সংক্রমক রোগ যক্ষ্মায় মৃত্যু কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কৌশলপত্র অনুযায়ী, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০২৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মায় মৃত্যু ৭৫ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ২০১৫ সালে যক্ষ্মায় মৃত্যু ছিল ৭৩ হাজার। ২০২৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা সংক্রমণ ৫০ শতাংশ (২০১৫ সালের তুলনায়) কমাতে হবে। তবে এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি, চিকিৎসায় অসচেতনতা ও অর্ধেক পথে ওষুধ সেবন ছেড়ে দেয়ায় বাড়ছে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা। চিকিৎসকরা বলছেন, যক্ষ্মার জীবাণু শুধু ফুসফুস নয়, মস্তিষ্ক, ত্বক, অন্ত্র, লিভার, কিডনি, হাড়সহ দেহের যে কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। চিকিৎসকদের মতে, যত বেশি মাত্রায় রোগী শনাক্ত করা যাবে, এ রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ তত সহজ হবে। তবে এ ক্ষেত্রেও এখনো অনেক পিছিয়ে দেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ। তবে বাংলাদেশে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী দেশে শনাক্ত হয়েছে ৩ লাখ এক হাজার ৫৬৪ জন। ডব্লিউএইচও’র তথ্য ও দেশের টিবি শনাক্তের তথ্য অনুযায়ী, ৮০ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয় এবং শনাক্তের বাইরে আছে আরও প্রায় ২০ শতাংশ যক্ষ্মা রোগী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ। তবে বাংলাদেশে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী দেশে শনাক্ত হয়েছে ৩ লাখ এক হাজার ৫৬৪ জন। ডব্লিউএইচও’র তথ্য ও দেশের টিবি শনাক্তের তথ্য অনুযায়ী, ৮০ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয় এবং শনাক্তের বাইরে আছে আরও প্রায় ২০ শতাংশ যক্ষ্মা রোগী। এর আগে ২০২২ সালে বাংলাদেশে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন ৩ লাখ ৭৯ হাজার মানুষ। তবে শনাক্ত ছিল ২ লাখ ৬২ হাজার ৭৩১ জন। ডব্লিউএইচও’র তথ্য এবং যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী দেশে, ৬৯ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয় এবং শনাক্তের বাইরে ছিল আরও প্রায় ৩১ শতাংশ যক্ষ্মা রোগী। ওই বছর শনাক্ত হওয়াদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৫৪ শতাংশ ও নারীর সংখ্যা ৪২ শতাংশ। বাকি ৪ শতাংশ শিশু। ২০২১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিভিন্ন মানদণ্ড বিবেচনা করে বাংলাদেশে যক্ষ্মা আক্রান্তের সংখ্যা ৩ লাখ ৭৫ হাজার বলে ধারণা দেয়। তাদের মধ্যে ৩ লাখ ৭ হাজার ৫৬১ জন শনাক্ত হন। ডব্লিউএইচও’র তথ্য এবং যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী সে বছর দেশে, ৮২ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয় এবং শনাক্তের বাইরে ছিল আরও প্রায় ১৮ শতাংশ যক্ষ্মা রোগী। এদিকে রোগী শনাক্ত করার বিষয়ে অগ্রগতি হলেও ‘ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগীশনাক্তে এখনো অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দেশে প্রতিবছর ৪ হাজার ৯০০’র মতো রোগী যক্ষ্মার ‘ওষুধ প্রতিরোধী’ হয়ে ওঠেন। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে দেশে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা গেছে ২ হাজার ৭২৯ জন। যাতে দেখা যায়, মোট রোগীর প্রায় ৫৫ শতাংশ এখনো শনাক্তের বাইরে রয়ে গেছে। ঢাকার জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সিনিয়র পালমোনোলজিস্ট ডা. কাজী সাইফুদ্দীন বেননূর বলেন, যক্ষ্মা ধরা পড়লে চিকিৎসায় যেসব ওষুধ দেওয়া হয় তার মধ্যে রিফামপিসিন এবং আইসোনিয়াজিড কিছুকিছু রোগীর ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে গেছে। মানুষের অসচেতনতায় ‘ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা’ হয়। এটি মানবসৃষ্ট। তাই সচেতনতায় এ সমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর,বির সিনিয়র সায়েন্টিস্ট সায়েরা বানু বলেন, যক্ষ্মারোগী এখন পর্যন্ত একটি ধারায় আছে। যেখানে একটা সময়ে শনাক্তের হার অনেক কম ছিল, তা এখন প্রায় ৮০ শতাংশ। তবে দেশে এখনো যক্ষ্মা রোগী অনেক বেশি। যক্ষ্মা প্রতিরোধ করতে আমাদের ধীরে ধীরে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু সেটা এখনো পারা যাচ্ছে না। দেশে সক্ষমতা না থাকায় ও প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকায় এটি এখনো খুব বেশি সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান সায়রা বানু। তিনি বলেন, এ জায়গায় পিছিয়ে থাকাটা ভালো বিষয় নয়। এ রোগীদের মাধ্যমে অন্য সাধারণ মানুষও আক্রান্ত হচ্ছে। যক্ষ্মা প্রতিরোধ করতে হলে আমাদের এদেরও শনাক্তের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তবে সক্ষমতা আগের তুলনায় ধীরে ধীরে বাড়ছে। বর্তমানে আমাদের কাছে জিন এক্সপার্ট মেশিন এসেছে। যার মাধ্যমে দুই ঘণ্টার মধ্যে এ ধরনের রোগীকে শনাক্ত করতে পারি। বর্তমানে ৬০০-এর মতো জিন এক্সপার্ট মেশিন আছে। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্যে জানা যায়, দেশের প্রতিটি উপজেলা হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বক্ষব্যাধি ক্লিনিক এবং নির্দিষ্ট এনজিও ক্লিনিকসহ সারাদেশে ৮৭১টি কেন্দ্রের মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে যক্ষ্মা রোগের পরীক্ষা ও চিকিৎসা পাওয়া যায়। ২০২২ সালে দেশে প্রথম এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর এক্স-রে মেশিনের মাধ্যমে যক্ষ্মা চিকিৎসা শুরু করেছে আইসিডিডিআর,বি। বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে এআই এক্স-রে মেশিন প্রথম দিকে চালু হয়, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। গত এক বছর দুই মাসে প্রায় ৬৬ হাজার ৬৭৪ জনকে এর মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়। যেখানে ২৫০০ জনের মতো যক্ষ্মারোগী শনাক্ত হয়। সাধারণত যক্ষ্মা ধরা পড়লে ছয় মাস পূর্ণ মেয়াদে ওষুধ খেতে হয়। এ সময় ধারাবাহিকভাবে ওষুধ খাওয়ার কথা থাকলেও অনেকে দুই থেকে তিন মাস পর বন্ধ করে দেন। এতে তাদের শরীরে যক্ষ্মার জীবাণুর ওষুধ প্রতিরোধ সক্ষমতা বাড়ে। এ ছাড়া একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার জীবাণু সংক্রমিত হয়ে সাধারণ একজনকেও আক্রান্ত করতে পারে। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে যুক্ত ব্যক্তিদের মতে, দেশে যক্ষ্মা মোকাবিলায় রোগীদের দ্রুত শনাক্ত করা প্রয়োজন। আর তার সঙ্গে চিহ্নিত রোগীদের কমিউনিটি পর্যায় থেকে ফলোআপ ও সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।