আদালতের যুক্তি: ‘এখনো বাস্তবায়ন হয়নি’

নারী সংস্কার কমিশনের বিতর্কিত সুপারিশ নিয়ে দায়েরকৃত রিট খারিজ

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশ: ২৬ মে, ২০২৫, ১২:১৩ পিএম
নারী সংস্কার কমিশনের বিতর্কিত সুপারিশ নিয়ে দায়েরকৃত রিট খারিজ

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের দেওয়া কিছু সুপারিশ নিয়ে বিতর্ক এবং বিরোধিতা চলছিল দীর্ঘদিন ধরে। ইসলামী শরিয়ত ও সংবিধানবিরোধী অভিযোগ এনে এই সুপারিশগুলোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। রিটকারীর দাবি ছিল, কমিশনের বেশ কয়েকটি সুপারিশ ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক স্থিতি এবং সাংবিধানিক ভারসাম্যের পরিপন্থি। তবে আদালত এই রিট খারিজ করে দিয়েছে এই মর্মে যে, সংশ্লিষ্ট সুপারিশগুলো এখনো সরকার বাস্তবায়ন করেনি। সুতরাং আদালতের মতে, বিষয়টি এই মুহূর্তে ‘প্রাক-কালের উপযোগী’ নয়।

সোমবার (২৬ মে) বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, "এখন পর্যন্ত সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। প্রয়োজনে ভবিষ্যতে রিটকারী আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবেন।"

এই রিটটি দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রওশন আলী। গত ৪ মে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় তিনি এই আবেদন করেন। রিটে তিনি দাবি করেন, নারী সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ ইসলামী শরিয়তের মৌলিক বিধান এবং বাংলাদেশের সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের পরিপন্থি। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি স্বাধীন কমিটি গঠন করে বিষয়টি পুনঃপর্যালোচনারও আবেদন জানানো হয়েছিল।

কমিশনের সুপারিশের মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত অংশ ছিল—

পুরুষ ও নারীর জন্য সমান উত্তরাধিকার প্রস্তাব, যা কোরআনের সুরা নিসা (৪:১১)-এর বিরোধী বলে উল্লেখ করা হয়;

বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব, যা সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ধর্মচর্চার অধিকার লঙ্ঘন করে;

“মাই বডি, মাই চয়েস” স্লোগানের ব্যবহার, যা শরিয়তের নির্ধারিত নৈতিক সীমার বাইরে চলে গেছে বলে অভিযোগ;

যৌনকর্মকে বৈধ পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব, যা ইসলামি মূল্যবোধ ও সংবিধানের ২(ক) এবং ২৬ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে দাবি করা হয়।

অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের নভেম্বরে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করে। কমিশন কাজ শুরু করে ডিসেম্বর মাসে এবং তাদের মেয়াদ ছিল ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত, যা পরে ৩১ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কমিশন গত ১৯ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের ৩১৮ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে মোট ৪৩৩টি সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

প্রতিবেদনের প্রকাশের পরপরই ধর্মভিত্তিক দলগুলো এই প্রতিবেদন নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। হেফাজতে ইসলাম নারী সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি জানায়। জামায়াতে ইসলামী এই প্রতিবেদনকে ‘গর্হিত’ আখ্যা দেয় এবং সমাজে ‘চরম অস্থিরতা’ সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করে। তরুণদের একটি সংগঠন এনসিপিও অভিযোগ করে, এই সংস্কার কমিশনের সুপারিশে নারীর সর্বজনীন প্রতিনিধিত্ব যথাযথভাবে নিশ্চিত করা হয়নি।

কমিশনের সুপারিশে যেসব বিষয় গুরুত্ব পায়:

১. অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রতিষ্ঠা করে সব ধর্মের নারীদের জন্য সমান বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণের অধিকার নিশ্চিত করা।

২. সন্তানদের ওপর নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করতে অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০ সংশোধন।

৩. নির্বাচিত সরকার কর্তৃক মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মীয় উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে নারীর জন্য সম্পত্তিতে সমান ভাগ নিশ্চিত করা।

৪. সংসদীয় আসন সংখ্যা বাড়িয়ে নারী সংরক্ষণের আওতায় সরাসরি নির্বাচন চালু করা।

৫. বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যেও জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে আইনে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে