারা খাতুনের মৃত্যু সেই শূন্যতার কথাই স্মরণ করে দিচ্ছে বারবার। তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মাঠের নেতা, তৃণমূল নেতাকর্মীদের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেরণা শ্রদ্ধাভাজন সাহারা আপার স্মৃতির প্রতি অতল শ্রদ্ধা।
(মানিক লাল ঘোষ : ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন এর সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য)