ভালুকায় মনিংসান কলেজে শিক্ষার আড়ালে বাণিজ্য 

এফএনএস (মোঃ আলমগীর হোসেন; ভালুকা, ময়মনসিংহ) : : | প্রকাশ: ৩ ডিসেম্বর, ২০২৩, ০৭:৩৪ এএম

ময়মনসিংহের ভালুকায় মনিংসান কলেজে শিক্ষার আড়ালে চলছে বাণিজ্য,ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। মর্নিংসান মডেল কলেজে শতভাগ নিশ্চয়তায় দিয়ে পরীক্ষা শুরুর ৭ দিন আগে কয়েক শত পরিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়। ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীরা যে প্রবেশপত্রে রোল নন্বরে পরিক্ষা দিয়েছে ফল প্রকাশের পর ওই রোল নন্বরে ফলাফল দেখতে চাইলে দেশের অন্য কলেজের শিক্ষার্থীর ফল বের হয়ে আসে। এতে ফলাফলে গড়মিল হয়। ফলে মনিংসাল কলেজের শিক্ষার্থীরা গণহারে ফেল করেছে। কলেজের অধ্যক্ষ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মুখে ফল প্রকাশের দিন নতুন রোল নম্বর সংবলিত আরেকটি প্রবেশপত্র হাতে ধরিয়ে দেয়। এতে ফেল করা শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে অধ্যক্ষকের কার্যালয় ঘেরাও করে অধ্যক্ষকে প্রায় তিন ঘন্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। খবর পেয়ে ভালুকা মডেল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতির শান্ত করে। মোটা অংকের টাকা বিনিময়ে অন্য কলেজের টেস্ট পরিক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের চলতি বছর পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দেয়ায় এঘটনা ঘটেছে।

কলেজ সূত্রে জানা যায়, ভালুকা পৌরসভার মেজরভিটা এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে আতাউর রহমান জুয়েল প্রথমে মর্নিংসান নামের একটি কিন্ডারগার্টেন চালু করেন। পরে তিনি সেটিকে মডেল স্কুল এবং ২০১২ সালে কলেজ শাখা চালু করেন। ২০২১ সালে মর্নিংসান মডেল কলেজ থেকে ২শত ৪২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২শত ১৬ জন, ২০১৩ সালে ২ শত ৪৪ জনের মধ্যে ২ শত ২২ জন পাশ করে। এ কারনে আশপাশের কলেজে টেস্ট পরিক্ষায় ফেল করা অনেক শিক্ষার্থী মোটা অংকের টাকা দিয়ে মনিংসান কলেজে ভর্তি হয়। মনিংসাল কলেজ থেকে চলতি বছর একজন অনিয়মিতসহ ৮ শত ১৬ জন শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে । এর মধ্যে ফেল করেছে ৪ শত ৪৩ জন পরীক্ষার্থী। 

বোর্ডের ছাড়পত্র ছাড়াই (বিটিসি) মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যানের যোগসাজশে মর্নিংসান মডেল কলেজের অধ্যক্ষ শিক্ষার্থীদের ভর্তি করিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। কোন প্রকার বোর্ডের অনুমোদন না নিয়ে কলেজের দুটি শাখাও চালু করেছেন মর্নিংসান মডেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। যার একটি শাখা ঢাকা বোর্ডের অধিনে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা মাওনা খোলা হয়েছিল। অপরটি ভালুকা উপজেলার স্কয়ার মাস্টার বাড়ি খাদিজা প্যালেজ মার্কেটে খোল রয়েছে।
বিধিবহির্ভূত এমন কাজের জন্য মর্নিংসান মডেল কলেজের দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার আব্দুল আউয়াল কলেজ এবং মাওনা পিয়ারআলী কলেজের দুইজন অধ্যক্ষ।  

ফেল করা শিক্ষার্থীরা জানায়, মনিংসান কলেজের অধ্যক্ষের শতভাগ পাশের নিশ্চয়তা পেয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে পরীক্ষার শুরুর ৭দিন আগে ভর্তি হয়ে ফরম পূরন করছি এবং প্রবেশপত্র সংগ্রহ করে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেছি।

ফলাফল প্রকাশের পর পরীক্ষার খাতার রোল নম্বরে সার্চ দিলে অন্য কলেজের শিক্ষার্থীর নাম ফলাফল বেড়িয়ে আসে। পরে কলেজে যোগাযোগ করলে কর্তৃপক্ষ ফেল করা সকল শিক্ষার্থীর হাতে নতুন রোল নম্বর সংবলিত আরেকটি প্রবেশপত্র ধরিয়ে দেন। নতুন রোল নম্বরে সার্চ দিলে ফেল দেখায়। এ সময় ক্ষোব্ধ শিক্ষার্থীরা কলেজ অধ্যক্ষকের কার্যালয় ঘেরাও করে ৩ ঘন্টা অবরোধ করে রাখে। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ধমন করার লক্ষে অধ্যক্ষ,বিভিন্ন অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন দিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে হুমকী প্রদান করেন যে তোরা যদি আন্দোলন নন্ধ না করিস তাহলে তোদের বিপদ হবে। ২৯ নভেম্বর সকালে উপজেলা পরিষদ সভাকক্ষে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে আলোচনার সময় শিক্ষার্থীরা ওই অভিযোগ করে। 

শিক্ষার্থী মোছাঃ মুন্নি আক্তার জানান,সে গাজীপুরের মাওনা পিয়ার আলী কলেজের শিক্ষার্থী ছিল। টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করার পর শতভাগ পাশের নিশ্চয়তা দিয়ে ২৮ হাজার টাকার বিনিময়ে মর্নিংসান কলেজে ফরম পূরণ করে পরীক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু ভালো পরীক্ষা দিয়েও ফেল করেছে। একই ধরণের কথা বলেন, রুনা,নুপূর আক্তার,সাদিয়া ও মিম নামের শিক্ষার্থীরা। রুনা ৫০ হাজার এবং মিম ২৫ হাজার টাকায় ফরম পূরণ করে মর্নিংসান কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেছে।

একজন অভিবাক গাজীপুরের মাওনার বাসিন্দা ইমান আলী জানান, অধ্যক্ষের আশ্বাসে এবং শতভাগ পাশের নিশ্চয়তা পেয়ে মর্নিংসান কলেজ থেকে আমার মেয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু সে ফেল করেছে।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার আবদুল আউয়াল কলেজের বাণিজ্য শাখার এক শিক্ষার্থী বলেন, টেস্ট পরীক্ষায় সে দুই বিষয়ে অকৃতকার্য হয়। ওই কলেজ থেকে তাকে ফরম পূরণের সুযোগ দেওয়া হয়নি। পরে ভালুকার মর্নিংসান কলেজ থেকে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে ফরম পূরণ করে পরিক্ষা দিয়েছে কিন্তু সে অকৃতকার্য হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাশের অন্য কলেজের একজন অধ্যক্ষ ও দুইজন অধ্যাপক জানান, মর্নিংসান কলেজের অধ্যক্ষ আতাউর রহমান জুয়েলের সাথে বোর্ড চেয়ারম্যানের বিশেষ সখ্যতা রয়েছে। সেটিকে কাজে লাগিয়ে রাতারাতি মর্নিংসান কলেজ তিনতলা ভবন সহ অনেক অর্থের মালিক বনে যান। সম্প্রতি তিনি ২ কোটি,৫০ লাখ টাকা খরচ করে ভালুকা মেজর ভিটায় জমিসহ একটি বিশাল বাড়ি কিনেছেন। তার দুনীতির খবর গনমাধ্যমে প্রকাশ হলে কৌশলগত কারণে কিছু অর্থ ও জমি তার বাবার নামে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে হস্থান্তর করেন দেন। এছাড়াও বর্তা ও ধামশুর মৌজায় তার নামে দেড় একর জমি রয়েছে। 

ঢাকা বোর্ডের অধিনে থাকা আব্দুল আউয়াল ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম বলেন, বোর্ড ট্রান্সফার সার্টিফিকেটে (বিটিসি) ছাড়াই তাঁর কলেজের টেস্টে ফেল করা শিক্ষার্থীদেরকে মনিংসান কলেজে এচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। ২ শত ৫২জন শিক্ষার্থীর রেজিস্টেশন কার্ড আব্দুল আওয়াল ডিগ্রী কলেজে জমা রয়েছে। এসব অনিয়মের কারণে গত ৬ আগস্ট আব্দুল আওয়াল ডিগ্রী কলেজ ভালুকার মর্নিংসান কলেজের বিরুদ্ধে মাউশির মহা-পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ।

শ্রীপুরের মাওনা পিয়ার আলী কলেজের অধ্যক্ষ এ কে এম আবুল খায়ের জানান, তাঁর কলেজের বিজ্ঞান শাখার এক ছাত্রী টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করেন। পরে ওই শিক্ষার্থী টিসি না নিয়েই ভালুকার মর্নিংসান কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। এটা কিভাবে সম্ভব তার জানা নেই। তিনি আরও বলেন, তাঁর কলেজ থেকে ৮শত মিটারের দুরে মর্নিংসান কলেজ মাওনা শাখা খুলেছেন। এঘটনায় গত ২৭ জুলাই শিক্ষা বোর্ডে অভিযোগ দেয়া হয়েছে।

মর্নিংসান মডেল কলেজের অধ্যক্ষ আতাউর রহমান জুয়েল শতভাগ পাশের নিশ্চয়তা দিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়টি অস্বীকার করেন। বিটিসি ছাড়া শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে তিনি বলেন, এটি ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলতে পারবেন। বোর্ডের নিয়মের বাইরে কোনো টাকা নেয়া হয়নি । তার কলেজ থেকে এ বছর ৮ শত ১৬ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছে। ফেল করেছে ৪ শত ৪৩ জন শিক্ষার্থী। ভালুকা পৌরসভা ও বর্তা গ্রামের জমি তার নামে কেনা।ধামশুরের জমি কলেজের নামে কেনা। ভালুকা পৌরসভার মেজর ভিটার ৪তলা ভবনটি তার বাবার নামে বায়না করা হয়েছে।

ময়মনসিংহ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আবু সায়েম মো: হাসান জানান, ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে পর্যাপ্ত জনবল নেই। শেষের দিকের আট হাজার শিক্ষার্থীর প্রবেশপত্র নিয়ে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তারপরও প্রবেশপত্র সংশোধন করে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্রে একমাস আগে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু যথাসময়ে ওই শিক্ষার্থীদের হাতে সংশোধিত প্রবেশপত্র বিতরণ করা হয়নি। যার ফলে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

ময়মনসিংহ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান গাজী হাসান কামাল জানান,মর্নিংসান কলেজের অধ্যক্ষের সাথে আমার বিশেষ কোনো সখ্যতানেই। ৫বছরে মধ্যে মনিংসান কলেজটি একবার পরিদর্শন করেছি। বোর্ড ট্রান্সফার সার্টিফিকেটে (বিটিসি) ছাড়া অন্য বোর্ডের ভর্তি বিষয়টি দেখার দায়িত্ব কলেজ অধ্যক্ষের। শিক্ষার্থী ভর্তি ও পরীক্ষার ফলাফলে কোনো অনিয়ম থাকলে কেউ ছাড় পাবে না।ওই কলেজের অনিয়মের বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে এ বোর্ডে ২৯টি কলেজের ৯ হাজারের উপরে পরীক্ষার্থীর এ সমস্যা হয়েছে। এক মাস পূর্বেই স্বস্ব কেন্দ্রে সংশোধিত নতুন রোল নম্বর সম্বলিত প্রবেশপত্র প্রেরণ করা হয়েছে।

 

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW