কুরবানীর ইতিহাস ও আমাদের শিক্ষা

মোঃ হায়দার আলী : | প্রকাশ: ১৫ জুন, ২০২৪, ০৪:৪৪ এএম

কি নিয়ে লিখবে ভাবছিলাম সকালে বাজার করতে গিয়ে দেখলাম নদীর মাছ ১৩/১৪  শ টাকা কেজি, ১০০/৮০ টাকার  কাঁচা মরিচ ৩শ,  ২ শ টাকার আদা ৩ শ টাকা কেজি ৩০ টাকার শষা  একলাফে ৭০/৮০ টাকা কেজি ৩৫ টাকার আলু ৫৫/৬০ কুরবানীর ঈদের জন্য আরেক দফা লাগামহীমভাবে মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে দেখার যেন কেউ নেই। ভাবলাম নিত্যপ্রয়োজনীর দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির ব্যপারে কিছু লিখবো কিন্তু জুম্মার নামাজ আদায় করতে গিয়ে হুজুরের বয়ান শুনে থিম পরিবর্তন করে  তথ্য উপাত্ত নিয়ে ল্যাপটপ সামনে আল্লাহর নাম নিয়ে বসলাম কোরবানির উপর লিখার জন্য জানি পাঠদের কতটা উপকারে আসবে।

কোরবানির প্রকৃত অর্থ কি বিশেষ করে একটি আদর্শ, বিশ্বাস  ত্যাগ, পরিত্যাগ। কোরবানি মুসলিমদের জন্য মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি মহৎ ইবাদত। ইসলামে কোরবানির অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ালার সন্তষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের জন্য শরীয়ত নির্দেশিত পন্থায় শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত কোন প্রিয় বস্তু আল্লাহ তায়ালার দরবারে পেশ করা এবং শরীয়ত নির্দেশিত পন্থায় তা ব্যবহার করা।

কোরবানির ইতিহাস: কোরবানি হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর যুগ থেকেই বিদ্যমান রয়েছে। (সুরা মায়েদা আয়াত নং ২৭-৩১) এখানে আদম (আঃ) এর দুই সন্তানের ঝগড়া নিরসনের জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্দেশিত কোরবানির বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। পরবর্তি সকল নবীদের শরীয়তেই কোরবানির বিধান ছিল। তবে প্রত্যেক নবীদের সময়ে কোরবানির পন্থা ভিন্ন ছিল। (সুরা হজ্জ আয়াত ২২/৩৪) সর্বশেষে কেয়ামত পর্যন্ত সকল জাতি ও ভুখণ্ডের জন্য একই বিধান চলমান রয়েছে। যা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর মাধ্যমে প্রাপ্ত শরীয়ত অর্থাৎ কুরআন সুন্নাহর বিধান। আর এই সময়ে আমাদের উপর যে কোরবানির পদ্ধতি চলমান তা হযরত ইবরাহিম আঃ এর শরীয়ত থেকে এসেছে। যেমনটি বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলআইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস থেকে জানতে পারি যে, সাহাবারা প্রশ্ন করেছিলেন কোরবানি কি? ইয়া রাসুলুল্লাহ? তখন আল্লাহর রাসুল সাঃ উত্তর দিলেন ইহা তোমাদের পিতা ইব্রারাহিম (আঃ) এর সুন্নাত ।(মিশকাত, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ) আমরা যে কোরবানি করি তা যে মহান রব আমাদেরকে দান করেছেন তাঁর খলিল হযরত ইবরাহিম আঃ এবং  পুত্র ইসমাইল আঃ এর মাঝে সংঘটিত কোরবানির পরিক্ষা থেকে তা সুরা আস ছফ্ফাতে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে ( আয়াত নং ১০৫-১০৮)

কোরবানির তাৎপর্য্য বা গুরত্ব: কোরবানি হলো ইসলামের একটি শিয়ার এবং গুরত্বপূর্ণ ওয়াজিব আমল। কোরবানির দিনগুলিতে ( জিলহজ্জ মাসের ১০.১১.১২ তারিখ) যে ব্যক্তির নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত যাকাতের নেসাব পরিমান সম্পদ থাকবে তার জন্য একটি পশু কোরবানি করা ওয়াজিব। ওয়াজিব কোরবানি পরিত্যাগ কারীর উপর বিশ্বনবী (সাঃ) কঠিন সতর্কবার্তা পেশ করেছেন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং পশু কোরবানি কর। ( সুরা কাউসার আয়াত ২) পবিত্র হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হে লোক সকল প্রত্যেক (সামর্থ্যবান) পরিবারের উপর কোরবানি দেয়া অপরিহার্য্য। (সুনান ইবনে মাজাহ হাদিস নং ৩১২৫) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,যে ব্যাক্তি সামর্থ্য থাকা সত্তেবও কোরবানি করেনা সে যেন আমাদের ইদগাহে না আসে। ( মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ হাদিস নং ৩১২৩)

কোরবানির ফযিলত: কোরবানি দাতা পশু কোরবানির মাধ্যমে হযরত ইবরাহিম (আঃ) ও শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি গুরত্ববহ ঐতিহাসিক সুন্নাত পালন করতে পারে।

যেমনটি মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আর আমি মহা কোরবানির মাধ্যমে তাকে মুক্ত করেছি। ( সুরা আস-সাফফাত : আয়াত ১০৭) এছাড়াও বান্দা কোরবানির পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ করে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আল্লাহর নিকট এসব পশুর রক্ত ও গোশত পৌছায় না, তাঁর নিকট পৌছে তোমাদের তাকওয়া। (সুরা হাজ্জ আয়াত : ৩৭) আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেন কোরবানির প্রবাহিত রক্ত আল্লাহ তায়ালার নিকট দুইটি কুচকুঁচে কালো ছাগলের চেয়ে প্রিয় ও পবিত্র। (বায়হাকী) অন্য হাদিসে তিনি বলেন, কোরবানির দিন পশু যবেহ (অর্থাৎ কোরবানি) ব্যতিত অন্য কোন আমল আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় নয়। (সুনানে তিরমিযি) তিনি আরও বলেন, যে ব্যক্তি প্রফুল্ল চিত্তে কোরবানি করবে কেয়ামতের দিন জাহান্নাম ও ঐ ব্যক্তির মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়াবে। (আস সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, তাবরানি) কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি পাওয়া যায়। ( মেশকাত) এছাড়াও বহু ফযিলত কুরআন হাদিস দ্বারা প্রমানিত।

আদি পিতা আদম (আ.) এর যুগ থেকেই কোরবানির বিধান চালু হয়েছিল। আদম (আ.) এর দুই ছেলে হাবীল ও কাবীল দু’জনেই কোরবানি দিয়েছিলেন। তাদের একজনের কোরবানি আল্লাহর কাছে কবুল হয়েছে এবং অন্যজনের কোরবানি কবুল হয়নি। পৃথিবীতে কোরবানির ইতিহাস এখান থেকেই শুরু।

তবে আজকের মুসলিম সমাজে যে কোরবানির প্রচলন রয়েছে তা মূলত জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর দেখানো পথ থেকেই। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর শতবর্ষ বয়সের পর আল্লাহ তায়ালা তাঁকে যে সন্তান দান করেছিলেন, সেই কলিজার টুকরা হযরত ইসমাইল (আ.)কে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে কোরবানির সূত্র ধরে আজও সেই কোরবানি প্রচলিত আছে।

পবিত্র কোরআনে কোরবানি সম্পর্কে আল্লাহ যা যা বলেছেন: তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ ও ওমরাহ পূর্ণ করো। কিন্তু যদি তোমরা বাধা পাও তবে সহজলভ্য কোরবানি করো। আর কোরবানি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত  মুণ্ডন করো না। কিন্তু অসুস্থতা বা মাথায় কোনো রোগের কারণে আগেই মস্তক মুণ্ডন করে ফেললে ‘ফিদিয়া’ বা প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে রোজা রাখবে, কোরবানি বা সদকা দেবে। নিরাপদ পরিস্থিতিতে কেউ হজের আগে ওমরাহ করে উপকৃত হতে চাইলে সে সহজলভ্য কোরবানি করবে। কিন্তু যদি কেউ কোরবানির কোনো পশু না পায়, তবে সে হজের সময় তিন দিন ও ঘরে ফিরে সাত দিন, এভাবে মোট ১০ দিন রোজা রাখবে।

মসজিদুল হারামের কাছে পরিবার-পরিজনসহ বাস করে না এমন লোকদের জন্য এ নিয়ম প্রযোজ্য। অতএব হে মানুষ! আল্লাহ-সচেতন হও। আল্লাহর ধর্মবিধান লঙ্ঘন হতে দূরে থাকো। জেনে রাখো, আল্লাহ মন্দ কাজের শাস্তিদানে কঠোর। (সূরা বাকারা, আয়াত ১৯৬)

হে নবী! কিতাবিগণকে আদমের দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের ঘটনা ভালো করে বর্ণনা করো। তারা যখন কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো। কিন্তু অন্যজনের কোরবানি কবুল হলো না। ক্ষিপ্ত হয়ে সে বলল, আমি তোমাকে খুন করবো। অপরজন বলল, প্রভু তো শুধু আল্লাহ-সচেতনদের কোরবানিই কবুল করেন। (সূরা মায়েদা, আয়াত-২৭)

হে নবী! ওদের বলুন, আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ-আমার সবকিছুই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। তিনি একক ও অদ্বিতীয়। এ আদেশই আমি পেয়েছি। আমি সমর্পিতদের মধ্যে প্রথম।’ (সূরা আনআম, আয়াত ১৬২-১৬৩)

আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যে কোরবানিকে ইবাদতের অংশ করেছি। যাতে জীবনোপকরণ হিসেবে যে গবাদি পশু তাদেরকে দেয়া হয়েছে, তা জবাই করার সময় তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে আর সব সময় যেন মনে রাখে একমাত্র আল্লাহই তাদের উপাস্য। অতএব তাঁর কাছেই পুরোপুরি সমর্পিত হও। আর সুসংবাদ দাও সমর্পিত বিনয়াবনতদের, আল্লাহর নাম নেয়া হলেই যাদের অন্তর কেঁপে ওঠে, যারা বিপদে ধৈর্যধারণ করে, নামাজ কায়েম করে আর আমার প্রদত্ত জীবনোপকরণ থেকে দান করে।  (সূরা হজ, আয়াত ৩৪-৩৫)

কোরবানির পশুকে আল্লাহ তাঁর মহিমার প্রতীক করেছেন। তোমাদের জন্যে এতে রয়েছে বিপুল কল্যাণ। অতএব এগুলোকে সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় এদের জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। এরপর এরা যখন জমিনে লুটিয়ে পড়ে, তখন তা থেকে মাংস সংগ্রহ করে তোমরা খাও এবং কেউ চাক না চাক সবাইকে খাওয়াও। এভাবেই আমি গবাদি পশুগুলোকে তোমাদের প্রয়োজনের অধীন করে দিয়েছি, যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় করো। (সূরা হজ, আয়াত ৩৬)

কিন্তু মনে রেখো কোরবানির মাংস বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, আল্লাহর কাছে পৌঁছায় শুধু তোমাদের নিষ্ঠাপূর্ণ আল্লাহ-সচেতনতা। এই লক্ষ্যেই কোরবানির পশুগুলোকে তোমাদের অধীন করে দেয়া হয়েছে। অতএব আল্লাহ তোমাদের সৎপথ প্রদর্শনের মাধ্যমে যে কল্যাণ দিয়েছেন, সেজন্যে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো। হে নবী! আপনি সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ দিন যে, আল্লাহ বিশ্বাসীদের রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞকে পছন্দ করেন না। (সূরা হজ, আয়াত ৩৭-৩৮)

ছেলে যখন পিতার কাজকর্মে অংশগ্রহণ করার মতো বড় হলো, তখন ইব্রাহিম একদিন তাকে বলল, ‘হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে কোরবানি দিতে হবে। এখন বলো, এ ব্যাপারে তোমার মত কী? ইসমাইল জবাবে বলল, হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। ইনশাল্লাহ! আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে বিপদে ধৈর্যশীলদের একজন হিসেবেই পাবেন।’ (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২)

মনে রেখো, এ ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে সুযোগ দিলাম এক মহান কোরবানির। পুরো বিষয়টি স্মরণীয় করে রাখলাম প্রজন্মের পর প্রজন্মে। ইব্রাহিমের প্রতি সালাম। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করি। (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০৬-১১০)

অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের জন্যেই নামাজ পড় ও কোরবানি দাও। নিশ্চয়ই তোমার প্রতি যেই বিদ্বেষ পোষণ করবে, বিলুপ্ত হবে ওর বংশধারা। (সূরা কাওসার, আয়াত ১০৮)
হযরত ইবরাহীম (আ.) এর প্রতি নিজ সন্তানকে কুরবানীর এ নির্দেশ ও উদ্দেশ্য ছিল পিতা-পুত্রের আনুগত্য ও আল্লাহর ভয়ের পরীক্ষামাত্র। সে পরীক্ষায় পিতা-পুত্র যেমন উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তেমনি তাদের তাকওয়ার পরিচয়ও ফুটে উঠেছিল। সুতরাং কুরবানী নিছক একটি উৎসব নয়, কুরবানী হচ্ছে আল্লাহর প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ আত্মসমর্পণের এক অনুপম দীক্ষা এবং তাকওয়া অর্জনের এক দীপ্ত অঙ্গীকার।
প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলিমের কোরবানি হওয়া উচিত পবিত্র কোরআন অনুসরণ করেই।

লেখক : মোঃ হায়দার আলী প্রধান শিক্ষক, মহিশালবাড়ী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় ও সহঃ সাধারন সম্পাদক, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা, রাজশাহী জেলা শাখা, গোদাগাড়ী, রাজশাহী।

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW