শীতের পরিযায়ী পাখি নিরাপদে থাকুক

প্রকাশ ঘোষ বিধান : | প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর, ২০২৩, ০৭:৪৫ পিএম

দেশে প্রতি বছর শীত মৌসুমে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসে। দেশের নানা প্রান্তের হাওর, বাঁওড়, বিলসহ অসংখ্য জলাশয় পাখিদের কুজনে ও প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরে ওঠে। শীতকালে নতুন নতুন পাখি খালে বিলে এবং নদ নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যায়। এসব পরিযায়ী পাখি বরফজমা হিমালয়ের ওপাশ থেকে অত্যন্ত শীত থেকে বাঁচার জন্য আমাদের দেশে চলে আসে। পাখি বিজ্ঞানীদের মতে, পুথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখি রয়েছে। আর উপমহাদেশে প্রায় ২ হাজার ১শত প্রজাতির পাখি আছে। এরমধ্যে প্রায় ৩শ প্রজাতির পাখি হিমালয় পেরিয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে চলে আসে। এসব পাখি হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত তিব্বতের লাদাখ থেকে সেন্ট্রাল এশিয়ান ইন্ডিয়ান ফ্লাইওয়ে দিয়ে প্রবেশ করে। শুধু ইউরোপ এবং এশিয়ান ৬শ প্রজাতির পাখি রয়েছে, যারা প্রচন্ড শীতে এ দেশে চলে আসে। ইংল্যান্ডের নর্থ হ্যামশেয়ার, সাইবেরিয়া, এন্টার্কটিকার তীব্র শীত থেকে বাঁচার জন্য অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চল আমাদের দেশে চলে আসে।
শীতের পাখিদের মধ্যে বালিহাঁস, গিরিয়া হাঁস, সাদা মানিকজোড়, রাঙ্গামুরি, হট্টি টি, ডাহুক, কোড়া, বাটাং, পানকৌড়ি, বড় বক অতি পরিচিত নাম। কিন্তু প্রতিবছর দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে যে পাখি আমাদের দেশে বাঁচতে আসা পাখিরা নিরাপত্তা সে ভাবে পায় না। এদের রক্ষা করার জন্য জনসচেনতামূলক তেমন কোনো কার্যক্রম নজরে পড়ে না। তেমনি এদের রক্ষা করার জন্য নেওয়া হয় না তেমন কোন পদক্ষেপ। তাই প্রতিনিয়তই আমাদের দেশে পরিযায়ী পাখিদের আগমন কমে যাচ্ছে।
সমাজের একশ্রেণির অসাধু, অর্থলোভী, অসচেতন ও শিকারী লোকজন বন্যপ্রাণী ও পাখি শিকার এবং নিধনের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। শীতের সময় এলে পাখি শিকারীদের মধ্যে সাজ সাজ রব পড়ে।আর শিকারিরা ফাঁদ, জাল তৈরি করে প্রস্তুত থাকে শিকারের জন্য। বিভিন্ন উপায়ে তারা শিকার করে পাখি। গ্রাম অঞ্চলে ধান ক্ষেতে আলোর ফাঁদ,জাল দিয়ে পাখি শিকার করতে দেখা যায়। কেউ কেউ মাছের ঘেরে নকল পাখির ডাকের ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করছে। এ ছাড়াও বাগানে গাছে রাতে পাখি বসে থাকলে এয়ার গান অথবা সুচালো শিক দিয়ে শিকারিরা পাখি শিকার করে থাকে। এভাবে বন্যপ্রাণী ও পাখি শিকার এবং নিধনের ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা শাস্তি না পাওয়ায় এবং জনসচেতনতার অভাবে দেশে বন্যপ্রাণী, পাখি শিকারসহ নিধনের ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। অথচ, এসব বন্যপ্রাণী ও পাখি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এভাবে বন্যপ্রাণী ও পাখি শিকার এবং নিধনের ঘটনা ঘটতে থাকলে আমাদের পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং এর কুফল আমাদেরকেই ভোগ করতে হবে।
আমাদের দেশে আবাসিক ও পরিযায়ী মিলে পাখি প্রায় ৬৫০ প্রজাতির। এর মধ্যে ৩৬০ প্রজাতি আবাসিক। বাকি ৩০০ প্রজাতি পরিযায়ী। সব পরিযায়ী পাখি শীতের সময় আসে না। ৩০০ প্রজাতির মধ্যে ২৯০টি শীত মৌসুমে আসে ও ১০ টি প্রজাতি থেকে যায়। আন্তর্জাতিকভাবে জলচর পাখির জন্য স্বীকৃত ২৮টি জায়গা বাংলাদেশের সীমানায় রয়েছে। এগুলো হলো,সিলেট অঞ্চলের বেশ কিছু হাওর, মৌলভীবাজারের হাইল-হাওর হাকালুকি হাওর, শ্রীমঙ্গলের বাইক্কাবিল হাওর, বরিশাল বিভাগের চরবারি, চর বাঙ্গের, কালকিনির চর, চর শাহজালাল, টাগরার চর, ডবা চর, গাগোরিয়া চর, চর গাজীপুর, কালুপুর চর, চর মনপুরা, পাতার চর ও উজির চর; চট্টগ্রাম বিভাগের কাটা চর, গাউসিয়ার চর, মহুরী, ড্যাম, মুক্তারিয়া চর, ঢালচর, নিঝুম দ্বীপ, পতেঙ্গা সৈকত, সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপ, সিলেট বিভাগের আইলার বিল, ছাতিধরা বিল, পানা বিল, রোয়া বিল, শনির বিল ও টাঙ্গয়ার হাওর। এ ছাড়া বেশ কিছু জায়গায় এদের আনাগোনা দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মৌলভীবাজার জেলার হাইল-হাওর, হাকালুকি হাওর, বাইক্কাবিল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় লেক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, মিরপুর চিড়িয়াখানা, মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের পাশের লেক, পঞ্চগড়, দিনাজপুরের রামসাগর, চর ডাটা, নেত্রকোনার কলমাকান্দা হাওর, কিশোরগঞ্জ হাওর, সুনামগঞ্জ হাওরহাতিয়া দ্বীপ, চরপিয়া ডালচর, মনপুরা, চরমানিক, আগুনমুখা প্রভৃতি। শীত এলেই এসব জলাশয়সহ বিভিন্ন হাওর, বাঁওড়, বিল ও পুকুরের পাড়ে গেঁথে পড়ে নানা রং-বেরঙের নাম জানা, অজানা পাখি। এসব পরিযায়ী পাখি আমাদের বন্ধু, প্রকৃতির বন্ধু।
এ পাখিগুলোকে অচেনা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমাদের বন্ধুসুলভ আচরণ করা দরকার। এই পাখিগুলো রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। শীত এলেই দেশি ও অতিথি পাখির কলরবে মুখর থাকে উল্লিখিত অঞ্চলগুলোর জলাশয়। পর্যাপ্ত খাবার ও নিরাপত্তা থাকায় নানা জাতের পাখিরা নির্বিঘ্নে বিচরণ করে এইসব জলাশয়ে। সাইবেরিয়া ও হিমালয় অঞ্চলে শীত প্রকৃতিতে এলে স্থলভাগ ও জলাশয়গুলো বরফে ঢেকে যাওয়ায় সেখানকার পাখিরা বিশেষ করে সেসব দেশের হাঁস, বক প্রভৃতি জলচর পাখি প্রয়োজনীয় খাবার পায় না। তখন এদের বেঁচে থাকার জন্য খাবারের বিশেষ প্রয়োজন হয়। পাড়ি জমায় এমন দেশে, যেখানে হাওর-বাঁওড় ও নদী-নালার কোনো অভাব নেই, খাবারের সমস্যা নেই, এমন কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য।
শীত চলে গেলে এরা আবার নিজ দেশে পাড়ি জমায়। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে পাখিপ্রেমীদের মন কেড়ে নেয় এরা। শীতের মৌসুমে আসা পাখিদের মধ্যে রয়েছে বালিহাঁস, পাতিহাঁস, লেজহাঁস, পেরিহাঁস, চমাহাঁস, বক, শামুককনা, জলপিপি, বনহুর, হরিয়াল, পানকৌড়ি, চখপখিম সারস, কাইমা, গাঙ্গ কবুতর, লালবুক, রাজসরালি, নারুন্দি, মানিকজোড়সহ আরও অনেক পাখি। প্রতিবছর আমাদের দেশে প্রায় ১৫ প্রজাতির হাঁস ছাড়াও গাগিনি, গাও হাঁস, আরাথিল, পেলিক্যান, পাইজ, বাটান, ডাটাসাক এসব পাখি এসে থাকে। এসব পাখির সুরক্ষায় যেমন উদাসীন তেমনি শিকার হচ্ছে এসব পাখি।
বিভিন্ন হাওর, বাঁওড়, জলাশয়সহ কিছু বনাঞ্চলে যেখানে পাখিদের বিচরণ দেখা যায় শিকারিরা সে অঞ্চলগুলোকে আগে থেকে টার্গেট করে প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। এ কারণে বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখির আগমন অনেকটাই কমে এসেছে। আবার জমিতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের পাখিরা জীবন হারাচ্ছে। তাই বহু বছর ধরে শীত মৌসুমে বাংলাদেশে পাখি আসলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন কারণে পরিযায়ী পাখির আগমনটা কমে যাচ্ছে। এসব পাখির জীবনযাপন ও পরিবেশ দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে। যে পাখিরা শুধু জীবন ও খাদ্যের সন্ধানে আমাদের দেশে আসে, নিজেদের অসচেতনতা ও লোভের বশবর্তী হয়ে কিছু লোক পরিযায়ী পাখিরই জীবন কেড়ে নিচ্ছে বা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। এমন অমানবিক আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ ছাড়া আমরা পরিযায়ী পাখি দেখতে গেলেই পাখির খুব কাছে যেতে চাই, ছবি তুলতে চাই। নীরবতা ভঙ্গ হয়। পাখিরা বিরক্ত বোধ করে অন্যত্র চলে যায়। অনেক পাখির আবাসস্থলে পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এদিক থেকে আমাদের সর্বোচ্চ সতর্ক হতে হবে। শীতে পরিযায়ী পাখি বিভিন্ন দেশ থেকে এ দেশে এসে আশ্রয় নেয় কেবল জীবন বাঁচানোর তাগিদে। এ পাখিগুলোই উপকৃত হয় তা নয়; পরিযায়ী পাখির কারণে আমরাও উপকৃত হই। প্রকৃতির শোভাবর্ধনের সাথে সাথে এসব পাখি জমির ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে কৃষকের সরাসরি উপকার করে। ফলে ফসলের উৎপাদন বাড়ে। বিশেষ করে হাঁসজাতীয় পাখিরা দেশের ক্ষেতের বিষাক্ত পোকা খেয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই এসব পরিযায়ী পাখির কারণে আমরা ভীষণভাবে উপকৃত হই। ক্ষেতের পোকামাকড় খেয়ে পাখি কৃষকের উপকার করে। তাই পাখিকে কৃষকের বন্ধু বলা হয়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাখির গুরুত্ব অপরিসীম। অন্যদিকে পরিযায়ী পাখির কারণে শীতে অভ্যন্তরীণ পর্যটন বাড়ে। যার কারণে আমাদের দেশের রাজস্ব আয়ও বাড়ে। দেশে পাখিপ্রেমীদের মনে আনন্দ যোগায়। পাখি নিধন বন্ধ করতে না পারলে  এসব সুফল থেকে বঞ্চিত হবে দেশ। আর তাতে পরিবেশ বিপন্ন হবে।
২০১২ সালের বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী কেউ শখের বসেই শিকার করুক, আর কেউ অসচেতনতার কারণে শিকার করুক; পাখি শিকার আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন ২০১২ অনুযায়ী যদি কোন ব্যক্তি পরিযায়ী পাখি শিকার করেন তাহলে তার সর্বোচ্চ ১ বছর কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ১ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন এবং একই অপরাধ দ্বিতীয় বার করলে সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ২ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন। এ ছাড়া পরিযায়ী পাখির দেহের কোন অংশ সংগ্রহ, বেচাকেনা কিংবা পরিবহন করলে সর্বোচ্চ ৬ মাস কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন এবং একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সর্বোচ্চ ১ বছর কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন।
রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রনালয় দেশের জীববৈচিত্র, পাখি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এর ৪৯ ধারা প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এয়ারগান ব্যবহার বা বহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরিযায়ী পাখি নিধন ও বাজারে বিক্রি নিষিদ্ধ জেনেও আইনের ফাঁক দিয়ে এক শ্রেণির পেশাদার এবং শৌখিন শিকারি এ ঘৃণ্যতম কাজগুলো করে চলেছেন। তবে শুধু নিধন নয়, পাখিকে বিরক্ত করা থেকে শুরু করে পাখির স্বাভাবিক বিচরণে ব্যাঘাত ঘটে এসব কাজ থেকে আমাদের বিরত থাকা একান্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন প্রয়োগ করতে হবে কার্যকরভাবে। তৎপরতা বাড়াতে হবে বনবিভাগের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংশ্লিষ্ট স্থানীয় প্রশাসনকে।
পাখি হলো প্রকৃতির অলঙ্কার। কুষকের বন্ধু, ফসল পরিচর্যায় কীটনাশকের মতন। পাখির সংখ্যা কমে গেলে কীটপতঙ্গের আক্রমনে ফসল ফলানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। আর সেটিই যদি হয়, তাহলে একচেটিয়াভাবে নির্ভর করতে হবে কীটনাশকের ওপর। আর তাতে পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব পড়বে। পাখি নিসর্গকে সুন্দর করে, চোখকে প্রশান্তি দেয় ও সৌন্দর্য চেতনাকে আলোড়িত করে। পাখি আসুক, ওদের কলকাকলিতে ভরে উঠুক আমাদের চারপাশের পরিবেশ। আমরা পাখি শিকার না করে এবং পাখিকে উৎপাত না করার তাদের প্রতি সদয় হই। আমাদের কোনো ধরনের অমানবিক আচরণ যেন এদের মুক্ত জীবনযাপনে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় তার জন্য আমাদের সচেতনতা হওয়া দরকার।
সর্বোপরি, আমাদের অনুধাবণ করতে হবে পরিযায়ী পাখি আমাদের প্রকৃতির বন্ধু, তারা তো শত্রু নয়। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যও পাখি বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন। তাই এদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আইনের কঠোরতম প্রয়োগ বাস্তবায়ন একান্ত জরুরি। (লেথক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট)

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW