গাব অদ্ভুত এক বৃক্ষ

প্রকাশ ঘোষ বিধান : | প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ০৭:০২ পিএম

গ্রামাঞ্চলের ঝোপ-ঝাড়ে যে গাছটিকে নিয়ে ভূত-পিচাশের ভয়ের গল্প শুনা যায় সে গাছটির  নাম দেশি গাব গাছ। আমারা ছোট্ট বেলা থেকেই গল্পে শুনে বড় হয়েছি গাব গাছে ভূত থাকে। গাব গাছের কথা শুনলে মনে ভয় ভয় লাগে। গাব গাছে পেতনি থাকে, সাদা শাড়ির আছল বিছিয়ে। অদ্ভুত এক গাছ গাব। বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন উপমায় স্থান পেয়েছে গাব গাছ। যেমন গাব গাছের ভূত, গাবের আঠার মতো লেগে থাকা, গাবের ঢেকি ইত্যাদি। এর ফলটি  খুব একটা সুস্বাদু নয়। দেশি গাব হালকা মিষ্টি, কষযুক্ত একটি ফল। এটি কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকে এবং পাকলে হলদেটে রং ধারণ করে। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপকূল অঞ্চলে এই গাব গাছ প্রচুর জন্মে।
গাব একটি চিরসবুজ বৃক্ষ। আমাদের দেশে দুই ধরনের গাব দেখা যায়। একটি দেশি অন্যটি বিলাতি গাব। বহু বর্ষজীবী দেশি গাব বাংলা ও হিন্দিতে গাব, সংস্কৃিত ভাষায় এর নাম তিন্দুকা এবং তামিল ভাষায় তুম্বিকা নামে পরিচিত। দেশি গাবের আদি নিবাস দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। দেশি গাব গাছ বহুবর্ষজীবি। এটি খুবই ধীরে ধীরে বাড়ে। এর মাথাটা ঝোপালো। পাতা গুলো মোটা, চর্মবৎ, লম্বা ও চকচকে। গাবগাছের ডালপালা খুব শক্ত। চিকন ডালগুলোও সহজে ভাঙা যায় না। ঘন পল্লবের পরিপক্ক একটি গাব গাছ ৩০-৩৫ মিটার লম্বা আর ৬৫-৭০ সেন্টিমিটার ব্যাসের হয়ে থাকে। গাবগাছের ফুলগুলো অদ্ভুত। ছোটো ছোটো সাদা মার্বেলের মতো দেখতে। দেশি গাবের ফল গোলাকার। পাকা ফলের ভেতরটা আঠালো ও চটচটে। খেতে হালকা মিষ্টি ও কষযুক্ত। সবুজ ফল পাকলে হলুদ বর্ণ ধারণ করে। গাব ফল কচি অবস্থায় সবুজ রঙের, একটু পরিপক্ক হলে এর গায়ে গাঢ় বাদামী রঙের একটা আস্তরণ পড়ে এবং সম্পূর্ণ পরিপক্ক হলে হলদেটে রঙ ধারণ করে।
দেশি গাবের ফল থেকে ট্যানি জাতীয় আঠা তৈরি করা হয়। টেকসই করতে এর আঠা জালে, পশুর চামড়ায় এবং নৌকায় মাখানো হয়। ফলে সেগুলো টেকসই হয়, পানিতে সহজে নষ্ট হয়না। এছাড়া কাপড়ে কালো রঙ করতেও এটি ব্যবহৃত হয়। দেশি গাবের প্রধান ব্যবহার এটাই। গাব গাছের কাঁচা ফল পঁচিয়ে এক ধরণের রঞ্জক তৈরী করা হয়, যা দিয়ে জেলেরা তাদের জালে রঙ করে। গাব কষের তৈরী আঠা অনেকদিন টিকে। গাবের আঠা জেলেরা মাছ ধরার জালে লাগায়। এতে জাল মজবুত হয় ও সহজে পচন ধরে না।
বিলাতি গাবের আদি নিবাস ফিলিপাইনে। কিন্তু এর স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণের কারণে প্রায় সারা বিশ্বেই এর চাষ হয়। প্রায় সব ধরনের মাটিতে গাবের চাষ করা যায়। তবে উর্বর মাটিতে বিলাতী গাব ভাল হয়। গাছে তেমন যতেœর প্রয়োজন হয় না। মাগুরা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, পিরোজপুর এলাকায় প্রচুর বিলাতি গাব জন্মে। গাবগাছ ৮-১০ বছর বয়স হলে স্বাভাবিক ফলন দিতে আরম্ভ করে। আকারে মাঝারি, লম্বায় ১০-৩০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে গাছে ফুল আসে। ফুল দেখতে ক্রীম সাদা রংয়ের এবং ছোট আকৃতির। গাব ফুল এক গুচ্ছে ৩-৬টি ফোটে। ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসে গাছে ফুল ফোটে এবং জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা যায়। শীতের শেষে গাছে ফুল আসে এবং বর্ষার শেষ ভাগে ফল পাকে। কাঁচা ফল হালকা সবুজ বা বাদামী হয়। ফল পাকলে উজ্জ্বল বাদামি বা গাঢ় লালবর্ণ ধারণ করে। গাব ফলনগুলী পুষ্ট হলে উজ্জ্বল ও চকচকে হবে। পুষ্ট হলেই ফল সংগ্রহ  করা হয়। এটি দেখতে অনেকটা লাল আপেলের মতোই এবং এর গা মখমলের মতো মসৃণ। এটি গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলের চিরসবুজ বৃক্ষ। বিলাতী গাবের ত্বক রেশমী লোমে আবৃত, ফলের শাঁস মেটে। গাছের কাঠ শক্ত প্রকৃতির। কাঠ ঘর তৈরির কাজে লাগে।
বিলাতি গাব একটি ওষুধিগুণসম্পন্ন ও বেশ পুষ্টিকর। সুগন্ধীযুক্ত গাঢ় লাল এই ফল দেখতে তো আকর্ষণীয় বটেই খেতেও ভীষণ মজা। দেশের অনেক মৌসুমী ফলের মধ্যে গাব একটি ফল। আষাঢ় ও শ্রাবন মাসে গাব পাঁকে। বিলাতী গাব পাকলে মিষ্টি এবং সুস্বাদু। বীজ খোসা বাদে পাকা ফলের ভেতরটা সাদা এবং মাখনের মতো নরম। পাকা ফল সুগন্ধী এবং বেশ লোভনীয়। গাব কার্বহাইড্রেট ও মিনারেল সমৃদ্ধ একটি ফল। গাবে প্রচুর পরিমানে আয়রন আছে। এ ফলের পুষ্টিগুণও ব্যাপক। তবে দেশি গাব খাবার হিসেবে কিন্তু খুব বেশি সমাদর পায়নি। বরং ভেষজ  চিকিৎসায় ওষুধ হিসেবে এর ব্যবহার বেশি হয়। বিলাতি গাব সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও পুষ্টি গুণ সম্পন্ন। (লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট)

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW