ঘূর্ণিঝড় রেমাল এর চোখ রাঙানীতে আতঙ্কিত উপকূলের মানুষ। ইয়াস, আম্পান, অশনির ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠার আগেই ফের রেমান এর অশান্তি শুরু হয়েছে। প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে দুর্বল বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলবাসীর ভরসারস্থল বেড়িবাঁধ। সেই বেড়িবাঁধ দূর্বল থাকায় উপকূলবাসীর মনে শঙ্কা বাড়ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঘোষণা অনুযায়ী ২৬ মে নাগাদ উপকূলে আঘাত হানতে পারে সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় রেমাল। এই মে মাসে সুন্দরবন উপকূলে আছড়ে পড়েছিল আইলা, ফণী, বুলবুল, ইয়াস ও আম্পানের মতো প্রলয়ংকরী সব ঘূর্ণিঝড়। তাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন উপকূলীয় নদী ভাঙন এলাকায় বসবাসরত সাধারণ মানুষ।
উপকূলের ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ছে। সামনে বর্ষাকাল ও ঘূর্ণিঝড় মৌসুম। এ কারণে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে উৎকণ্ঠায় পড়েছেন খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট উপকূলের হাজার হাজার মানুষ। তিন জেলার ২ হাজার ৬ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৫১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। ঘূর্ণিঝড় যদি খুলনা উপকূলে আঘাত নাও হানে, তবুও এর প্রভাবে নদনদীতে পানির চাপ বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। আর পানি বাড়লে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার ভয় আছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) খুলনার ডিভিশন-১ এর আওতাধীন ৩৬৫ দশমিক ২৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ১০ দশমিক ৫ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। পাউবো খুলনার ডিভিশন-২ এর অধীনে কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ৬৩০ কিলোমিটার। এরমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ১২কিলোমিটার। পাউবো সাতক্ষীরার ডিভিশন-১ এর অধীনে ৩৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৫কিলোমিটার জরাজীর্ণ। সাতক্ষীরা ডিভিশন-২ এর ২৯৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৮ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। পাউবোর বাগেরহাট জেলার ৩৩৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ১৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা ৩ জেলায় মোট ১ হাজার ৯১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। তার মধ্যে বর্তমানে ২৪০ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। খুলনা জেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৫টি পোল্ডার আছে। ৫১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে, এর মধ্যে ৯০ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। পাইকগাছা উপজেলায় ২৫০কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে এর মধ্যে ৩৮ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ।
জানা গেছে, ষাটের দশকে মাটি দিয়ে তৈরি ওই ভেড়িবাঁধ ছিল ১৪ ফুট উঁচু ও ১৪ ফুট চওড়া। কিন্তু এখন ২৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের উচ্চতা ও চওড়ার অর্ধেকও অবশিষ্ট নেই। অর্থাভাবে দীর্ঘদিনেও প্রয়োজন অনুযায়ী সংস্কার করতে না পারায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ষাটের দশকে তৈরি ওই ভেড়িবাঁধের বেশিরভাগই দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা হারিয়েছে। ফলে বাঁধগুলো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস এবং নিম্নচাপ, লঘুচাপ, আমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে লোকালয়ে পানি ঢোকা ঠেকাতে পারছে না। দুর্বল এসব ভেড়িবাঁধের কারণে বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। তাছাড়া নিম্নচাপ এবং অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারেও বাঁধ উপচিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। ফলে উপকূলীয় এলাকার কয়েক লাখ মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সূত্র আরো জানা গেছে, দেশের উপকূলীয় তিন জেলার বেড়িবাঁধের উচ্চতা ও প্রশস্ততা কম এবং সেগুলোর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তাছাড়া ওই বাঁধ দীর্ঘদিনেও ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। লবণাক্ত মাটি দিয়ে উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলো তৈরি। উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ নদণ্ডনদীর পানিও লবণাক্ত। লবণাক্ত পানি বেড়িবাঁধের মাটির বান্ডিং দুর্বল করে ফেলে। ফলে অতিরিক্ত জোয়ারের পানির চাপে বাঁধের মাটি ধসে যায়। তাছাড়া ভেড়িবাঁধ ছিদ্র করে চিংড়ি ঘেরে লবণ পানি তোলার কারণেও বেড়িবাঁধ দুর্বল হয়ে গেছে। যে কারণে যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে দুর্বল বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। বাস্তহারা হয়েছে লক্ষাধিক মানুষ। ফলে সম্প্রতি সব চেয়ে বড় দুর্যোগ বলে মনে করা হয় নদী ভাঙন। এ নদী ভাঙন যেন উপকূলের মানুষের পিছু ছাড়ছে না। এক একটি ঘূর্ণিঝড়ের পরে উপকূলের মানুষের যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয় সেগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেনা। তারপর আবারও নতুন ঘূর্ণিঝড় নিয়ে উপকূলবাসী শঙ্কিত হয়ে পড়ে। উপকূলের মানুষের এ ধারনের দুর্যোগ থেকে পরিত্রান পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো টেকসই বেড়িবাঁধ নিমাণ করা।
তবে অর্থ ছাড়ের সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দাবি, বাজেট নেই। তারপরও বেড়িবাঁধে জরুরি সংস্কার করা হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টে কাজ করলেও শুভংকরের ফাঁকি দেয় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। দুর্যোগ মৌসুমে বেড়িবাঁধ মেরামতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তোড়জোড় বাড়লেও নাম মাত্র সংস্কারে কোনো কাজ হচ্ছে না বলে অভিযোগ জনপ্রতিনিধিদের। সঠিক তদারকির অভাবে পাউবো’র কোন কাজই ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের বেশি হয় না। ফলে বার বার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা দাবি করেন, বেড়িবাঁধে দুর্নীতি ও নকশা ক্রটির কারণেই স্থায়ী বেড়িবাঁধ অস্থায়ী বেড়িবাঁধের মতো ভেঙে যাচ্ছে। ভাঙনের পর বেড়িবাঁধ সংস্কার করা হয়, তবে বছর না ঘুরতেই আবারও ভাঙন দেখা দেয় এসব বেড়িবাঁধে। তাই স্বল্প পরিসরে নয়, স্থায়ী টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি পুরো উপকূলীয় এলাকার মানুষের।
ঘূর্ণিঝড় নিয়ে ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটে উপকূলীয় এলাকার মানুষের। তবে ঘূর্ণিঝড় নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে নিজেদের সুরক্ষায় রাখতে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে উপকূলবাসীদের। (লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট)