বড়শিতে গাঁথা জ্যান্ত তাজা মানুষ। চড়ক গাছে ঝুঁলিয়ে প্রায় ২৫/৩০ ফুট শূন্যে ঘুরাতে ঘুরাতে সন্ন্যাসী মনা কর্মকার ছুঁড়ে দিচ্ছেন বাতাসা। শুধু মনা নয়,একে একে ৬ সন্ন্যাসীর পিঠে বঁড়শি বিঁধে শূন্যে ঘুরে পালন করলেন শিব পূজার অংশ চড়ক উৎসব। গাঁ শিউরে ওঠা এই দৃশ্য দেখলেন প্রায় ২০ হাজার নারী-পুরুষ। ফতেপুর বাজারের বকুলতলায় প্রতি বছরের মত সোমবার বিকেলে অনুষ্ঠিত হয়েছে চড়ক উৎসব।মহেশপুর শহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমের একটি গ্রাম ফতেপুর।এ গ্রামের বকুলতলা বাজারে ভারতীয় পঞ্জিকা মতে ২ বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয় চড়ক পূজা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা উৎসব আয়োজনে এ পূজা করে থাকেন। প্রতি বছর এই পূজার মূল আকর্ষণ থাকে ৬/৭ সন্ন্যাসীর পিঠে বড়শিবিদ্ধ হয়ে শূন্যে ঘোরা। এবার একজন সন্ন্যাসী অসুস্থ থাকার কারণে ৬ সন্ন্যাসী বঁড়শি (বান) ফুঁড়ালেন।
স্থানীয়রা জানায়, প্রায় দুইশ’ বছর ধরে চলে আসছে এ চড়ক পূজা। আর এ পূজাকে ঘিরে বকুলতলা বাজারে ২ দিন ধরে চলে বর্ণাঢ্য লোকজ মেলা।ফতেপুরের এ চড়ক মেলার মূল আকর্ষণ বড়শিবিদ্ধ হয়ে শূন্যে ঘোরানো (স্থানীয় ভাষায় বলা হয় বান ফোড়ানো) এ দৃশ্য অবলোকনের সাথে সাথে মেলায় কেনা কাটা করতে সোমবার সকাল থেকে হাজির হয় প্রায় ৩০ হাজার নারী-পুরুষ। দুপুরের পর থেকেই ভিড় বাড়তে থাকে মেলা প্রাঙ্গনে। বিকেলের মধ্যে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় পুরো এলাকা জুড়ে। চারদিকে সাজ সাজ রব। পুরো এলাকা জুড়ে উৎসবের আমেজ। ঠিক বিকেল সাড়ে ৪ টা বাজার সাথে সাথে ৬ সন্ন্যাসী ফতেপুর গ্রামের মনা কর্মকার, বিল্পক কর্মকার,কৃশচন্দ্রপুর গ্রামের বাসুদেব কুমার ও বৌচিতলা গ্রামের মহাদেব কুমার, অধীর কুমার, মহাদেব হালদার ফতেপুর বাঁওড়ে স্নান করেন। এরপর ৬ সন্ন্যাসী মাটির কলসে জল (পানি) ভরে মাথায় নিয়ে আসেন মেলা প্রাঙ্গনে চড়ক গাছের গোড়ায়। ঠিক ৪ টা ৩০ মিনিটে প্রথমে মনা কর্মকার পিঠে দুটি বঁড়শি বিদ্ধ করা হয়। এ সময় স্মরণ করা হয় মহাদেব শিব ঠাকুরকে। এরপর ভীমকে ১০/১৫ জন পুরুষ ধরাধরী করে ঝুঁলিয়ে দেন চড়ক গাছে। অপর গাছের অপর প্রান্তে থাকা কপিকলের বাঁশ জোরে জোরে ঘোরাতে থাকেন ২০/৩০ জন যুবক। চড়ক গাছে লটকে দেয়ার সাথে সাথে কিছু মহিলা তাদের এক দেড় বছরের শিশু সন্তানকে তুলে দেন সন্ন্যাসীদের কোলে। তাকে নিয়ে শূন্যে ঘুরতে থাকে সন্ন্যাসীরা। এ অবস্থায় ছিটিয়ে দেয়া হয় বাতাসা। এভাবেই বড়শীতে বিঁধে ৪/৫ পাক শূন্যে ঘুরে নেমে আসেন মনা কর্মকার। এ নিয়ে ২২ বার চড়ক গাছে চড়লেন তিনি। মনা কর্মকার জানান, এখানে হিন্দুর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কিন্তু সবাই চড়ক গাছে উঠতে পারে না। এতে উঠতে গেলে মনের অনেক সাহস লাগে। মনার পর একে একে বান ফোঁড়ালেন বিল্পব কুমার, বাসুদেব কুমার,মহাদেব কুমার ও অধীর কুমার।স্থানীয়রা জানান, আগে শুধুমাত্র পিঠে বান ফুঁড়িয়েই ঝুঁলিয়ে দেয়া হতো চড়ক গাছে। আর সে অবস্থাতে ঘোরানো হতো। প্রায় ১শ’ ১৫ বছর পূর্বে এক সন্ন্যাসীর পিঠের চামড়া ছিড়ে পড়ে আহত হওয়ার কারণে বড়শির উপর এখন গামছা পেঁচিয়ে দেয়া হয়।সন্ন্যাসী বিল্পব কর্মকার জানান, শিব ঠাকুরের সন্তুষ্টির জন্যই তারা প্রতি বছর চড়ক গাছে চড়ে থাকেন। তিনি আরো জানান, শরীরে বঁড়শি বিধার ফলে বড় ধরনের ক্ষতের সৃষ্টি হলেও সামান্য রক্ত বের হয়। কিন্তু এর জন্য কোনো ওষুধ লাগে না। চড়ক গাছ থেকে নামিয়ে গাছের গোড়ায় থাকা সিঁদুর টিপে দিলেই হয়।সন্ন্যাসীরা জানান, পূর্ব পুরুষদের কাছে শুনেছেন দুশ’ বছর আগে এখানে চড়ক পূজা শুরু হয়। আগে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে এ পূজার আয়োজন করা হতো। সেই স্থানে সরকার আশ্রায়ন প্রকল্প গড়ে তোলার কারণে এখন ফতেপুর বকুলতলার বাজারে চড়ক পূজা হয়। এ পূজাকে ঘিরে বসে জমজমাট মেলা। লোকজ ঐতিহ্যের হরেক রকম পসরা সাজিয়ে দোকানিরা বেচাকেনা করেন ২ দিন ধরে। মিষ্টির দোকানি মোসলেম আলী ১০/১২ রকমের মিষ্টি সাজিয়ে বিকিকিনি করছেন। তিনি এবার ১৫ বারের মত মেলায় আসলেও বেচাকেনা বেশ ভালোই হচ্ছে বলে জানান। কুষ্টিয়ার একতারপুরের সাখা সিঁদুর বিক্রেতা বিমল সরকারও বিকিকিনি করছেন তার পণ্য সম্ভার। পূজা ও মেলা কমিটির সভাপতি সাধন কুমার ঘোষ ও সাধারণ সম্পাদক সুবল কর্মকার জানান, চড়ক পূজা মূলত শিব পূজার অংশ বিশেষ। নানা আনুষ্ঠানিকতায় তা সম্পন্ন করা হয়ে থাকে।