চারশ’ বছরের পুরনো বরিশালের উত্তর জনপদের সর্ববৃহৎ তিন দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী গৌরনদী উপজেলার চাঁদশী মেলা শুরু হবে আগামী ৯ বৈশাখ। এ উপলক্ষে গত এক সপ্তাহ পূর্ব থেকেই মেলার সকল আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। মেলাস্থলসহ প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিভিন্ন পন্য সামগ্রীর সহ¯্রাধিক ষ্টল বসেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চাঁদশীর শীতলা মন্দিরের চারিপার্শ্বসহ পাশ্ববর্তী প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিভিন্ন পন্য সামগ্রীর পসরা সাজাতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আগত বিক্রেতারা। তবে মেলার বিশেষস্থান দখল করে আছে কাঠের তৈরি নজরকাড়া বাহারি ব্যবহারিক জিনিসপত্র। পাশাপাশি শিশুদের বিভিন্ন খেলনা সামগ্রীসহ অসংখ্য মালামাল ও মিষ্টির দোকান বসেছে। মেলার আরেক প্রধান আকর্ষণ নাগর দোলাতো রয়েছেই। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলা থেকে ট্রাক ভর্তি করে আনা হয়েছে কাঠের তৈরি নজরকাড়া বিভিন্ন ব্যবহারিক জিনিসপত্র।
তবে নানাপ্রতিকূলতার কারণে এবছরও চাঁদশী মেলার প্রধান আকর্ষণ পুতুল নাচ হচ্ছেনা বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা। চারশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী মেলার প্রধান আকর্ষণ পুতুল নাচ না হওয়ায় স্থানীয়দের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় সাংবাদিক মণীষ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, পঞ্জিকামতে প্রতিবছরের ৯ বৈশাখ শীতলা দেবীর পূজা উপলক্ষে চাঁদশীর শীতলা মন্দিরের উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী এ মেলার আয়োজন করা হয়। মেলাকে ঘিরে ওই এলাকায় এখন উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। মেলায় আগত দশনার্থীদের নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় থানা পুলিশের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
চাঁদশী শীতলা মন্দির কমিটির সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান কৃষ্ণ কান্ত দে বলেন, স্থানীয় ভগিরাত ঠাকুর প্রায় চারশ’ বছর পূর্বে শীতলা মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সেই থেকে তাদের বাড়ির নাম হয় শীতলা বাড়ি। কারো কারো কাছে টিকা বাড়ি ও ভগিরত ঠাকুরের বাড়ি নামেও এ বাড়িটি পরিচিত। তিনি আরো বলেন, যেকোন লোক রোগবালাই থেকে মুক্তি পেতে শীতলা দেবীর মন্দিরে মানত করে আরোগ্য লাভ করে থাকেন। বাৎসরিক পূজা ও মেলা উপলক্ষে প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মন্দিরের হাজার-হাজার ভক্তের সমাগম ঘটবে। এ ছাড়া বাৎসরিক পূজা উপলক্ষে তিনদিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহন করা হয়েছে। যারমধ্যে রয়েছে-পূজা অর্চনা, ধর্মীয় আলোচনা, ধর্মীয় সংগীত ও প্রসাদ বিতরণ।
বাঙালীর প্রাণের উৎসব ॥ পহেলা বৈশাখ ঘনিয়ে আসলেই বরিশালে পড়ে যায় সাজসাজ রব। মুখর হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক অঙ্গন। বর্ষবরণের অনুষ্ঠান পালিত হয় বিপুল সমারোহে। মানুষের উদ্দীপনায় এতটুকু ভাঁটা নেই। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রাণ পায় বাঙালীর প্রাণের উৎসব। বাউল গানের আসর, সাংস্কৃতিক কর্মীদের আড্ডা, গীতি আলেখ্য ও মঙ্গল শোভাযাত্রাতো থাকছেই। যার মাধ্যমে তুলে ধরা হয় বাঙালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল বিএম স্কুল মাঠে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর আয়োজনে পহেলা বৈশাখ থেকে তিন দিনব্যাপী বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়েছে। একইদিন চাঁদের হাটে মেলার আয়োজন করা হয় আমানতগঞ্জ টিবি হাসপাতাল মাঠে। আড়িয়াল খাঁ নদীর শাখা পালরদী নদী ঘেঁষে গৌরনদী বন্দরে প্রাচীনকাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী মেলার আয়োজন করা হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও মেলা আয়োজনের কোন কমতি ছিলোনা। একইদিন টরকী নীলখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে দুইদিনের বৈশাখী মেলা বসেছিলো। প্রতিবছরের মতো এবারও ২ বৈশাখ থেকে বার্থী জয়কালী মন্দির প্রাঙ্গণে বসেছিলো তিন দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা। একইদিন প্রায় তিনশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী বাটাজোরের কাটাগাছ তলায় দুই দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা বসেছিলো।
আগৈলঝাড়া ॥ এবারও পহেলা বৈশাখ ত্রিমুখী কদমবাড়ি ও পশ্চিম রাজিহার এলাকায় একদিনের ও ২ বৈশাখ বাহাদুরপুর এবং রাজিহার হাইস্কুল মাঠে বৈশাখী মেলা বসেছিলো। আগামী ২৭ বৈশাখ আস্কর কালীবাড়ি হাইস্কুল মাঠে শুরু হবে তিন দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা।
উজিরপুর ॥ ৩ বৈশাখ থেকে কুমারবাড়ি বাজার সংলগ্ন প্রায় আড়াইশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী কাটাগাছ তলায়, একইদিন কারফা বাজারে এক দিনব্যাপী, ৫ বৈশাখ হারতাপাড়া বাজারে দুই দিনব্যাপী এবং গড়িয়াগাভা এলাকায় তিন দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা বসেছিলো।
বাবুগঞ্জ ॥ পহেলা বৈশাখ বাবুগঞ্জ কলেজ গেট সংলগ্ন এলাকায় দিনব্যাপী, ২ বৈশাখ মীরগঞ্জ, ৪ বৈশাখ বাবুগঞ্জ বাজারে বসেছিলো একদিনের বৈশাখী মেলা। এ ছাড়া আগামী ৮ বৈশাখ মাধবপাশা বাজার, ১২ বৈশাখ মোহনগঞ্জ, ১৫ বৈশাখ রহমতপুর এলাকায় একদিনের বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়েছে।
বানারীপাড়া ॥ ৩ বৈশাখ চাখার বাজারে তিন দিনব্যাপী সর্ববৃহৎ মেলা বসেছে। বাকেরগঞ্জ ॥ পহেলা বৈশাখ থেকে ব্যাপক আয়োজনে সাত দিনব্যাপী মেলা বসেছে বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজ মাঠে। একইদিন ভরপাশায় তিন দিনব্যাপী বৈশাখী মেলার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
হিজলা ॥ পহেলা বৈশাখ থেকে তিন দিনব্যাপী বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়েছে উপজেলা সদরে। একইদিন থেকে কাউরিয়া বাজারে তিন দিনব্যাপী, কালীকাপুর বাজারে দুই দিনব্যাপী ও হরিনাথপুর বাজারে পাঁচ দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা বসেছিলো।
মুলাদী ॥ পহেলা বৈশাখ থেকে তিন দিনব্যাপী সর্ববৃহৎ বৈশাখী মেলা বসেছে চরকালেখা বেপারীর হাট বাজারে।
মেহেন্দীগঞ্জ ॥ একমাত্র দ্বীপ উপজেলায় পহেলা বৈশাখ থেকে দুই দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা বসেছিলো আর.সি কলেজ মাঠে। একইদিন তহশিল অফিস মাঠে সাত দিনব্যাপী ও কাশীপুর বাজারে অনুষ্ঠিত হয়েছে দুই দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা।
বরিশালের কবি ও সাহিত্যিক শিকদার রেজাউল করিম বলেন, আসে উৎসব-জাগে উল্লাস, সাজে নবপল্লবে বনবিথী। নীল গগনে সাদা আর কালো মেঘের খেলা নিরবধি। প্রলয় হুংকার কত ভয়ংকর-ঝড়ে বৃষ্টি আনে তুষ্টি। গাঁয়ের মাঠে প্রাণের মেলায় সাজিয়াছে মন্ডা-মিষ্টি। নবরূপে সজ্জিত প্রকৃতির মাঝে ঘণ কালো মেঘের গর্জন, সাথে রং বেরঙের উৎসব। এমন চিরায়ত রূপ নিয়ে বাংলায় আসে বৈশাখ, শুরু হয় নতুন বছর। আর নববর্ষ বরণ উৎসবকে আকর্ষণীয় করে তোলে বৈশাখী মেলা।
কবি শিকদার রেজাউল করিম আরও বলেন, ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি, হিজরি, চন্দ্র ও সৌর সনকে ভিত্তি করে বঙ্গাব্দ প্রবর্তিত হওয়ার পর মোঘল স¤্রাট আকবরের আমল থেকে বাংলা নববর্ষ পালন শুরু হয়। নতুন বছরের প্রথম দিন ও মাস বৈশাখকে বরণ করতে তখন মেলাসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। কালক্রমে সেটির নাম হয় বৈশাখী মেলা।
শিশুদের খেলনা টমটমের টুংটাং শব্দ, তালপাতার বাঁশির পু-পু-পু সুর, নাগর দোলায় দোল খাওয়া শিশু-কিশোরদের কলরবের সাথে পুতুল নাচের আসর থেকে মাইকে ভেসে আসা লোকজ গান আর ঢাক ঢোলের শব্দ নিয়েই গ্রাম-বাংলায় বসে বৈশাখী মেলা। মেলায় থাকে লোকজ খাদ্যদ্রব্য মুড়ি-মুড়কি, জিলাপি, রসগোল্লা, খই-চিড়া বাতাসা। গাঁয়ের বধূদের জন্য কাচের চুড়ি, পুঁতির মালা, রঙিন ফিতা, প্রসাধনীর সারি সারি দোকান। কারুপণ্য, কুটির শিল্প, হস্তশিল্পসহ নানা পণ্য ছাড়াও মাটির তৈরি পুতুল, কাঠের গাড়ি, বাঁশের কুলা-চালুনসহ নানাধরণের শিশু-কিশোরদের খেলনা সামগ্রীর পসরা সাজায় দোকানিরা। নানা বিনোদনে মুখরিত থাকে মেলা প্রাঙ্গণ। মেলার এ দিনটির জন্য বছরজুড়ে অপেক্ষায় থাকে গাঁয়ের বধূ, শিশু-কিশোরসহ সব বয়সের মানুষ।