অলস পড়ে রয়েছে বিপুল টাকায় নির্মিত পদ্মা সেতুর গ্যাস পাইপলাইন। ২০২২ সালের জুন থেকে পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। এরও প্রায় তিন মাস আগে সম্পন্ন হয় গ্যাস পাইপলাইনের নির্মাণ কাজ। তবে ২০২৩ সালে তা রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস সঞ্চালনকারী সংস্থা গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) কাছে হস্তান্তর করা হয়। পদ্মা সেতুর ওপর নির্মিত ৭৬২ মিলিমিটার গ্যাস পাইপলাইনটি ইতোমধ্যে জিটিসিএলের নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়েছে। সংস্থাটি এর রক্ষণাবেক্ষণও করছে সংস্থাটি। এখন দক্ষিণাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য দুই প্রান্তে ১১০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনাধীন এ পাইপলাইনটি কুমিল্লার লাঙ্গলবন্দ থেকে শুরু হয়ে মাওয়া এসে যুক্ত হবে পদ্মা সেতুর পাইপলাইনে। সেতু পার হয়ে জাজিরা থেকে লাইনটি টেকেরহাট হয়ে চলে যাবে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত। প্রাথমিক প্রাক্কলন অনুযায়ী এ সঞ্চালন লাইন নির্মাণে খরচ হতে পারে ২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য একটি সমীক্ষা পরিচালনা করলেও প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে পাঁচ্ছে না জিটিসিএল। জ্বালানি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকার দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাসের সংযোগ দিতে চাচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সার কারখানা, বাণিজ্যিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্যাস সরবরাহ। ওই লক্ষ্যে পদ্মা সেতুতে বসানো হয়েছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার গ্যাস পাইপলাইন। ব্যয় হয়েছে ২৭৪ কোটি টাকারও বেশি। তবে সেতুর দুই প্রান্তে সংযোগ না থাকায় পাইপলাইনটি কোনো কাজেই আসছে না। বরং দুই বছরের বেশি সময় ধরে অলস পড়ে আছে। এমনকি পদ্মা সেতুর সংযোগ গ্যাস পাইপলাইনের কাজ কবে নাগাদ শুরু হবে তার কোনো দিনক্ষণও জানাতে পারছে না জিটিসিএল কর্তৃপক্ষ। বরং বলা হচ্ছে, প্রকল্পটিতে অর্থায়নের জন্য জিটিসিএল মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এখন অর্থায়নটাই হলো মূল সমস্যা। এখানে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) অর্থায়ন করবে, নাকি বাংলাদেশ সরকার করবে, সে সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে না। এমন পরিপ্রেক্ষিতে আপাতত পদ্মা সেতুর ওপর নির্মিত গ্যাস পাইপলাইনটি ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। পদ্মা সেতু বা এ ধরনের বড় বড় অবকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করতে হয়। ভবিষ্যতে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে গ্যাস সঞ্চালন যেন করা যায়, সেজন্যই এ পাইপলাইনটি তৈরি করে রাখা হয়েছে। এখন লাঙ্গলবন্দ থেকে মাওয়া, মাওয়ার পর পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতু পার হয়ে জাজিরা থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত গ্যাস সঞ্চালন লাইন হবে। পদ্মা সেতুর ওপরে লাইনটি বানানো আছে। যদি জিটিসিএল অর্থায়ন পায় অথবা সরকার যদি প্রকল্পটিতে প্রাধান্য দেয়, তাহলে দ্রুতই পাইপলাইনটি তৈরি করে ফেলা সম্ভব হবে। সূত্র জানায়, লাঙ্গলবন্দণ্ডগোপালগঞ্জ পাইপলাইনই নয়, দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সংযোগ দিতে জিটিসিএলের আরো পাঁচটি প্রকল্প পরিকল্পনাধীন রয়েছে। পদ্মা সেতুর গ্যাস পাইপলাইন দিয়ে সেগুলোয় গ্যাস সরবরাহ করা হবে। প্রকল্পগুলো হলো পায়রা-বরিশাল ও বরিশাল-খুলনা সঞ্চালন লাইন, টেকেরহাট-ফরিদপুর ও টেকেরহাট-বরিশাল সঞ্চালন লাইন, খুলনা-গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট সঞ্চালন লাইন, ভোলা-বরিশাল সঞ্চালন লাইন ও সাতক্ষীরা-খুলনা সঞ্চালন লাইন। প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে নির্মাণ করা হবে ৫৮২ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন লাইন। খরচ হবে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। ২০৩৪ সালের মধ্যে এগুলোর কাজ শেষ করার লক্ষ্য থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনোটিতেই অর্থায়ন নিশ্চিত করতে পারেনি জিটিসিএল। এদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্যাসের সঞ্চালন পাইপলাইনের এসব প্রকল্প সরকারের অযৌক্তিক ও সমন্বয়হীন পরিকল্পনা। উন্নয়নকে ঘিরে যদি এসব প্রকল্প নেয়া হয়, তাহলে সমন্বয়ের মাধ্যমে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। গ্যাসের নতুন সঞ্চালন লাইনে একদিকে যেমন গ্যাস দেয়া যাচ্ছে না, তেমনি সঞ্চালন লাইনের অভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া স্থানীয় গ্যাসের উৎসের বাড়তি জোগান নেই। এলএনজিকে কেন্দ্র করে পাইপলাইনে বিপুল অংকের বিনিয়োগ আর্থিকভাবে ফলপ্রসূ হবে না। এতে জ্বালানি বিভাগের চাপ আরো বাড়বে। পাশাপাশি দুই বছরের বেশি সময় ধরে পদ্মা সেতুর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইনটি অলস পড়ে থাকার কারণ হিসেবে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা। মূলত কতটা গ্যাস উৎপাদন করা হয় আর কতটা আমদানি করা হয় তার ভিত্তিতে সরবরাহ পরিকল্পনা করা উচিত। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় এক ডজন অর্থনৈতিক অঞ্চলের কথা বলা হচ্ছে। সেখানে গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে কিনা সেটাও দেখা উচিত। সামগ্রিকভাবে পদ্মা সেতুর গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণে সমন্বয় বা পরিকল্পনার ঘাটতি আছে। পদ্মা সেতুর গ্যাস পাইপলাইনে মোটা অংকের বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু এর সুফল প্রলম্বিত হয়ে যাচ্ছে। এর বদলে তাৎক্ষণিকভাবে সুফল পাওয়া যাবে, এমন প্রকল্পে বিনিয়োগ করলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বেশি ভালো হতো। অন্যদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদাউস জানান, ‘নির্মাণকাজ শেষ করে গ্যাস পাইপলাইনটি জিটিসিএলের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এটির সব দায়-দায়িত্ব এখন তাদের। তারাই এর রক্ষণাবেক্ষণ করবে। তবে পদ্মা সেতুর ওপরে থাকা গ্যাস পাইপলাইনটির মালিকানা সেতু কর্তৃপক্ষের কাছেই থাকবে। এটি ব্যবহারের জন্য জিটিসিএলের কাছ থেকে ট্যারিফ আদায় করবে সেতু কর্তৃপক্ষ। এজন্য আলাপণ্ডআলোচনা শুরু হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, সেতু কর্তৃপক্ষ পাইপলাইনটি জিটিসিএলের কাছে হস্তান্তর করেছে। এখন সেটির যেসব রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হচ্ছে সেগুলো জিটিসিএলই করছে।