চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মির্জাপুর গৌতমাশ্রম বিহারে আগামী শনিবার (২ নভেম্বর) পবিত্র দানোত্তম শুভ কঠিন চীবর দানোৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষে বিহার পরিচালনা কমিটি, গ্রামবাসী ও উপদেষ্টা পরিষদ দিনব্যাপী বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহন করেছে। বাংলা বছরের আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিন পূর্ণিমা তথা প্রবারনা পূর্ণিমা পর্যন্ত তিনমাসব্যাপী বর্ষাব্রত অনুষ্ঠান ও গৃহী সংঘের আমাবস্যা, অষ্টমী ও পূর্ণিমা তিথিতে উপসথ শীল গ্রহন অধিষ্ঠান শেষে যেইসব বৌদ্ধ বিহার / মন্দিরে ভিক্ষু সংঘ তিন মাস বর্ষাবাস পালন করে থাকে একমাত্র সেই বিহার তথা মন্দিরে এই চীবর দান অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা মহাকারুনিক গৌতম বুদ্ধ জীবতকালে দায়ক/ উপাসক, উপাসিকারা বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন বর্ষা মৌসুমে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পক্ষে বর্ষার কাদাযুক্ত পরিবেশে পিন্ড চারন করা / দায়কদের বাড়িতে ভিক্ষান্ন গ্রহন করা কস্টসাধ্য ব্যপার। তাই বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিহার / মন্দিরে অবস্থান করে বর্ষা মৌসুমে ধ্যান সাধনা, ধর্ম চর্চা করে ধর্মীয় শিক্ষায় হৃদ্ব হতে পারবে। বুদ্ধের দায়কদের এই কথা মনোপুত হয়েছিল। তাই এটাকে উপযুক্ত সময় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন মহাকারুনিক গৌতম বুদ্ধ। তাঁরই নির্দেশনা অনুসারে তিন মাসব্যাপী বর্ষাব্রত অনুষ্ঠান। বর্ষাবাসের তিন মাসের মধ্যে যেই বিহারে ভিক্ষু সংঘ বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান করে থাকেন সেই বিহার থেকে অন্য কোন স্হানে যাওয়ার ব্যাপারে বুদ্ধ কিছু বিধি বিধানের নিয়ম প্রবর্তন করেছিলেন মহাকারুনিক গৌতম বুদ্ধ। তাঁর সেই নির্দেশনায় উল্লেখ রয়েছে, বিহারে অধিষ্ঠানকারী ভিক্ষু বিহার ছেড়ে কোন স্হানে বিশেষ প্রয়োজনে গেলে সূর্যাস্তের পূর্বে বিহারে চলে আসার নিয়ম প্রবর্তন করেছেন বুদ্ধ। বর্ষাবাসের সময় বিহারে অধিস্হানকারী ভিক্ষু অন্যকোন স্হানে রাত্রি যাপনের বিধান রাখেনি বুদ্ধ। বিহারেই বাধ্যতামুকভাবে অবস্থান করতে হবে। তবে জন্মদাতা, পিতা মাতা কিংবা এই ভিক্ষুর কোন শিষ্য, অথবা ভক্ত মারাত্মক অসুস্থ হয় মৃত্যু শয্যায় থাকলে সেই ভিক্ষুকে শেষ দর্শন করার ইচ্ছে পোষন করলে সেখানেই সেই ভিক্ষু তাঁর বিছানায় নির্ধারিত মন্ত্র দিয়ে রাতে থাকার বিধানের কথা সর্বজন বিধি। বিহারের আওতাধীন সদস্যরা চীবর দানে আনুষ্ঠানিকভাবে বিহারে অবস্থানকারী ভিক্ষু সংঘ ও শ্রমন সংঘকে এই দানে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের পরিধেয় কাশায় বস্ত্র চীবর দান করে থাকে। কারণ হলো বুদ্ধের নির্দেশনা অনুসারে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা, সুতা থেকে কাপড়, সেই কাপড় সেলাই করে রং করে দান করা হয় বলে এই দানকে কঠিন চীবর দান বলা হয়ে থাকে। তাছাড়া কঠিন চীবর দান করার জন্য নিজেকে সকল প্রকার অকুশল পরিত্যাগ করতে হয়, সংযত হতে হয়, হিংসা পরিত্যাগ করতে হয়, লোভ, দ্বেষ, মোহ ত্যাগ করতে হয়, আত্ম শুদ্ধ করতে হয়,মনকে একাগ্র করতে হয়,চিত্তকে পরিশুদ্ধ করতে হয়, অপরের প্রতি বিদ্বেষ ভাব পরিত্যাগ করতে হয়, ক্ষমা সুন্দর মনোভাব সৃষ্টি করতে হয়, একে অপরের প্রতি হৃদতা ও আন্তরিকতার বন্ধন সৃষ্টি করতে হয়, কারো অমঙ্গল কামনা পরিত্যাগ করতে হয়, রোগাক্রান্ত মানুষের রোগমুক্তির বিষয় মনে এনে বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করতে হয়, মনের কালিমা দূর করতে হয়, সকল প্রানীর সুখ, নিরোগ শান্তি দীর্ঘায়ু কামনা করতে হয়, দেশের সমৃদ্ধি কামনা করে প্রার্থনা করতে হয়। বুদ্ধ জগতের সকল প্রানীর সুখী হউক সেই বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে অহিংসা পরম ধর্ম বলে দেশনা প্রদান করেছেন। মেত্তা, করুনা, মুদিতা উপেক্ষার বিষয় হৃদয়ে ধারন করে এইসব কঠিন নিয়ম পালন করে কঠিন চীবর দান করার নির্দেশনা প্রদান করেছেন ভিক্ষু ও দায়ক/ দায়িকা সংঘকে তাঁর জীবতকালে। তাই এইদানকে কঠিন চীবর দান বলা হয়ে থাকে। কঠোর এই নির্দেশনা মেনে এই দানানুষ্ঠান করার কারণে কঠিন চীবর দানকে শ্রেষ্ট দান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, সেই দানকে দান শ্রেষ্ঠ, দানের রাজা বলা হয়েছে। এই দান বছরে মাত্র একবার করা যায়। যেই বিহারে বৌদ্ধ ধর্মগুরু তথা ভিক্ষু সংঘ বর্ষাবাস অধিষ্ঠান করে থাকে। সংঘদান, অষ্ঠউপকরন দান শতবার করলে ও এই চীবর দানের ফলের শতভাগের এক ভাগ ও হবে না ভিক্ষু সংঘ দেশনা করে থাকেন। তাই এই চীবর দানের ফল অসীম ও অপরিমেয়।
আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে প্রবারনা পূর্ণিমা এই তিন মাস বর্ষাবাস অধিষ্ঠান শেষে বুদ্ধ ভিক্ষু সংঘকে তিন মাসের অধিষ্ঠানের সাধন লদ্ধ জ্ঞান বহু জনের হিত সুখের জন্য বিভিন্ন বিহারের আওতাধীন গ্রামে গিয়ে কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানে ধর্ম দেশনা প্রদানের মাধ্যমে লোকজনকে পরকালে নির্বান শান্তির জন্য ধর্মীয় নিয়ম কানুন মেনে চলতে উদ্ধুদ্ধ করতে ধর্ম উপদেশ প্রদান করে থাকেন চীবর দানানুষ্ঠানে। তারই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার মির্জাপুর গৌতমাশ্রম বিহারে আগামী শনিবার (২ নভেম্বর) পবিত্র শুভ দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এই বিহারে চীবর দান উপলক্ষে দিনব্যাপী বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহন করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আগামী শুক্রবার (১ নভেম্বর) গৌতমাশ্রম বিহারে নান্দনিক ৬ষ্ঠ সংঘরাজ ধর্মানন্দ মিলনায়তনে বুদ্ধ কীর্তন, আলোক সজ্জা, শনিবার (২ নভেম্বর) ভোরে পবিত্র ত্রিপিটকের মঙ্গলবানী পাঠ, সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয়, ধর্মীয় ও বিহারের পতাকা উত্তোলন, ভিক্ষু সংঘের প্রাতঃরাশ, বুদ্ধ পূজা অষ্টশীল ও পঞ্চশীল গ্রহন, অস্ট উপকরনসহ সংঘদান, চীবর দানে উপস্থিত ভিক্ষু সংঘের পিন্ডদান, অতিথিদের মধ্যহ্ন ভোজ, বেলা দেড়টায় দানসভা মঞ্চে ভিক্ষু সংঘের আসন গ্রহন, ফুল দিয়ে ভিক্ষুসংঘদের বরন, মঙ্গলাচরনের মাধ্যমে চীবর দানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু, উদ্বোধনী ও বরন সংগীত, দানোত্তম শুভ কঠিন চীবর দান শীর্ষক ধর্মীয় আলোচনা সভা, চীবর পরিক্রমা, কল্পতরু ও পুস্পমেরুদান, চীবর উৎসর্গ, কল্পতরু ও পুস্পমেরু উৎসর্গ, দেশের সমৃদ্ধি, জীব জগতের শান্তি ও প্রার্থীব জগতের মঙ্গল কামনায় সমবেত প্রার্থনার মাধ্যমে দিবসের কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষনা করা হবে। চীবর দানোৎসবের যাবতীয় প্রস্ততি ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে বলে মির্জাপুর গৌতমাশ্রম বিহার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক লায়ন অনুপম বড়ুয়া গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।