একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অগ্রগতির জন্য শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। রাজনীতি ও রাজনীতির শিক্ষা- দুটোই অঙ্গাঙ্গি জড়িত বলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কখনোই রাষ্ট্রীয় ও দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত নয়। কিন্তু জাতীয় ঐক্য ও সমৃদ্ধির জন্যে সামগ্রিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে দলীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হয়। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান দুর্দশার অন্যতম প্রধান কারণ হলো গোটা শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় রাজনীতির প্রত্যক্ষ প্রভাব। বিগত দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণের অপ্রয়াসের মাশুল নানাভাবে শিক্ষাখাতকে দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানউত্তর রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় সংস্কারের প্রথম ধাপেই এ দুরবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে সামষ্টিক কল্যাণ ও অগ্রগতির উদ্দেশ্যে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান প্রবণতা যে জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে, সেখান থেকে সংস্কারের মাধ্যমে বেরিয়ে আসা খুব একটা সহজ কাজ হবে বলে মনে হয় না। দুর্বৃত্তায়নের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেশে দীর্ঘদিন ধরে চালু আছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চার অভাব ও বিভিন্ন দলের কিছু নেতাকর্মীর বর্তমান আচার-আচরণের আলামত দেখে প্রচলিত রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি থেকে অতি সহজে বেরিয়ে আসা যাবে ভাবাটা হবে আমাদের অবাস্তব প্রত্যাশা। কিন্তু তাই বলে আমাদের আশা ছেড়ে দিলে চলবে না; অব্যাহত প্রচেষ্টা চালাতে হবে শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির প্রভাব মুক্ত করতে। সাম্প্রতিক শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপকমাত্রায় দলীয়করণ শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ডকে দুর্বল করে ফেলেছে অনেকাংশে। দলীয় লোকজনকে নিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের পরিবর্তে রাজনৈতিক পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। নিয়োগ-বাণিজ্যের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা শিক্ষাদানের পরিবর্তে সরকারি দলের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা ও নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করেছে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর দলীয় মতাদর্শ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে রাষ্ট্র সংস্কারের ও দেশগঠনের যে সুযোগ এসেছে সেটা হাতছাড়া হয়ে গেলে আমরা যে তিমিরে আছি, সে তিমিরেই থেকে যাবো। তাই শিক্ষা সংস্কারের প্রথম ধাপেই শিক্ষা প্রশাসনে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও আইন প্রণয়নসহ সেগুলোকে দ্রুত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যেখানে কোনো দল বা ব্যক্তির রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত করে আমাদের একটি সুষ্ঠু, উন্নত এবং সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি ‘বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত’ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও কাঠামো উপহার দেবে।