ইশ সোধির ব্যাটের ছুঁয়ে আসা বল জাকির হাসানের হাতে জমা পড়তেই উল্লাসে মাতল পুরো দল। নন-স্ট্রাইক প্রান্তে তাইজুল ইসলাম শুরুতে একটু শান্তই ছিলেন। এরপরই গর্জন করে উঠলেন মুষ্টিবদ্ধ হাত বাতাসে ছুড়ে। দলবেঁধে উদযাপনের মধ্যেই তাইজুলের কাছে এলেন মুশফিকুর রহিম। উষ্ণ আলিঙ্গনে বেশ কিছুক্ষণ অনুজ সতীর্থকে নিজের বুকে রাখলেন দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার। কিছুক্ষণ পর পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান শেষেই তাইজুলকে ঘিরে ধরলেন অনেকে। কেউ হাত মেলাচ্ছেন, কেউ ছবি তোলার আব্দার করছেন। তার সঙ্গে কথা বলার জন্য বেশ অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হলো হাবিবুল বাশারকে। ম্যাচ জেতানোর নায়ককে হাত বাড়িয়ে অভিনন্দন জানালেন জাতীয় নির্বাচক। সব মিলিয়ে সবার আগ্রহের কেন্দ্রে এই বাঁহাতি স্পিনার। এমনিতে এই দৃশ্যগুলো বেশ বিরল। ৯ বছর ধরে তিনি জাতীয় দলে খেলছেন। দেশের মাঠে টেস্টে নিয়মিত পারফর্মও করছেন। ২০১৪ সালে তার অভিষেক থেকে এখনও পর্যন্ত তার চেয়ে বেশি টেস্ট উইকেট নিতে পারেননি বাংলাদেশের আর কেউ। কিন্তু পাদপ্রদীপের এমন আলো তার ওপর পড়ে কমই। সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের স্মরণীয় জয়ের বড় কারিগর তাইজুল। দুই ইনিংস মিলিয়ে তার শিকার ১০ উইকেট। টেস্ট ক্রিকেটে বিশেষ করে ঘরের মাঠে নিয়মিতই ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন ৩১ বছর বয়সী স্পিনার। তবে এবার বাকি সবার ছায়া থেকে বেরিয়ে পুরো ম্যাচটি নিজের করে নিয়েছেন তাইজুল। তাই তো দলের ক্রিকেটার, টিম ম্যানেজমেন্ট কিংবা মাঠে বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীদের মাঝে তাইজুলকে নিয়ে অন্য সময়ের চেয়ে তুলনামূলক বেশিই উন্মাদনা। নিজের বাঁ হাতের কীর্তি দিয়েই মূলত সিলেট টেস্টকে নিজের করে নিয়েছেন তিনি। প্রথম ইনিংসে ৪ উইকেট শিকারি তাইজুল দ্বিতীয় ইনিংসেও নিউ জিল্যান্ডের প্রথম ৭ উইকেটের ৪টি নেন। তার দারুণ পারফরম্যান্সেই চতুর্থ দিনের শেষ সেশনে জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে বাংলাদেশ। চার দিন এমন দারুণ পারফরম্যান্সের পর ম্যাচের শেষটা তাইজুলের হাত ধরে হওয়াটাই যেন ছিল নিয়তি। টিম সাউদিকে ফিরিয়ে ক্যারিয়ারের দ্বাদশ ৫ উইকেট পূর্ণ করেন তাইজুল। পরে তার বলেই জাকিরের হাতে ক্যাচ দেন সোধি। নিশ্চিত হয় বাংলাদেশের জয়। সাফল্যের রাঙা ম্যাচের শেষটা আরও বর্ণিল হয়ে ওঠে তাইজুলের জন্য। অভিষেকের পর থেকেই টেস্টে নিয়মিত পারফরমার তাইজুল। দেশের বাইরে পরিসংখ্যান অত ভালো নয় তার। তবে কন্ডিশন ও দলের কম্বিনেশন মাথায় রেখে বিদেশের মাঠে কখনও তেমন টানা খেলার সুযোগও পাননি বাঁহাতি স্পিনার। মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে গত বছরের ইতিহাসগড়া জয়ের ম্যাচেও যেমন বাইরেই থাকতে হয়েছে তাকে। বছর ঘুরে এবার দেশের মাঠে একই দলের বিপক্ষে আরেকটি স্মরণীয় জয়ের নায়ক তিনিই। শুধু ১০ উইকেট নেওয়ার জন্যই নয়, ম্যাচে স্বাগতিকদের বোলিং আক্রমণের নেতাই ছিলেন তাইজুল। একপ্রান্তে তার হাতে বল দিয়ে নির্ভার থাকতে পেরেছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। চতুর্থ দিন বিকেলে একসময় মনে হচ্ছিল, হয়তো প্রতি বলেই উইকেট পাবেন তাইজুল। সেটি পাওয়া আসলে সম্ভবও নয়। তবে সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে দলের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়ে যেন সামনের দিনগুলোর জন্য নিজেকে বোলিং আক্রমণের নেতা হিসেবে প্রস্তুত থাকার বার্তা দিলেন তাইজুল। সিলেটে আঙুলের চোটের কারণে খেলতে পারেননি সাকিব। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সামনে হয়তো আর এই সংস্করণে দেখা যাবে না তাকে। অথবা খেললেও হয়তো বেছে বেছে কিছু ম্যাচ খেলবেন তিনি। সেক্ষেত্রে স্পিন আক্রমণের দায়িত্ব এখন থেকে নিয়মিতই সামলাতে হবে তাইজুলকে। আর সাকিবের সঙ্গে খেলার সময় যতটা নিখুঁত তাইজুল, তার চেয়ে বেশি ক্ষুরধার সাকিববিহীন ম্যাচে। এখন পর্যন্ত সাকিবের সঙ্গে খেলা ২৪ ম্যাচের ৪৫ ইনিংসে ৩২.১৬ গড় ও ৬৬.৭ স্ট্রাইক রেটে তাইজুল নিয়েছেন ৯৩ উইকেট। সাকিব না থাকা ১৯ ম্যাচের ৩১ ইনিংসে তিনি ৩০.৭১ গড় ও ৫৯.৮ স্ট্রাইক রেটে ধরেছেন ৯৪ শিকার। ক্যারিয়ারের ১২টি ৫ উইকেটের মধ্যে ৮টিই তিনি নিয়েছেন সাকিববিহীন ম্যাচে। অর্থাৎ সাকিব থাকলে অবশ্যই তিনি যথেষ্ট ভালো বোলিং করেন বিশেষ করে ঘরের মাঠে। তবে সাকিব না থাকলে যে বাড়তি দায়িত্ব কাঁধে বর্তায়, সেটি আরও নিখুঁতভাবে পালন করেন বাঁহাতি স্পিনার। দলের মূল স্পিনার হওয়ার গুরুদায়িত্ব যেন বের করে আনে তাইজুলের সেরাটা। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্তই হয়ে থাকবে সিলেট টেস্ট। ম্যাচের দুই ইনিংসেই নিউ জিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ব্যাটসম্যান কেন উইলিয়ামসনকে ফিরিয়েছেন তাইজুল। যখনই প্রয়োজন পড়েছে, এনে দিয়েছেন ব্রেক থ্রু। তার হাতে যে বিশ্বাস নিয়ে বল দিয়েছেন শান্ত, এর পূর্ণ প্রতিদান পেয়েছেন প্রায় প্রতিবার। দুই ইনিংস মিলিয়ে পাওয়া ১০ উইকেটে ম্যাচসেরার পুরস্কার উঠেছে তাইজুলের হাতে। প্রায় ৯ বছর পর এই স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। এমন না যে, ৯ বছরে পারফর্ম না করেই খেলে গেছেন তাইজুল। নিয়মিতই ভালো বোলিং করেছেন তিনি। প্রতিবারই আড়াল হয়েছেন কখনও সাকিব, কখনও মেহেদী হাসান মিরাজ কিংবা নাঈম হাসানের আলোয়। ২০১৮ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই মাঠের প্রথম টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে ১১ উইকেট নিয়েছিলেন তাইজুল। কিন্তু ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় বড় ব্যবধানে হেরেছিল বাংলাদেশ। এবার এই আঙিনাতেই তিনি ১০ উইকেট নিয়ে নিজেকে রাঙাতে পারলেন জয়ে। জয়ের পর তাই পুরো আলোটাই এখন তাইজুলের ওপর। এর বাইরে ম্যাচের নায়ক হিসেবে যাকে নিয়ে আলোচনা হতে পারে, তিনি নাজমুল হোসেন শান্ত। ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে সেই অধিনায়কও শোনালেন তাইজুলের স্তুতি। “আমার মনে হয়, টেস্ট সংস্করণে বেশ কয়েক বছর ধরে তাইজুল ভাই অন্যতম সেরা বোলার। ওঁর সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা, লম্বা সময় একই জায়গায় বল করতে পারেন। ওই বিশ্বাসটা আমার ছিল, ওটাই আমি কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি।” “যদি খেয়াল করে দেখেন, অনেক লম্বা সময় ধরে তিনি একপাশ থেকে বল করে গেছেন। তাকে ওরকম আলাদা কোনো প্ল্যান আমি দেইনি, উনিও করেননি। তার যেটা প্ল্যান ছিল, কীভাবে লম্বা সময় এক জায়গায় বল করা যায়।” সিলেট টেস্টের মতো মিরপুরেও স্বাভাবিকভাবেই তাইজুলের কাঁধেই থাকবে বোলিং বিভাগের বড় দায়িত্ব। শুধু মিরপুর নয়, আগামী দিনগুলোতে ৩১ বছর বয়সী স্পিনারকেই সামলাতে হবে গুরুদায়িত্ব। সেই দায়িত্বের চ্যালেঞ্জ যেমন থাকবে, থাকবে ভালো কিছু করে সেটি রাঙিয়ে রাখার সুযোগও।