গভীর ধ্যান করা ইসলামে বড় ইবাদাত

খাজা ওসমান ফারুকী (খাজা’জী) : | প্রকাশ: ৪ জুলাই, ২০২৪, ০৭:৩২ পিএম : | আপডেট: ৯ জুলাই, ২০২৪, ০৪:০০ পিএম

স্রষ্টার সৃষ্টিকে নিয়ে গভীর ধ্যান করা ইসলামে বড় ইবাদাত হিসেবে গণ্য। যেখানে কুরআন এইরকম গভীর চিন্তা করার কাজকে সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন এবং বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, যাতে প্রত্যেকে এই চিন্তাকে তার মেজাজ ও আধ্যাত্মিক অবস্থায় প্রয়োগ করতে পারেন। এর উদ্দেশ্য হলো মানুষের বিরক্তিকর অনুভূতি, খারাপ অভ্যাস, একগুঁয়ে পরিবেশ থেকে বের হয়ে এই মহাবিশ্বের বিভিন্ন চিহ্ন ও নির্দেশনাকে প্রজ্ঞার মাধ্যমে হৃদয়ে প্রবেশ করানো। ইসলামে ধ্যান এমন একটি অনুশীলন, যা মুসলিমদের মানসিক শান্তি দেয়। ইসলামি শিক্ষাজুড়ে এটির ধারণা ভালোভাবেই পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে, ধ্যানের মাধ্যমে কুরআনে বিশ্বাসীরা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে পারে এবং এর দ্বারা অভ্যন্তরীণ শান্তি খুঁজে পেতে পারে। যেমন আল্লাহ বলছেন, ‘যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে এবং (বলে), হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এ নিরর্থক সৃষ্টি করোনি। তুমি পবিত্র। তুমি আমাদের আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করো।’ (সুরা আল ইমরান :১৯০-১৯১) মানুষের মস্তিষ্ক এই বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ধাঁধাপূর্ণ। বিজ্ঞানের চোখধাঁধানো যত আবিষ্কার হয়েছে, সেগুলো মানুষের মাথার ভেতরে যে জৈব কম্পিউটার আছে তার সূক্ষ্মতা ও পারঙ্গমতা দেখে তাদের বিস্ময়কে বাড়িয়ে দিয়েছে মাত্র। হার্বাট বেনসন তার ‘টাইমলেস হিলিং’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মস্তিষ্ক এত জটিল, এত সুস্থির, এত গতিশীল, এত বহুমাত্রিক এবং এত সুসংযত যে তার কার‌্যাবলি বর্ণনা করা আমাদের সব প্রচেষ্টা শুধু সাদামাটা চেষ্টার নামান্তর হয়। প্রত্যেক উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার আমরা করেছি তা শুধু ব্যাখ্যা করে দেখাচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ক কত বড়, আর কত বড় এর সার্কিট; যা আমাদের জীবন, স্বাস্থ্য, সুস্থ চলাফেরা, স্মৃতি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা প্রদান করে! এটি দেখে মনে হয় একটা স্কুল জেলির সমন্বয়, যা প্রতিমুহূর্তের চলাফেরা, শ্বাস-প্রশ্বাস, প্রতি ঘটনা যা ঘটে, ঘটবে এবং ভাবা হয় বা যা স্বপ্নে দেখা হয় বা দেখা হবে, তার চিহ্ন রেখে চলেছে। এজন্য স্বর্গীয় আহ্বান এবং মানব জাতির জন্য প্রশ্ন ছোঁড়া হয়েছে- কীভাবে তারা তাদের নিজেদের সৃষ্টি করার অলৌকিকতা সম্পর্কে অন্ধ থাকতে পারে? ‘বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহর মহিমার অসংখ্য নিদর্শন জমিনের বুকে যেমন আছে, তোমার নিজের মধ্যেও রয়েছে। এর পরেও কি তোমরা সত্য অনুধাবন করবে না?’ (জারিয়াত :২২-২৩) মানুষ হলো এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বিস্ময়, কিন্তু সে নিজের মূল্য সম্পর্কে অমনোযোগী এবং বিশ্বাসের অভাবের কারণে স্বজাত-রহস্যে অজ্ঞাত। সে তো স্রষ্টার নিয়ামতকে অস্বীকার করেই চলে। কিন্তু তার শারীরিক গঠনের মধ্যে লুকিয়ে আছে শরীর, আত্মা ও আধ্যাত্মিক রহস্য। সে ভেতরে ও বাইরে রহস্যময় এক মহাবিশ্বের উপাদানের প্রতিনিধি। তাই তুমি নিজকে এক ক্ষুদ্র বিশ্ব বলে মনে করতে পার; যদিও তোমার অবস্থান বড় এক মহাবিশ্বের মধ্যে। যখন মানুষ নিজেকে নিয়ে গভীর চিন্তা করে, সে বিস্ময়কর ও চোখধাঁধানো রহস্যের সন্ধান পায়। তার অঙ্গের গঠন, তার অবস্থান ও তার কার‌্যাবলির ওপর নির্ভর করে তার কাজের পূর্ণতা পায় এবং তার আত্মার রহস্য এবং এর জ্ঞাত-অজ্ঞাত শক্তিসমূহ প্রকাশ পায়। কীভাবে সে তার ধারণা তৈরি করে এবং কীভাবে তা সে জমা রাখে এবং যথাসময়ে কীভাবে স্মরণ হয়-এই সব স্মৃতি ও ছবি কীভাবে মনে আসে-এই প্রতিচ্ছবিগুলো তো অসীম সংখ্যক! আর ঠিক তখনই মানুষের রহস্য কিছুটা বের হয়ে আসে। তারপর মানুষের প্রসার ও এগিয়ে চলা যেমন-একটা কোষ সব মানব জাতির বৈশিষ্ট্য ধারণ করে থাকে, তার সঙ্গে সেখানে থাকে তার বাবা-মা ও পূর্বসূরিদের তথ্য। সেগুলো কোথায় তাহলে লুকিয়ে থাকে এই ক্ষুদ্র ঘরে? আর সেই ক্ষুদ্র কোষ প্রতিক্ষণে কীভাবে সৃষ্টি করে আর একটা হুবহু মানুষ! ইসলামে ধ্যানকে গভীর স্তরে আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের একটি মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। এটি ব্যক্তিকে আল্লাহর উপস্থিতি সম্পর্কে চিন্তা করতে, তার নির্দেশনা খুঁজতে এবং তার সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। মনকে শান্ত করার পাশাপাশি মুসলিমরা তাদের সৃষ্টিকর্তাকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে অনুভব করতে পারে। কুরআনে বিশ্বাসীরা তাদের চারপাশের প্রাকৃতিক জগেক আল্লাহর মহত্ত্ব ও প্রজ্ঞা চেনার উপায় হিসেবে চিন্তা করে থাকে। এই চিন্তার অনুশীলন অন্যান্য ঐতিহ্যে পাওয়া ধ্যানের কৌশলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সারিবদ্ধ। ধ্যানের মাধ্যমে মুসলিমরা তাদের নিজস্ব অস্তিত্ব সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে পারে এবং এর পেছনে থাকা ঐশ্বরিক হাতকে চিনতে পারে। ইসলামিক ধ্যান আত্মোপলব্ধি ও আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি করে। নিয়মিত নামাজ ও জিকির ইসলামি ধ্যানের একটি রূপ। এই অনুশীলনের সময় মুসলিমদের লক্ষ্য তাদের মনকে জাগতিক বিভ্রান্তি থেকে দূর করে শুধু আল্লাহর সঙ্গে তাদের সম্পর্কের দিকে মনোনিবেশ করা। কারণ এটি দৈনন্দিন কাজকর্মের মধ্যে খোদার গুণাবলির প্রতি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে। আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা প্রায়ই মানুষকে চাপ ও উদ্বেগের দিকে নিয়ে যায়। ধ্যান এ বিষয়ে একটি প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে, যা মানুষকে অভ্যন্তরীণ শান্তি খুঁজে দিতে সক্ষম। ধ্যান ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতার মতো গুণাবলির জন্ম দেয়, যা ইসলামে অত্যন্ত মূল্যবান। নিয়মিত ধ্যান অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যক্তি কঠিন সময়েও খোদার রহমত বা করুণার উপস্থিতি অনুভব করতে পারে। ধ্যান মুসলিমদের আত্মসচেতনতা, কৃতজ্ঞতা, ক্ষমা, নম্রতা, সহানুভূতি ও সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করার মতো বিশ্বাসের দিকে নিয়ে যায়। দৈনন্দিন জীবনে ধ্যান অন্তর্ভুক্ত করলে মুসলিমদের জন্য অনেক উপকার হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি, ইবাদতের সময় উন্নত মনোযোগ, মানসিক চাপ হ্রাস, মানসিক সুস্থতা উন্নত করা এবং সামগ্রিক তৃপ্তির বৃহত্তর অনুভূতি। সুফিবাদের মতো ইসলামিক ঐতিহ্যসহ বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্ম জুড়ে ধ্যানের অনুশীলন পাওয়া যায়, তবে সুফি মেডিটেশন যোগ্য শিক্ষকদের কাছ থেকে জ্ঞান ও নির্দেশনা নিয়ে অনুশীলনগুলো করা অপরিহার্য। ইসলামিক ধ্যানের এই আধ্যাত্মিক যাত্রা শুরু করার আগে  আল্লাহ সম্পর্কে নির্ভেজাল বিশ্বাস রাখা খুবই আবশ্যক। এটি তখন সেই বিশ্বাসীর জন্য পথবর্তিকা হবে এবং যা তাকে ভুল পথ থেকে গভীর বিশ্বাসের জোরে দূরে সরিয়ে রাখবে। এই মহাজগতে বিদ্যমান ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনু থেকে শুরু করে সর্ববৃহৎ সৃষ্টি-সবকিছুই আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ব্যাপারে কি তোমরা সন্দেহের মধ্যে রয়েছ? (সুরা ইবরাহিম : ১০)

0 LIKE
0 LOVE
0 LOL
0 SAD
0 ANGRY
0 WOW