জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার তারাকান্দিতে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম ইউরিয়া উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যমুনা সার কারখানা থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গড়ে উঠে ছিল মাফিয়া সিন্ডিকেট। অভিযোগ উঠেছে গত ১৫ বছরে শুধুমাত্র যমুনা সার কারখানা থেকেই লুটে নিয়েছেন হাজার কোটি টাকা।
১৯৯০ সালে দেশের এই বৃহত্তম সার কারখানা প্রতিষ্ঠার পর থেকেই লুটপাটের একটি রাজনৈতিক চক্র গড়ে উঠে। বিভিন্ন ক্যাটাগরীর কাজ নিয়ন্ত্রনের জন্য একাধিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠলেও মূল সিন্ডিকেট ছিলো একটি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের জেলা, উপজেলা ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত মাফিয়া সিন্ডিকেট যা সব সময়ই মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন।
এসব মাফিয়া সিন্ডিকেটের গড ফাদাররা সব সময় পর্দার আড়ালে থাকতেন। ১৯৯১ সনে ক্ষমতাসীন বিএনপির সময়ে চক্রটি আড়ালে কাজ করলেও ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আমলে চক্রটি প্রকাশ্যে আসে। সার কারখানার ‘সিবিএ’ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শুরু হয় সার কারখানায় লুটপাটের রাম রাজত্ব। আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদে নানাভাবেই কারখানাটিতে হরিলুট চলেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সার পরিবহন, শ্রমিক হ্যান্ডেলিং, সার ব্যাগিং টেন্ডার ও বিভিন্ন মালামাল ক্রয়, অকেজো মালামাল বিক্রয়, বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ এবং বিভিন্ন সার ডিলারদের বরাদ্দকৃত সার উত্তোলনের সিরিয়াল নিয়ে চাঁদাবাজি, এ্যামোনিয়া গ্যাসের বোতল বাণিজ্য, অবৈধ পন্থায় ডিলারদের উত্তোলিত সার ক্রয়-বিক্রয় এমনকি এলাকার বরাদ্দকৃত সার বাইরে কালো বাজারে বিক্রি করাই ছিলো সিন্ডিকেটের কাজ। সেসবের গড ফাদার নেতৃত্বে ছিলো ফারুক আহমেদ চৌধুরী।
যমুনা সার কারখানা শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন এবং ট্রাক পরিবহন মালিক সমিতির যৌথ পরিকল্পনায় ট্রাক পরিবহন শ্রমিক এবং স্থানীয় দলীয় নেতা-কর্মিদের ব্যবহার করে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন জামালপুর জেলা শাখার ব্যনারে এ লুটপাট করা হয়েছে। যখন যেই দল ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলের নিয়ন্ত্রণে থাকে সার কারখানা। লুটপাটের অংশীদার ছিলেন তৎকালীন কর্মকর্তারাও। তারা কারসাজি করে কারখানা বন্ধ করে দিতেন। ফলশ্রুতিতে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টি করে অধিক মুনাফা লাভে সিন্ডিকেটকে সহায়তা করতেন এবং বিনিময়ে কর্মকর্তারও লাভবান হতেন। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে, যমুনা সার কারখানায় প্রাকৃতিক গ্যাসের অপর্যাপ্ত সরবরাহের কারণে উৎপাদন ঘাটতির কথা বলে হঠাৎ সার উৎপাদন বন্ধ করা হয় ফলে সারের দাম স্থানীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। ২০১০ সালে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাপ কম এবং প্রযুক্তিগত নানা সমস্যার কারণ দেখিয়ে কারখানাটি ১১ বার উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। যে কারণে কারখানাটি এপ্রিল/২০১০ থেকে জুন ২০১১ পর্যন্ত বন্ধ ছিল। ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারী নিরাপত্তারক্ষীরা কারখানা থেকে তিন টন সালফিউরিক অ্যাসিড পাঁচারের সময় একজন ট্রাক চালককে ধরে ফেলে। ২০১৭ সালে অনিশ্চিত গ্যাস সরবরাহের কারণে উৎপাদন সমস্যায় পড়েছিল। সিন্ডিকেট প্রধান ফারুক আহমেদ চৌধুরীর পরিকল্পনায এসব ঘটনা ঘটানো হয় বলে অভিযোগ উঠেেেছ। ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর যমুনা সার কারখানায় আগুন লেগে উৎপাদন বন্ধ হয়। তখন সরকার দেশীয় চাহিদা মেটাতে ইউরিয়া সার আমদানি করে। সেই আমদানিকৃত সারের মূল্য ছিলো প্রায় ৫৭০ মিলিয়ন টাকা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এসব সার খোলা জায়গায় সংরক্ষণ করার কারণে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এসব ঘটনার সবগুলোই সেই লুটেরা সিন্ডিকেটের কারসাজি ছিলো বলে দাবি স্থানীয় জনগন ও সার ব্যবসা সংশ্লিষ্ট ডিলারদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সার ব্যবসায়ী ও স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা জানান- বিগত ১৫ বছরে লাগাতারভাবে এই সার কারখানাকে ঘিরে লুটপাট করছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের লুটেরা সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের গড ফাদার ছিলেন- জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ চৌধুরী। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে এই সিন্ডিকেটের সাথে সক্রিয় ছিলেন- রফিকুল ইসলাম, ইমান আলী, মুশতাক হোসেন ও হারুন অর রশীদ প্রমুখ। অনুসন্ধানে জানা যায়-সার পরিবহন, শ্রমিক হ্যান্ডলিং, সার ব্যাগিং টেন্ডার ও বিভিন্ন মালামাল ক্রয়, অকেজো মালামাল বিক্রয়, বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ, বিভিন্ন সার ডিলারদের বরাদ্দকৃত সার উত্তোলনের সিরিয়াল নিয়ে চাঁদাবাজি, এমোনিয়া গ্যাসের বোতল বানিজ্য, ডিলারদের উত্তোলিত সার অবৈধ পন্থায় ক্রয়-বিক্রয় ও বরাদ্দ এলাকার বাইরে কালো বাজারে বিক্রি করাই ছিলো এই সিন্ডিকেটের কাজ। তিনি আরো বলেন- আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও যমুনা সার কারখানায় সেই লুটপাট এখনও থেমে নেই। লুটেরা চক্রের গড ফাদার ফারুক চৌধূরীর লুটপাটের সেই সাজানো বাগানে তিনি শুধু নেই, কিন্তু পুরো বাগানটি এখনও সচল রয়েছে দাবি এলাকাবাসীর।
জামালপুরের একজন সার ব্যবসায়ী জানান- যমুনা সার কারখানাকে ঘিরে গড়ে উঠা ফারুক চৌধুরীর লুটেরা সিন্ডিকেট ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫ বছর শুধু এমোনিয়া গ্যাস সিলিন্ডার ক্রয়-বিক্রয় করেই মুনাফা করেছিলো প্রায় ১২০ কোটি টাকা। এই ব্যবসাটি তখন ফারুক চৌধুরী একাই করেছেন। পরবর্তীতে এই নিয়ে দলীয় নেতারা বিক্ষুব্ধ হলে তিনি ২০১৮ সালের পর এটির সিংহভাগ নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাকি অংশ বিভিন্ন জনের মাঝে বন্টন করে দেন। সেই হিসাবে- ২০১৪ সন থেকে ২০২৪সন পর্যন্ত বিগত দশ বছরে ফারুক চৌধুরী যমুনা সার কারখানার এমোনিয়া গ্যাসের বোতল বিক্রি করেই মুনাফা করেছেন অন্তত দুইশত কোটি টাকারও অধিক। তাছাড়া এই সার কারখানার বিভিন্ন টেন্ডার নিয়ন্ত্রন, ডিলারদের সার ক্রয়ের স্লিপ জোর পূর্বক ক্রয় করে বরাদ্দকৃত সার জেলার বাইরে বিক্রি করে বিগত ১৫ বছরে হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা। তিনি আরও বলেন- ফারুক চৌধুরী ছিলো বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের দীর্ঘ সময়ের সাধারণ সম্পাদক।পুতুল সভাপতি ছিলো সরিষাবাড়ির সার ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগ নেতা মুশতাক আহম্মেদ। এ পদে থেকে জামালপুর সার মনিটরিং কমিটির সদস্য হন তিনি। ঐ পদে থেকে তিনি সবচেয়ে বড় যে অনিয়মটি করেছেন- সেটি হলো সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী বিসিআইসির আমদানীকৃত নন ইউরিয়া সারের ডিলার হিসাবে বিএডিসি’র অনুমোদিত সকল বীজ ডিলারগণ লাইসেন্স পাওয়ার কথা থাকলেও তিনি হতে দেননি ২০০৮ সন থেকে। তাঁর পছন্দ মত বিসিআইসির ডিলার ও কতিপয় বিএডিসি’র অনুমোদিত বীজ ডিলারদের দেয়ার বিষয়ে সুপারিশ করেন। উল্লেখ্য নন ইউরিয়া সারের ডিলারশীপের জন্য জেলা বিএফএ’র সুপারিশ ছাড়া জেলা সার মনিটরিং কমিটি কোনো লাইসেন্সের ছাড়পত্র দিতেন না। তিনি আরও বলেন- নন ইউরিয়া সারের মাসিক বরাদ্দ এবং স্পেশাল বরাদ্দ নিয়ে তিনি সেই ২০০৮ সন কারসাজি করে আসছেন। স্পেশাল বরাদ্দের পুরোটাই তিনি চট্রগ্রাম বন্দরের বিক্রি করে দিতেন। আর মাসিক বরাদ্দের বিষয়টি তিনি পছন্দের ডিলারদের কিছু দিয়ে বাকি গুলো নিজেই আত্মসাৎ করতেন। এই নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিএডিসি’র বীজ ডিলারগন আন্দোলন করেও কোন প্রতিকার পাননি। বিগত ১৫ বছরে এই নন ইউরিয়া সারের বরাদ্দ বিক্রি করে তিনি শত কোটি টাকা লুটপাট করেছেন।
সার কারখানা লুটেরা সিন্ডিকেট প্রধান ফারুক চৌধুরীর নানা অপকর্ম জেলার সব শ্রেণির মানুষ জানলেও কেউ কোনোদিন টুশব্দ করতে পারেননি। তার উপর এক কেন্দ্রীয় নেতা ঠাকুরের আশীর্বাদ থাকায় সব সেক্টরেই লুটপাট করেছেন তিনি।
গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর লুটেরা সিন্ডিকেট প্রধান ফারুক চৌধুরী গা-ঢাকা দিলেও তার সবকিছু চলছে আগের মতই। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা তার মোবাইল ফোনেই এখনও সব নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন।
তাকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন জামালপুর বাসীর।