রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ব্যর্থতার মুখোমখি হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি অর্জন হলেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে সংস্থাটি। জানা গেছে, টানা ১২ বছরেরও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারেনি এনবিআর। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পরও লক্ষ্য পূরণ হয়নি। বরং ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। বিদায়ী ২০২৩-২৪ সংশোধিত বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ৯০ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়েছে। মূল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আদায় কম ৩৮ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিল সরকার। সেখানে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে সরকারি ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে সাত লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য কমিয়ে ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ ছিল রাজস্ব আয় বাড়ানোর। নতুন ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও একইভাবে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর চাপ রয়েছে। এ ছাড়া করছাড় কমানোর শর্তও রয়েছে। এনবিআরের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে তিন লাখ ৭১ হাজার ৮৪২ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হয়েছে। এর মধ্যে আমদানি পর্যায়ে এক লাখ ৩৭৮ কোটি টাকা, ভ্যাটে এক লাখ ৪০ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা এবং আয়করে এক লাখ ৩১ হাজার ২৫ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে এনবিআর। গত অর্থবছরের তুলনায় আয়কর আদায়ে সর্বোচ্চ ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ, ভ্যাটে ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং আমদানি পর্যায়ে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে। গত অর্থবছরে আমদানি পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ হাজার ৩২১ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। ভ্যাটে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ৫১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। কম আদায় হয়েছে ১১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া আয়করে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ৪৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। এদিকে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও এনবিআরকে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দিয়েছে সরকার। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, কর প্রশাসন সংস্কার না করলে রাজস্ব আদায় প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছাবে না। এনবিআরের নীতি ও প্রশাসনিক সংস্কারের পাশাপাশি এর পরিষেবাগুলির সম্পূর্ণ অটোমেশনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, গত অর্থবছরের শুরু থেকেই স্পষ্ট ছিল রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে। এটি উচ্চাভিলাষীর চেয়ে বেশি ছিল। দেশে কর-জিডিপির অনুপাত বিশ্বে সর্বনিম্ন জানিয়ে তিনি বলেন, কর প্রশাসন দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। এছাড়া, এনবিআরের পিছিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিকে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি বেতন ৭৮ হাজার টাকা হওয়ার পরও কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ ওঠে এ প্রসঙ্গে তিনি এনবিআরের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিল ট্রাইব্যুনালের সভাপতি মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে। সম্পদের হিসাব নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কের জেরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে বদলি করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, মতিউরের মতো এনবিআরের আরও অনেক কর্মকর্তা আছেন যাদের অপকর্মের কারণে সংস্থাটি আরও পিছিয়ে পড়ছে। এছাড়া বাস্তব পরিস্থিতি লক্ষ না করেই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা দেওয়ার কারণেও রাজস্ব আদায় কমছে বলে মনে করছে অনেকে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, গত অর্থবছরের শুরু থেকেই স্পষ্ট ছিল রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে। এটি উচ্চাভিলাষীর চেয়ে বেশি ছিল। দেশের বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই সরকার গত ১০-১৫ বছর ধরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে আসছে। উপরন্তু, লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বারবার ব্যর্থতা রাজস্ব কাঠামোর বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করছে। তিনি কর ফাঁকি রোধে, দুর্নীতি নির্মূলে সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ওপর কর কর্তৃপক্ষকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন। এদিকে দেশের রাজস্ব আহরণ পদ্ধতি টেকসই নয় বলে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ তুলছে আইএমএফ। গত মে মাসে ঋণ কর্মসূচির আওতায় তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে বাংলাদেশ সফর করেন সংস্থাটির দ্বিতীয় রিভিউ মিশনের কর্মকর্তারা। মিশন শেষে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের নিম্ন কর-জিডিপি অনুপাত বিবেচনায় সামাজিক কল্যাণ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ বাড়াতে টেকসই রাজস্ব আহরণ করা অপরিহার্য। এজন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির বিপরীতে কর-রাজস্বের অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়াতে দৃশ্যমান করনীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের কোষাগারে যে পরিমাণ অর্থ জমা হয় সেটির ভিত্তিতেই রাজস্ব আহরণের পরিসংখ্যান হিসাব করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (সিজিএ)। অন্যদিকে এনবিআরের পক্ষ থেকে অনেক সময় আদায়ের অপেক্ষায় থাকা অংকও রাজস্ব আহরণের পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে, এনবিআরের আহরণকৃত হিসেবে দেখানো অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে আরো পরে। আবার প্রণোদনা পেতে সংস্থাটির কর্মকর্তাদের মধ্যে রাজস্ব আহরণ বেশি দেখানোর প্রবণতা কাজ করে বলেও অভিযোগ রয়েছে। রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমকে পুরোপুরি ডিজিটাল করা গেলে পরিসংখ্যানগত এ ব্যবধান দূর হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, লক্ষ্যের চেয়ে কম রাজস্ব আহরণের প্রভাব পড়বে বাজেট বাস্তবায়নে। এমনিতেই দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি চাপে রয়েছে। সরকারের অনেক দেশি ও বিদেশি ঋণ রয়েছে। এ ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ সরকারের প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। আরো অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে পড়ছে সামষ্টিক অর্থনীতি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজস্ব আদায়ের ধারবাহিক ব্যর্থতা দূর করতে হলে এনবিআরে বড় সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। কেননা, অভ্যন্তরীণ খাত থেকে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এই রাজস্ব প্রশাসন দিয়ে একটি বিশাল লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।