মহাকবি আলাওল ও তাঁর পদ্মাবতী

শিপ্রা গোস্বামী : | প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর, ২০২৩, ০৬:১২ এএম

মজলিস কুতুবের প্রধান অমাত্য অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর ঔরসে জন্ম হয়েছিল আলাওল (হক) ফতেহাবাদ রাজ্যের জালালপুরে। জালালপুর ছিল ফতেহাবাদের একটি দুর্গ শহর। যদিও আলাওলের জন্মস্থান নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। অনেকে তাঁকে চট্টগ্রামের মানুষ বলেও অভিহিত করেছেন। অবশ্য এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, তাঁর জন্ম হয়েছিল তৎকালীন ফতেহাবাদ আর বর্তমান ফরিদপুর জেলার জালালপুর গ্রামে (অধুনা এটি মাদারীপুর জেলা)। জালালপুর সেই সময় গ্রাম ছিল না। যদিও  ইতিহাস সমৃদ্ধ সেই জালালপুর এখন নিছকই একটি অজপাড়া গাঁ। 
ঘটনা পরম্পরায় তিনি আরাকান রাজ্যের ‘রাজ আসোয়ার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। কিন্তু সঙ্গীত ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ক্রমেই বাড়তে থাকে। 
দেখতে দেখতে আলাওলের কবি প্রতিভার কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে গেল। সকলেই জানলো আলাওল শুধু গানের ওস্তাদই নন কবিও বটে। তাঁর যেমন সুর, তাল, লয় জ্ঞান আছে তেমনি আছে শুদ্ধ ছন্দ ও মাত্রা জ্ঞান। আলাওলের ভেতর যে সত্যিকারের একজন কবি লুকিয়ে আছে তা মাগন ঠাকুর আগেই টের পেয়েছিলেন। তাঁর লেখা সঙ্গীতের পদগুলো পড়ার পর মাগন ঠাকুর আরো মুগ্ধ হলেন।
তখন ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দ। সেদিন রাজদরবারে বেশকিছু জ্ঞানী-গুণী বেষ্টিত হয়ে মাগন ঠাকুর বসেছিলেন। আলাওলও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নানা বিষয়ে তাঁরা আলাপ করছিলেন। কেউ গান শোনাচ্ছিলেন, কেউ গল্প করছিলেন আবার কেউবা গভীর জ্ঞানের কথা বলছিলেন। মাগন ঠাকুর সবার কথা মন দিয়ে শুনছিলেন এবং নানা জনকে নানা উপহারাদি দিচ্ছিলেন উৎসাহ দেওয়ার জন্য। এক এক কথার সূত্র ধরে নানা কথার জন্ম হয়। কথার ডালপালা ছড়িয়ে যায়। তাঁদের মধ্যেই কেউ একজন পদ্মাবতীর কথা তুললেন। পদ্মাবতীর কাহিনি নিয়ে ‘পদুমাবৎ’ হিন্দি ভাষায় লেখা অপূর্ব এক কাব্য। হিন্দি ভাষায় লেখা পদুমাবৎ রচনা করেছেন মালিক শেখ মোহাম্মদ জায়সী। জায়সী খাঁটি মুসলিম হলেও তিনি যোগশাস্ত্র হিন্দু পুরান ইত্যাদিতে সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনিই প্রথম ফারসী হরফে হিন্দি ভাষা লিখতে শুরু করেছিলেন। ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে ‘পদুমাবৎ’ রচনা করে তিনি বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। 
কাব্যটির কথা উঠতেই মাগন ঠাকুরের মাথায় একটা দারুণ বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি ভাবলেন এমন একটি কাব্য যদি বাংলায় লেখা হয় তাহলে খুব ভালো হয়। কারণ সাহিত্যমানের দিক দিয়ে পদুমাবৎ অতুলনীয়। এটি বাংলায় লেখা হলে নিঃসন্দেহে বাংলাসাহিত্য সমৃদ্ধ হবে। মাগন ঠাকুরের মনে হলো এই কাজটি একমাত্র আলাওলকে দিয়েই সম্ভব। আলাওলের সাহিত্য প্রতিভা সম্পর্কে মাগন ঠাকুরের উচ্চ ধারণা ছিল। সেদিন সকলের সামনেই মাগন ঠাকুর আলাওলকে ডেকে বললেন, আজ আপনাকে একটা মহান কাজের দায়িত্ব দেব। পদ্মাবতীর অপূর্ব কাহনীটি হিন্দুস্তানী ভাষায় লেখা। আরাকানের অনেক লোকই তা বোঝে না। বাংলা ছন্দে যদি আপনি এটি নতুন করে রচনা করেন তবে সকলে সেই কাহিনি পড়ে প্রভূত আনন্দ পাবে। আপনি কবি, অশেষ জ্ঞানী মানুষ। মালিক মোহাম্মদ জায়সী তাঁর পদুমাবৎ কাব্যে পদ্মাবতীর যে রূপ বর্ণনা করেছেন বাংলা ভাষায় তা আপনি ছাড়া কেউ পারবে না। আপনার প্রতি সেই বিশ্বাস আমার আছে।
আলাওল মাগন ঠাকুরের কথা শুনে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেন। কারণ ইতঃপূর্বে তিনি কিছু পদ রচনা করলেও এ ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা তাঁর নেই। এদিকে মাগন ঠাকুর আলাওলের আশ্রয়দাতা। তাঁর অনুরোধ আলাওলের কাছে আদেশেরই সমান। আলাওল বললেন, পদুমাবৎ কাব্যটি আমি কয়েক বার পড়েছি। অসাধারণ এই কাব্যটি কাহিনি কাব্য হলেও এর মাঝে রয়েছে অনেক আধ্যাত্মিক বিষয়। আমারও অনেকবার মনে হয়েছে এটি বাংলা ভাষায় রচিত হওয়া প্রয়োজন। আমার গ্রন্থ রচনার অভিজ্ঞতা নেই। দু-একটি পদ রচনা করেছি মাত্র। আপনি আমাকে উপযুক্ত মনে করেছেন ভেবে সম্মানিত বোধ করছি। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব। আপনার যশ-কীর্তির কথা বর্ণনা করার সাধ আমার অনেকদিনের। আজ সুযোগ এসেছে। এই কাজ আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে অসম্ভব বটে তবু আমি আমার সমস্ত মেধা দিয়ে কাজটি করবো শুধু আপনার গুণে আর পদ্মাবতীর কাহিনীর আকর্ষণে। আপনি এবং আপনার  সভাসদ আমাকে দোয়া করবেন। মাগন ঠাকুর বললেন, আপনি আল্লাহতালা’র নাম নিয়ে কাজ শুরু করে দিন। ইনশাআল্লাহ আপনি সফল হবেন।
অল্প সময়ের মধ্যেই আলাওল ‘পদুমাবৎ’ কে বাংলায় রূপান্তরের কাজে হাত দিলেন। মালেক মোহাম্মদ জায়সী’র ‘পদুমাবৎ’ রচনার একশত এগারো বছর পর আলাওল রূপান্তরের দায়িত্ব পেলেন। এ যেন পুস্তক রচনা নয় এক ধরনের সাধনা। আলাওল মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন এই সাধনায় তাকে সিদ্ধিলাভ করতেই হবে। প্রথমেই তিনি গভীর আগ্রহের সাথে মূল গ্রন্থটি অর্থাৎ ‘পদুমাবৎ’ পড়তে লাগলেন। তিনি এক একটি অংশ বারবার পড়তে লাগলেন। যতবার পড়ছিলেন ততই ভালো লাগতে লাগলো। পড়তে পড়তে ভাবলেন এই গ্রন্থটি তিনি হুবহু রূপান্তর করবেন না। তিনি এটিকে নিজের মনের মতো করে সাজাবেন। ‘পদুমাবৎ’ গ্রন্থটিতে এমন কিছু আধ্যাত্মিক এবং অলৌকিক কথা আছে যা হয়তো সাধারণ পাঠকের বোধগম্য হবে না। তাই তিনি সেই অংশগুলো বাদ দিয়ে নতুন কিছু সংযোজন করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
বেশ কয়েক বার ‘পদুমাবৎ’ গ্রন্থখানি পড়ার পর তিনি শুরু করলেন তাঁর আসল কাজ। কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়লেন। দিন গড়াতে লাগল প্রকৃতির নি যতবার জিজ্ঞেস করতেন ততবারই আলাওল জবাব দিতেন, এই তে য়মে। মাগন ঠাকুর প্রায় প্রতিদিনই খোঁজ নিতেন আলাওলের লেখা কতদূর এগুলো। মাগন ঠাকুর এগোচ্ছে ধীরে ধীরে। মাগন ঠাকুরের যেন আর অপেক্ষার পালা শেষ হয় না।
সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আলাওল তাঁর রচনা শেষ করলেন। কাব্যখানির নাম দিলেন ‘পদ্মাবতী’। মাগন ঠাকুর খবর শুনে উৎফুল্ল হয়ে বললেন-পরদিন থেকেই রাজসভায় পদ্মাবতীর কাহিনি শোনা শুরু হবে। সভার সকলেই অধীর অগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন পদ্মাবতীর কাহিনি শোনার জন্য। 
পরদিন যথাসময়ে সভা শুরু হলো। আরাকানের বহু জ্ঞানী গুণী লোকজন সেদিন এসে জমা হলেন কাহিনি শোনার জন্য। আলাওল আল্লাহ রসুলের নাম নিয়ে পাঠ শুরু করলেন। কাব্যের প্রথমে তিনি আল্লাহ, রসুল এবং চার খলিফার প্রশংসা গাথা রচনা করেছেন অনেক যতেœর সাথে। তারপর তিনি আরাকান রাজসভা এবং তাঁরই আশ্রয়দাতা মাগন ঠাকুরের গুণকীর্তন করলেন। একপর্যায়ে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে আলাওল অশ্রু ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি পদ্মাবতী কাহিনীটি নিখুঁত ছন্দে পাঠ করতে লাগলেন...সিংহলের রাজা’র নাম গন্ধর্ব সেন। রানী চম্পাবতী আর একমাত্র রাজকন্যা পদ্মাবতী। রাজকুমারী পদ্মাবতী ছিলেন অপরূপা সুন্দরী। তার তুলনা সে নিজেই। রাজকন্যার হীরামন নামের একটা তোতা পাখি ছিল। পাখি হলে কি হবে হীরামন ছিন মহাপণ্ডিত। রাজকুমারীর সময় কাটত হীরামনের সঙ্গে গল্প করে। কি একটা কারণে রাজা একদিন রেগে গিয়ে হীরামনকে হত্যা করতে চাইলেন। এই কথা শুনে রাজকুমারী কেঁদে কেটে রাজা’র কাছে হীরামনের প্রাণভিক্ষা চাইলেন। অতঃপর সে যাত্রা হীরামনের প্রাণ রক্ষা হলো।  কিন্তু হীরামনের মনে এমনভাবে ভয় ঢুকে গেল যে সে আর আগের মতো স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। একদিন সুযোগ পেয়ে হীরামন পালিয়ে যায়।
হীরামন উড়ছে তো উড়ছেই। গৃহে বন্দি ছিল বিধায় হীরামন বনের অন্য পাখি’র মতো চতুর ছিল না। এক শিকারীর হাতে ধরা পড়লো হীরামন। শিকারী হীরামনকে নিয়ে এক ব্রাহ্মণের কাছে বেঁচে দিল। ব্রাহ্মণ পাখিটিকে নিজের দেশ চিতোরে নিয়ে গেল।
চিতোরের রাজা ছিলেন তখন রাজা চিত্রসেনের ছেলে রত্নসেন। হীরামনকে দেখে রত্নসেনের ভীষণ পছন্দ হলো। তিনি লাখ টাকা দিয়ে ব্রাহ্মণের কাছ থেকে পাখিটি কিনে নিলেন। রত্নসেনের রানীর নাম নাগমতি। তিনি ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। একদিন রাজা শিকারে গেলে রানী নাগমতী হীরামনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলতো পাখি আমার চাইতে সুন্দরী কেউ আছে এই পৃথিবীতে?’
হীরামন হেসে বলল, ‘সিংহলের রাজকুমারী পদ্মাবতীর ধারে কাছেও নন আপনি।’
এই কথা শুনে রানী নাগমতী গেলেন ভীষণ ক্ষেপে। তিনি ধাত্রীকে ডেকে হীরামনকে প্রাণে মেরে ফেলার হুকুম দিলেন।
ধাত্রী পাখিটিকে নিয়ে গেল। সে জানতো রাজা পাখিটিকে খুব ভালোবাসতেন। তাই ধাত্রী পাখিটিকে না মেরে লুকিয়ে রাখলো।
ইতিমধ্যে রাজা শিকার থেকে ফিরে এসে রানীকে হীরামন পাখির কথা জানতে চাইলে রানী রাজাকে জানান যে, পাখিটিকে বিড়াল খেয়ে ফেলেছে। আরও বললেন- বেশ হয়েছে ওকে বিড়াল খেয়ে ফেলেছে। পাজিটা বলে কিনা পদ্মাবতী নাকি আমার চাইতেও সুন্দরী !
রাজার বুঝতে বাকি রইলো না যে, এসব কিছু রানীরই কারসাজি।  রাজা রানীকে বললেন, পাখি এনে না দিলে তোমার গর্দান নেব। রাজার কথা শুনে রানী বিচলিত হয়ে পড়লেন। এদিকে ধাত্রী কোনো উপায়ন্তর না দেখে পাখিটিকে রাজার কাছে এনে দিল। রাজা খুব খুশি হলেন। হীরামনের কাছে পদ্মাবতীর রূপের বর্ণনা শুনে রাজা মূর্ছা গেলেন। মূর্ছা ভঙ্গ হলে শুধু পদ্মাবতী আর পদ্মাবতী করতে লাগলেন। একসময় রাজা হীরামনকে সঙ্গে করে যোগীর বেশে পদ্মাবতীর খোঁজে চললেন। তাঁর সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন ষোলো হাজার রাজকুমারকে যোগী সাজিয়ে।
দীর্ঘ একমাস তাঁরা সমুদ্রে ভাসলেন। সাত সমুদ্র পার করে শেষ পর্যন্ত তাঁদের নৌকা এসে ভিড়ল সিংহলে। তাঁরা সিংহলে মহাদেবের মন্দিরে আশ্রয় নিলেন।
সেই বছর বসন্ত পঞ্চমীতে পদ্মাবতী মহাদেবের মন্দিরে পুজো দিতে এলো। পদ্মাবতীকে দেখে রাজা জ্ঞান হারালেন। পদ্মাবতী ভয় পেয়ে ছুটে গেলেন রাজপুরীতে। এদিকে রাজা মনের কষ্টে বিলাপ করতে লাগলেন। রাজা মহাদেবের আরাধনা করতে লাগলেন। একসময় মহাদেব রাজার সাধনায় সন্তুষ্ট হলেন। তারপর মহাদেবের আদেশে রাজা সুড়ঙ্গ পথে রাজপুরীতে প্রবেশ করলেন।
রাজপুরীতে প্রবেশ করার সাথে সাথেই প্রহরীরা তাঁদের বন্দি করলো। যোগীবেশধারী রাজকুমাররা যুদ্ধ করতে চাইলেও রত্নসেন তাঁদের বারণ করলেন। 
রত্নসেনের এক বিশ্বস্ত দাস ভাট রাজা গন্ধর্ব সেনের নিকট রত্নসেনের উদ্দেশ্যের কথা বললেন। গন্ধর্বসেন হীরামনের কাছেও রত্নসেনের কথা জেনেছেন। তবু তিনি রত্ন সেনের কাছে তাঁর একমাত্র কন্যা পদ্মাবতীকে তুলে দিতে কেমন যেন দ্বিধাবোধ করছিলেন। তাই তিনি রত্নসেনকে যাচাই করার সিদ্ধান্ত নিলেন। 
রত্নসেন নিজেও যেহেতু রাজা তাই তিনি কোনো কিছুতেই কম যান না। রত্নসেন অশ্ব ও হস্তী চালনা এবং চৌগান খেলায় সকলকে মুগ্ধ করে দিলেন। গন্ধর্বসেন অনেক ধুমধাম করে রত্নসেনের সঙ্গে পদ্মাবতীর বিয়ে দিলেন। রত্নসেনের সঙ্গে আসা ষোলো হাজার রাজকুমারও সিংহলের ষোলো হাজার পদ্মিনী কন্যাকে বিয়ে করলেন। 
এদিকে দিনে দিনে বছর গড়ায় কিন্তু রত্নসেন নিজভূমে ফেরেন না। রানী নাগমতি রাজার বিরহে কাতর  হয়ে পড়ল। এক পাখি সেই সংবাদ নিয়ে এলো রাজা রত্নসেনের কাছে। শুনে রাজার মন নরম হয়ে গেল। এবার রাজ্যে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন। অনেক ধন রত্ন নিয়ে রানী পদ্মাবতীসহ রত্নসেন চিতোরে ফিরলেন। রাজকুমাররাও সঙ্গে গেল।
পদ্মাবতী ছিল খুব নরম মনের মানুষ। চিতোরের রাজসভায় এক পণ্ডিত ছিলেন যার নাম ছিল রাঘবচেতন। তিনি শুধু পণ্ডিতই ছিলেন না যাদুবিদ্যায়ও পারদর্শী ছিলেন। তবে তার এক যাদুবিদ্যায় রাজা রত্নসেন ক্রুদ্ধ হয়ে রাঘবচেতনকে নির্বাসন দিলেন। কোমলমতি পদ্মাবতী তার নিজহাতের বহুমূল্যবান রত্নখচিত কংকন তাকে দান  করলেন। এ সময় রাঘবচেতন পদ্মাবতীর রূপ দেখে অজ্ঞান হয়ে গেল।
পদ্মাবতীর অপরূপ রূপের কথা কিছুতেই ভুলতে পারলো না। সে দিল্লি গিয়ে বাদশা আলাউদ্দিনকে পদ্মাবতীর কংকন এবং তাঁর রূপের কথা বর্ণনা করল। রাঘবচেতনের কাছে পদ্মাবতীর রূপের বর্ণনা শুনে আলাউদ্দিন আর যেন থাকতে পারছিল না। সে চিতোরে গিয়ে ছলে-বলে-কৌশলে রত্নসেনকে বন্দি করে নিয়ে গেলেন।
চিতোরের এক পূর্বশত্রু ছিল যার নাম দেবপাল। রত্নসেনের অনুপস্থিতিতে দেবপাল পদ্মাবতীকে আপমান করতে গিয়ে নিজেই লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে গেল। পদ্মাবতী রত্নসেনকে উদ্ধারের জন্য তাদের বিশ্বাসী সরদার গোরা ও বাদল আর ষোলো শত রাজকুমারের শরণাপন্ন হলেন। তারা দিল্লি গিয়ে রত্নসেনকে উদ্ধার করে আনল। তাদের এই সহযোগিতায় পদ্মাবতী খুব খুশি হলো।
রত্নসেন চিতোরে পৌঁছবার পর পদ্মাবতী তাকে দেবপালের কথা খুলে বলল। সবকথা শুনে রত্নসেন খুব ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন তিনি পরদিনই দেবপালকে শাস্তি দেওয়ার  জন্য যুদ্ধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তুমুল যুদ্ধ হলো। অবশেষে দেবপাল নিহত হলেও রত্নসেন বিষাক্ত অস্ত্রের আঘাকে জর্জরিত হয়ে ফিরলেন। সেই বিষ রত্নসেনের জীবনের শেষদিন অবধি পিছু ছাড়েনি। 
রত্নসেনের ছিল দুই পুত্র। চন্দ্রসেন এবং ইন্দ্রসেন। তাদের বয়স যখন সাত এবং পাঁচ বছর তখন পুরনো বিষক্রিয়ায় মারা যান। পুত্রদ্বয়কে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে রানী পদ্মাবতী ও নাগমতি দুজনই রত্নসেনের সঙ্গে সহমরণে গেলেন। 
রত্নসেনের মৃত্যুর পর তার পুত্র চন্দ্রসেন এবং ইন্দ্রসেন বাধ্য হয়ে বাদশা আলাউদ্দিনের বশ্যতা স্বীকার করে পূর্বাপর সকল ঘটনা জানিয়ে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখল। সবকিছু জেনে বাদশা আলাউদ্দিন খুব দুঃখ পেলেন। তাদের সান্ত¡না দিলেন।  আরও কিছু রাজ্যও দান করলেন তাদের।
আলাওলের মুখে পদ্মাবতীর কাহিনি শুনে মাগন ঠাকুরসহ সকল সভাসদের মন ছুঁয়ে গেল। আলাওলের লেখার প্রতিটি পদ যেন জাদুমাখা। এতক্ষণ তারা যেন স্বপ্নের রাজ্যে ভাসছিলেন। আলাওল কাহিনি শেষ করার পর তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। তারা যেন রূপকথার জগৎ থেকে মাটিতে নেমে এলো। মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতারা আলাওলের মধুর কণ্ঠের বিবরণ শুনে ধন্য ধন্য করতে লাগলো।
আলাওল ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। তিনি নরম স্বরে বললেন, তাঁর যতটুকু শক্তি ছিল তার সবটুকু তিনি ব্যয় করেছেন পদ্মাবতী’র কাহিনীটি বাংলায় রচনা করতে গিয়ে। মাগন ঠাকুর এবং অন্য যারা শুনলেন তাদের যদি ভালো লেগে থাকে তবে আলাওলের পরিশ্রম সার্থক হবে।
আলাওলের কথা শুনে মাগন ঠাকুর আবেগে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আলাওল যে মহান কাজ করেছেন তাতে আলাওলের নাম অমর হয়ে থাকবে। যুগ যুগ ধরে আলাওলের  রচিত এই কাহিনি লোকের মুখে মুখে ফিরবে। আলাওলকে অভিনন্দন জানানোর ভাষা মাগন ঠাকুরের জানা ছিল না।
মাগন ঠাকুরের মুখে প্রশংসা বাণী শুনে আলাওল অনেক খুশি হলেও তিনি ততোধিক বিনয়ের সঙ্গে মাগন ঠাকুরের উদ্দেশে বললেন, তিনি মাগন ঠাকুরের গুণকীর্র্তিকে সামনে রেখেই পদ্মাবতী রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। মাগন ঠাকুরের উৎসাহেই আলাওল এই দায়িত্বখানিও শেষ করতে পেরেছেন। সকলের ভালো লাগাই তাঁর পুরস্কার। উপস্থিত সবাই আবারও আলাওলের কথায় মুগ্ধ হলেন। 
পদ্মাবতী কাব্য লিখে আলাওল হয়ে উঠলেন বাংলার মহাকবি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে আছেন।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW