দিঘলিয়ার দেয়াড়া গণহত্যা দিবস

জান্নাতুল শিফা (সম্পা) : | প্রকাশ: ২৭ আগস্ট, ২০২৩, ০১:৪২ এএম

২৭ আগস্ট খুলনার দিঘলিয়ার দেয়াড়া গণহত্যা দিবস। সেদিনের কথা স্মরণ করে আজও শিউরে ওঠেন এ অঞ্চলের মানুষ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বিনাশ করতে দেশজুড়ে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত করে। এসব গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে বলা হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা ৩০ লাখেরও অনেক বেশি।  এছাড়াও ছয় লাখেরও বেশি নারীকে নির্যাতন করা হয়েছে। দেশজুড়ে আনাচে-কানাচে নিপীড়িত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় দোসররা কত ঘরবাড়ি ভস্মীভূত করেছিল, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় নি। এসব হত্যাকাণ্ডের অধিকাংশই ঘটেছে রাজাকার, আলবদর ও আল-সামসদের সহায়তায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ৪ মাস আগে খুলনায় ১৯৭১ সালের ২৭ আগস্ট এমনি এক নারকীয় হত্যা চালায় রাজাকার বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনারা। দেশীয় দালাল রাজাকার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে ফিরছিল। খুলনা শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দুরে দিঘলিয়ার দেয়াড়া গ্রামে ২৭ আগস্ট হঠাৎ ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই পাকিস্তানি সেনারা রাজাকারদের নিয়ে হামলে পড়ে ঐ গ্রামের অসহায় নিরীহ মানুষের ওপর। গুলি করে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে ৬০ জন নিরপরাধ বাঙালিকে হত্যা করে। আচমকা আক্রমণের মুখে কেউ কেউ পালাতে পারলেও তাদের হাতে ৬১ জন যুবক ও বয়স্ক মানুষ ধরা পড়েন। রাজাকাররা ওই ৬১ জনকে গুলি আর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ত বিত করার পৈচাশিক উল্লাসে মেতে ওঠে।
নারকীয় ওই পরিবেশের মধ্যে ৬০ জন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। এঁদের ৩৮ জনের লাশ পাষ- রাজাকারের দল ভৈরব নদীতে ফেলে দেয়। বাকী ২২ জনকে তিনটি গণকবরে মাটি চাপা দেয়। সেসময় গোটা গ্রামে মানুষের আর্তনাদ, চিৎকার, মারধর, গুলি, ধারালো অস্ত্রের আঘাত, প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছুটে পালানো-সব মিলিয়ে এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধে নিহত এসব শহীদের কোন স্বীকৃতি আজও  মেলেনি। সেসময়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় এখনও বেঁচে আছেন একজন। সেদিন যে মানুষটি বেঁচে যান তার নাম আবদুল বাশার। রাজাকারেরা সবাইকে একসাথে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করতে থাকে, ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। তবে তাকেও ছুরিকাঘাতে আহত করা হয়। ১৯ আঘাত সহ্য করেও তিনি জীবিত ছিলেন, শুধু যেন ইতিহাস রক্ষার জন্য! স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদার হোসেন বাদী হয়ে দীঘলিয়ার ঘটনায় জড়িত রাজাকারদের বিরুদ্ধে তৎকালীন দৌলতপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। রাজনৈতিক কারণে মামলাটি আর আলোর মুখ দেখেনি। এরপর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবদার হোসেনের মৃত্যুর পর ২০১০ সালে পাক হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকারদের হাতে নিহত মো. ইসমাইল হোসেন ছোট খোকার স্ত্রী রোকেয়া বেগম বাদী হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনালে ২২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। 
মুক্তিযুদ্ধের ৩৯ বছর পর ২০১০ সালে দিঘলিয়ার দেয়াড়ার গণকবরের সন্ধান সবার সামনে আসে। স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের এই নির্মম স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন শিল্পপতি মুক্তিযোদ্ধা কাজী শাহ নেওয়াজ। ঐ বছরের ৬ জানুয়ারি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামান বাচ্চু, গাজী আজগর আলী, শহীদ ডাক্তার শেখ মতিয়ার রহমানের ছেলে ও দিঘলিয়া সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আবজাল হোসেন ও আওয়ামী লীগ নেতা মো. মকবুল হোসেনসহ স্থানীয়দের সহযোগীতায় গণকবর থেকে শহীদের দেহাবশেষ সংগ্রহ করে একত্র করেন। এরপর দেহাবশেষগুলো ভৈরব নদের পাশে মুক্তিযোদ্ধা শাহানেওয়াজের দান করা জমির উপর গণকবরের স্থান নির্ধারণ করা হয় এবং দেহাবশেষগুলো সমাহিত করা হয়। এই গণকবরে ২২ জন শহীদ সমাহিত আছেন। দেয়াড়া গণহত্যার অনেক স্মৃতি চিহ্ন খুলনার ‘গণহত্যা জাদুঘরে’ সংরক্ষিত রয়েছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ৭১’ গণহত্যা আর্কাইভ ও জাদুঘর কয়েক বছর যাবত দিনটিকে ‘একাত্তরের দেয়াড়া গণহত্যা’ দিবস হিসেবে পালন করছে। মুক্তিযুদ্ধে যারা স্বজন ও সম্পদ হারিয়েছেন, তাদের দুঃখ-যন্ত্রণা কখনও ভুলে যাওয়ার নয়। এমন অসংখ্য হত্যাকাণ্ড ঘটেছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে। অসংখ্য প্রাণের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মহান স্বাধীনতা। আজকের এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি দেয়াড়া গণহত্যার শিকার সেসব শহীদকে। শ্রদ্ধা জানাই খুলনা ও দিঘলিয়া দেয়াড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের প্রতি।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW