ছোট্টবেলা থেকে মা নামক একটি মেশিন দেখতে দেখতে বড় হচ্ছি। শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা নাই, রোজা, পূজা কিংবা ঈদের ছুটি নাই- মা রোজ কাজ করে যাচ্ছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুনিয়া থমকে যেতে পারে, উৎসব আয়োজনে সবাই অলস হয়ে ঘুরতে পারে কিন্তু মায়ের কাজে কখনোই ছুটি হয় না। বরং সবার যখন আনন্দ তখন মায়ের কাজ আরও বেড়ে যায়। অধিকাংশ সন্তানেরা জানেই না, মা কখন ঘুমুতে যায় আর কখন ঘুম থেকে জাগে! অথচ পরিবারের একজন অবহেলিত মানুষ হিসেবেই মা রোজ রোজ বৃদ্ধ হয়! সেই অসুস্থ শরীরেও সন্তানের খাওয়া-দাওয়ার খোঁজ নিতে ভুলে না। সন্তান মশারী খাটিয়েছে কি-না, সন্তানের মন খারাপ কি-না, সন্তানের শরীর কেমন, সন্তানের আরও কিছু লাগবে কি-না- মাতৃত্বের এই পেরেশানিতে মা আরও বুড়িয়ে যান। মা সন্তানকে কখনোই ঠান্ডা ভাত, বাসি খাবার খেতে দেন না। সন্তানের শরীর খারাপে মায়ের মত উতলা মন আর কারো হয় না। অসুস্থ সন্তানের শিয়রে দিন-রাত জাগতে মা কখনোই ক্লান্তিবোধ করেন না। মা যে মানুষে তা তার কর্মকা- ছাপিয়ে তাকে মেশিন মনে হয়। মা কখনোই অবসর নেন না, মা'র কখনোই বিশ্রামের দরকার হয় না। ছোটবেলা থেকে অন্তত সেরকম একজন ব্যস্ত মাকে দেখে দেখেই বড় হয়েছি।
সন্তানের কাছে মা আসলে কি নন? শ্রেষ্ঠ শিক্ষক মা, শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকও মা। এমন একটি সন্তানকেও পাওয়া যাবে না যার কাছে তার মায়ের রান্না করা খাবারের চেয়ে অন্য কারো তৈরিকৃত খাবার বেশি মজাদার লাগে। এই পৃথিবীতে মায়ের চেয়ে বেশি যত্ন কেউ করতে পারে না। কত বড় বড় অন্যায় করেও মায়ের আদালতে সর্বদাই নির্দোষ ছিলাম- তা ভাবতেই দুঃচোখ জলে ঝাপটায়। মা জীবনে মাত্র দুইবার মেরে ছিলেন। আজও ভাবী, সেদিন যে অপরাধ করেছিলাম তার মৃদু শাস্তি মা না দিলে বাবা মেরে ভর্তা করে ফেলতেন। একটা সন্তান যতদূর যায়, যতবড় হয়- তার সবটাই মায়ের অবদান। প্রচলিত ডিগ্রি অর্জনের হিসেবে মা অশিক্ষিত হলেও, এমনকি মা মূর্খ হলেও সন্তানের গড়ন ও গঠনে মায়ের মত ভূমিকায় আর দ্বিতীয়টি কেউ নাই। তাই ধর্ম মা'কে গুরুত্ব দিতে ভুল করেনি! মাকে তিনবার স্বর্ণপদক দেওয়ার পরে বাবাকে একটা ব্রোঞ্জ পদক দিয়ে সন্তুষ্ট করেছে। পুরুষের জীবনে অনেক নারীর প্রভাব তবে মায়ের জায়গা এক নম্বর থেকে কখনোই দুই নম্বরে নামবে না। মানুষ অথচ মায়ের কাঝে ঋণী নয়, জীব অথচ মায়ের গুরুত্ব অস্বীকার করবে- এমনটা অসম্ভব।
শৈশব-কৈশোরের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে মায়ের সাথে ঘটে যাওয়া অগণিত স্মৃতি। তার সন্তানকে কেউ একটু বকা দিলে মায়ের মনের আকাশ মেঘে ঢেকে যেত। স্বামী- সংসার একদিকে আর সন্তান আরেক দিকে- এভাবেই বেঁচে থাকেন মা, বাড়িয়ে রাখেন মমত্ববোধের আঁচল। কত নারী শুধু সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে সংসারের কত-শত জ্বালাতন মুখ বুঝে সহ্য করে একটা গোটা জীবন মানিয়ে নেন সেই সমীক্ষা আমাদের কাছে নাই! যে মেয়েটা স্বার্থপরের মত জীবন বলতে কেবল নিজের জীবনটা এবং যত্ন বলতে কেবল নিজেকে পরিপাটি করে রাখা বুঝত সেই মেয়েটিও মা হওয়ার পরে নিজের জীবনকে ভুলে যায়! মাসে একবার আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করানোর অবসর পায় না। রুক্ষ শুষ্ক চুলগুলোতে শ্যাম্পু-সাবানের স্পর্শ দেওয়ার মত আয়েশ তাঁর আর হয় না। সন্তান, সন্তান এবং সন্তান- এই জঁপণ্ডজিকিরে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায়! বাপণ্ডভাই থেকে দূরে যায়! স্বামীও আর তার যতেœর ভাগ ঠিকঠাক পায় না। এভাবেই উচ্ছল একটি মেয়ে পুরোদস্তুর মা হয়ে ওঠে। গরীয়সী মহীয়সী জয়তু জনন মা। নিজেকে ব্যস্ত করতে করতে একসময় মা নামক মানুষটি একসময় মেশিনে পরিনত হয়। মা তখন সুপার লেডি। অবসর বলতে সন্তানের মঙ্গল ভাবনায় তার মস্তিষ্কের সেলগুলো স্বয়ংক্রিয় হয়ে ওঠে।
আমাদের মায়েদের কখনোই অসুখ করে না। অন্তত অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখিনি! কখনোই মায়ের মুখ মলিন হয় না। কখনোই সে ভালো নাই বলে না। পৃথিবীতে মা একমাত্র ব্যক্তি যিনি সবচেয়ে কম পেয়ে, কম নিয়ে এবং কম ভোগ করে সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্ট হতে পারেন। তার হাসিমাখা মুখের আড়ালে ভেতরের দুঃখ-কষ্টের সব অসুখ লুকিয়ে রাখেন। শুধু মা ডাক শোনার জন্য শখ-আহ্লাদ ছুড়ে ফেলেন, ভোগ-বিলাসিতা ভুলে থাকেন। মায়ের শখ তখন সন্তানের স্বপ্নপূরণে বদলে যায়। সন্তানের মঙ্গলের জন্য তাঁর কায়িক শ্রম এবং আত্মিক প্রার্থণা বেড়ে যায়। সন্তানের কল্যাণের জন্য মা করতে পারেন না এমন কোন কাজ নাই। সন্তান জান্মদানের তীব্র ব্যথা নিমিষেই বরণ করতে পারেন, সন্তানের স্বপ্ন পূরণে নিজের জীবনকে বাজি ধরতে পারেন। আত্মীয়-স্বজনের ফোঁড়ন উপেক্ষা করে এবং পরিবার-পরিজনের রক্তচক্ষু সহ্য করেও সন্তানের সুখের জন্য নিজেকে একবাক্যে উৎসর্গ করতে পারেন। সন্তানের ক্ষতি হবে ভেবে, সন্তানকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলে মা তার কত প্রিয়জনকে ভুলে আছেন-সে হিসাব খুব কম সন্তানের কাছেই থাকে। মায়ের শোকে সন্তানের সুখ লাগামহীন হয় না- এমন সুসন্তান ঘরে ঘরে হলে তবেই জাগতিক কল্যাণ নিশ্চিত হতো।
কারো মা চিরদিন থাকে না, বাঁচে না। সন্তান মায়ের জন্য যখন কিছু করার সক্ষমতা অর্জন করে মা তখন বার্ধক্যে! মা কষ্ট পায়, মায়ের মনে ব্যথা লাগে এমন কিছু যাতে আমরা না করি! ভুল করেও ামাকে কষ্ট না দেই। কুসন্তান পাওয়া যায় কিন্তু একজন মা-ও কু-মা হয় না। মা একটি পবিত্র সত্তার নাম, একটি স্বার্থহীন সম্পর্কের বন্ধন। সেই মায়ের জন্য, সেই মায়ের সুখের জন্য এবং সেই মাকে ভালো রাখার জন্য একটা জীবন বিনিয়োগ করতে সন্তানের দ্বিতীয়বার ভাববার অবকাশ রাখা ঠিক নয়। মাকে ভালো রাখার পথে কারো সাথে যদি শত্রুতা পোষণ করতে হয়, কারো অধিকার যদি সীমিত করতে হয় তবে সে সিদ্ধান্ত নিতেও কার্পণ্য করা উচিত হবে না। মায়েরা সাধারণত অসন্তুষ্ট হন না তবে অনেক কষ্ট পেয়ে যদি সন্তানের প্রতি তার মন খারাপ হয় তবে সে সন্তানের দুনিয়া এবং পরকাল বরবাদ হয়ে যাবে। মায়ের ভালো থাকা- আমাদের প্রার্থণার প্রথম বাক্য হোক। আমাদের কথা ও কাজে, সাহস ও বিশ্বাসে মা জেনে যাক সন্তান হিসেবে তাকে কতোটা ভালোবাসি। তাঁর সুখের জন্য কত কী করতে পারি। অসুস্থ-বৃদ্ধ মায়ের হাত ধরে একবার যেনো শোনাতে পারি মাগো, তোমায় অনেক ভকলোবাসি, আমার জীবনের চেয়েও অনেক বেশি।
মূল লেখা একের ঘরেই শেষ! যেহেতু মা দিবসের প্রাক্কালে এই লেখা সেহেতু মা দিবসের ইতিহাসের জ্ঞাত অংশটুকু সংযোজন করে নিচ্ছি তা তিনের ঘরে উপসংহার সংযোজিত করেছি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের আরও ৪৬টি দেশে মে মাসের দ্বিতীয় রোববার কে 'বিশ্ব মা দিবস' হিসেবে পালন করা হয়। এটি মাকে ঘিরে এমন একটি সম্মান প্রদর্শনের দিন, যে দিবসে মায়ের সম্মান, মাতৃত্বের ঋণপত্র এবং সমাজে মায়েদের প্রভাব প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ধারণা করা হয়, এ দিনটির সূত্রপাত প্রাচীন গ্রীসের মাতৃ-আরাধনার প্রথা থেকে। যেখানে গ্রিক দেবতাদের মধ্যে এক বিশিষ্ট দেবী ‘সিবেল’-এর উদ্দেশ্যে পালন করা হত একটি উৎসব। তবে আমাদের দেশসহ অন্যান্য দেশে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারে যে ‘আন্তর্জাতিক মা দিবস’ পালন করা হয় তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা ১৯১২ সালে। ১৯১২ সালে ‘আনা জার্ভিস’ স্থাপন করেন ‘মাদার’স ডে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসেশিয়েশন’ ( আন্তর্জাতিক মা দিবস সমিতি)। আমাদের দেশে বিশ্ব মা দিবসে সরকারি ছুটি পালন না করা হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছে এবং যথাযোগ্য মর্যাদায় মা দিবসের অনুষ্ঠান সূচি পালিত হয়। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের ছুটির দিনটিকেই অন্যান্য দেশ এবং সংস্কৃতি একরূপে গ্রহণ করে সেহেতু যুক্তরাজ্যতে মাদারিং সানডে বা গ্রিসের মন্দিরে যিশুর প্রাচীনপন্থী পুজার্চনার মত মাতৃত্বের সম্মানে বিদ্যমান অনুষ্ঠানগুলির সাথে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য তারিখটিকে পাল্টে দেওয়া হয়। তবে উল্লেখ্য যে, যে সকল দেশ আন্তর্জাতিক মা দিবস পালন করে না তারা ৮ই মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবসে’ মা দিবসের অনুরূপ কতগুলি কার্য সম্পাদন করে।
মা,
এক হরফে দিলেম লিখে একটি ইতিহাস
সৃষ্টি মাঝে তুমি মা’-যে শ্রেষ্ঠ সে প্রকাশ
তোমার ত্যাগে প্রাণ পেল মা- এই ধরণীর সব
ভুবন মাঝে তুমি মাগো আমার সেরা রব
আমার রক্তকণার অনুকণায় একজন মানুষের অস্তিত্ব সর্বদা বিরাজিত। যে মানুষটির ত্যাগে আমার অস্থি-মজ্জার প্রতিটি পরত গঠিত হয়েছে, তিনি আমার গর্ভধারিণী, জন্মদাত্রী প্রিয় মা। আমার সবকিছুর যোগফলে আমি তাই, যা আমার মা আমাকে বানিয়েছেন। যার ত্যাগে আমি প্রাণ পেয়েছি, যার ধৈর্যে আমি বেড়ে উঠেছি, তিনি-ই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কিংবদন্তি, সময়ের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, নিঃস্বার্থ শুভাকাঙ্খী, মমতা-করুণার আধার, সেরাদের সেরা মহীয়সী, জগৎ জননী- আমার মা। একজীবনে তার কাছে যতখানি ঋণী হয়েছি, হাজারবার জনম পেলেও তার ছিঁটেফোঁটা শোধ করার সাধ্য আমার হবে না; কারোর-ই নেই।
নতুন করে বলার মতো মায়ের গল্প নেই
জন্ম দিয়েই ত্যাগ করেননি, মা’তো আমার সেই
ভুল করেও যে মায়ের কাছে নিরাপরাধ ছিলাম
সেই মা’কে ভুলে যাওয়ার মত নির্বোধ কেমনে হলাম
স্বার্থের পৃথিবীতে মায়েদেরকে খুব বেশি বোকা মনে হয়!- তাই না? তাদের ভালো যেন তারা বুঝতেই পারেন না! সন্তানের জন্য নিমিষেই ত্যাগ করেন ভোগের সব পথ। সন্তানকে বাঁচাতে কিংবা রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন এমন মায়ের দৃষ্টান্ত ধূলোর ধরাতে অযুত-নিযুত ঘুরে-ফিরে মায়ের শ্রেষ্ঠত্বের জানান দিচ্ছে। পৃথিবীতে একমাত্র স্বার্থহীন মানুষ- মা, যিনি তাঁর সন্তানকে স্বার্থহীনভাবে ভালোবাসেন। আবার এই মা-ই সবচেয়ে বড় স্বার্থপর কেননা সন্তানের স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি তার সকল আপন-স্বজন এমনকি গোটা পৃথিবীর সাথে স্বার্থনিজ কলহে জড়িয়ে যেতে দ্বিতীয়বার ভাবেন না। সন্তানের স্বার্থ রক্ষার উর্ধ্বে তার কাছে কোন নৈতিকতা নাই, নাই দায়িত্বের বাধ্যবাধকতা। একজন মায়ের কাছে একদিকে তার সন্তান, অন্যদিকে গোটা পৃথিবীর সব। মায়ের চোখ থেকে তুলনা করলে সন্তানের দিকের পাল্লাটাই প্রত্যেকবার ভারী হবে।
মুত্যু পথে যে মা দিলেন নতুন জীবন উপহার
ব্যথা সয়েও তিনি হলেন জীবন গড়ার কারিগর
প্রভূ আমার ভালো রেখো আমার মাকে সবখানে
জান্নাত নিজে লিখে দিও সব মায়েদের নসীবে
(কলাম লেখক: রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক)