নতুন শিক্ষাক্রমে পা দিচ্ছে বাংলাদেশ। বন্ধ হচ্ছে পরীক্ষা। থাকছে না জিপিএ-নম্বর নিয়ে মাতামাতিও। মূল্যায়নে আসছে চিহ্ন বা সূচক, যা নিয়ে শঙ্কা, সংশয়ের শেষ নেই অভিভাবকদের। অভিযোগ-অনুযোগ রয়েছে শিক্ষকদেরও। যে ধারায় গত পাঁচ দশক বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আবর্তিত ছিল, সেই জায়গা থেকে ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ার কথা জানাচ্ছে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে নান্দনিক ও আনন্দময় করার পাশাপাশি চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিজেদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১’ প্রণয়নের প্রয়াস হাতে নিয়েছে সরকার। নতুন শিক্ষাক্রমে শিখনকালীন মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষার্থী কতটুকু শিখল, তা নিয়মিত ক্লাসে যাচাই করা হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীর দুর্বলতা যাচাই করে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে। এই সহযোগিতার কাজটি করবেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক কিংবা বিষয়-সংশ্লিষ্ট যে কোনো ব্যক্তি। তবে অনেক শিক্ষক এ শিক্ষাক্রম ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছেন না বলে বিভিন্ন আলোচনা থেকে জানা যাচ্ছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ ঠিকমতো হচ্ছে না, এমনকি সময়মতো শিক্ষক সহায়িকাও হাতে আসছে না বলে অভিযোগ করছেন তারা। পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে গতানুগতিক ধারার শিক্ষা কার্যক্রমই যেখানে বহুকাল ধরে ব্যাহত হয়ে আসছিল, সেখানে নতুন শিক্ষাক্রমে তা যে কঠিন হয়ে পড়বে সেটাই স্বাভাবিক।
দেশের শহরগুলোতে অভিজ্ঞ এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষক কিছুটা থাকলেও গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে তা একটি বড় সমস্যা। তাছাড়া শিক্ষার্থীর শিখন সহায়তায় অভিভাবকদের নিয়মিত ওয়াকিবহাল থাকার দিকটি নতুন শিক্ষাক্রমের তাৎপর্যপূর্ণ দিক। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক এমন অনেক কাজ দেন যা অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয়। অথচ সব অভিভাবকের শিক্ষা, সচেতনতা এক নয়। এর জন্য বিদ্যালয়েও অভিভাবকদের নিয়মিত সমাবেশ প্রয়োজন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, নিয়মিত সমাবেশ হয় না বা হলেও অনেক সময় সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায় না। তাছাড়া নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিখনসামগ্রী সংগ্রহ, তৈরি, প্রদর্শন, প্রয়োজনীয় উপকরণ জোগানোর জন্য নেই কোনো নির্দিষ্ট বাজেট; যা এই নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়নকে কঠিন এবং প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। অভিভাবকরা বলছেন, শহরের সচেতন অভিভাবকরা এই শিক্ষা উপকরণের জোগান দিতে পারলেও মফস্বল এলাকার অভিভাবকরা পারছেন না। ফলে দরিদ্র পরিবারের ওপর এটি একটি বাড়তি বোঝা। তাই নতুন শিক্ষাক্রমের ব্যাপারে অভিভাবকদের আস্থা তৈরি করতে হবে। আমরা আশা করি এজন্য প্রয়োজনীয় বাজেট, অবকাঠামোগত উন্নতি এবং যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক তৈরিতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো মনোযোগ দেবেন।
নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় বলা হচ্ছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলা’র অভিলক্ষ্যে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের আনন্দময় পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও চাপ কমিয়ে, গভীর শিখনের বিষয়ে গুরুত্বে মুখস্থ-নির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিখনের অগ্রাধিকার প্রদান করা। এ ছাড়া খেলাধুলা ও সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা যেন ক্লাসের পাঠ ক্লাসেই শেষ করতে পারে, যাতে করে বাড়ির কাজ বা হোমওয়ার্ক ফেলানো সম্ভব হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবন শেষে নির্দিষ্ট সময়ে অর্জিত পারদর্শিতায় প্রাপ্ত সনদে জীবন-জীবিকার সুযোগ পায়। তবে এবারের শিক্ষাক্রম উন্নয়নে সর্বজনবিদিত দার্শনিক, ঐতিহাসিক, মনোবিজ্ঞান, বাস্তবসম্মতভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির প্রতি অগ্রাধিকারের কথা বলা হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের কারিকুলাম প্রণয়নে এসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব অনেক আগে থেকে দিয়ে এসেছে। তবে দেরি করে হলেও এবার শিক্ষাক্রমে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি মৌলিক কাঠামো দেওয়ার চেষ্টা করেছে। দীর্ঘদিন আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার মূল্যায়নের প্রধানতম অনুষঙ্গ হিসেবে পরীক্ষার ফলাফলকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। যদিও এইসব জিপিএ ফলাফল আমাদের প্রজন্মকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাকে গিলছিল বেশ। দক্ষ ও চাক্ষুষ জনশক্তি না তৈরি হওয়ায় দিনে দিনে ‘শিক্ষাব্যবস্থায়’ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছিল, সেই জায়গায় থেকে বের হয়ে নতুন শিক্ষাক্রম চাওয়া আমাদের দীর্ঘদিনের। যে শিক্ষাক্রম হবে সময়োপযোগী, যা হবে বাস্তবতার আদলে। তাই সর্বোপরি শিক্ষার সব স্তরে মান উন্নয়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষা যত মানসম্মত হবে, আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন হবে তত বেশি।