দিনাজপুরের খানসামায় সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রীর আশির্বাদে মন্ত্রীর ভাগ্নের কাজের ছেলে কোটিপতি হয়েছে। মন্ত্রীর পরিচয়ে বিভিন্ন নিয়োগের সুপারিশ, তদবির, চাঁদাবাজি, দখল ও মাদক কারবারের কমিশন বাণিজ্য। এলাকায় পরিচিতি লাভ করেন ছায়া-প্রশাসক হিসেবে। জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসন পর্যন্ত তার কথায় ওঠ-বসা করতো। তার বিভিন্ন অপকর্মের বিষয়ে জানার পরেও কেউ ভয়ে মুখ খুলতো না। খাদেমুল ২০১৪-২০১৯ সাল পর্যন্ত পিএস থাকাকালে নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন বিপুল অবৈধ সম্পদের পাহাড়। কাজের ছেলে থেকে বনে গেছেন কোটিপতি। তার উত্থানের নেপথ্যে আশীর্বাদ ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
মন্ত্রীর ভাগ্নের বাসার কাজের ছেলে খাদেমুল ইসলাম দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বাড়ি দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার ভেড়ভেড়ী ইউনিয়নের খামার বিষ্ণুগঞ্জ গ্রামে। তার পিতা লিয়াকত আলী ছিলেন একজন দিনমজুর। সংসারে অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। তার সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হতো। তাই পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে খাদেমুল সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাগ্নে অধ্যক্ষ শাহাদত হোসেন সবুজের বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে কাজ নেন। সেখানে তিনি গরু-ছাগল চরাতেন। জমিতে সেচ দিতেন এবং বাজার-সদাই আনা-নেয়ার কাজ করতেন। আত্নীয়ের বাড়িতে কাজ করার সুবাদে খাদেমুল মাঝে-মধ্যে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর বাড়িতে বাজার দিয়ে আসাসহ বিভিন্ন কাজের জন্য যাতায়াত করতেন। এক পর্যায়ে ওই আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ির কাজের ছেলে খাদেমুলকে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ব্যক্তিগত সহকারী (পিও) হিসেবে নিয়োগ দেন। এতে কপাল খুলে যায় খাদেমুলের। এরপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর পিও হওয়ার পর খাদেমুলের জীবনযাত্রায় দেখা দেয় আমুল পরিবর্তন। পাল্টে যায় তার পরিচয়, আর্থিক অবস্থা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই খাদেমুলের গ্রামের পুরনো ভাঙা বাড়িটি রুপ লাভ করে আধুনিক বাসভবনে। বিঘায় বিঘায় জমি কিনেছেন। মাছ চাষের জন্য রয়েছে বিশাল পুকুর। গড়ে তুলেছেন গরু-মহিষের বিশাল খামার। উপজেলার পাকেরহাটে রয়েছে তার বিডি ফাউন্ডেশন নামে একটি ক্লিনিক।
রয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শেয়ার। উপজেলার মানুষ তাকে চিনেন একজন ক্ষমতাধর ও সম্পদশালী ব্যক্তি হিসেবে। উপজেলার রাজনৈতিক অঙ্গনে আজও আলোচনার কেন্দ্রে একটি নাম-খাদেমুল ইসলাম।
স্থানীয়রা জানান, খাদেমুল মন্ত্রীর পিও হওয়ার পর থেকেই প্রশাসনের ওপর একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন। টেন্ডার, প্রকল্প বরাদ্দ, নিয়োগ কোনো কিছুই তাকে কমিশন দেয়া ছাড়া হতো না। থানার ওসিদের হাত করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তার, আসামী তুলে নেয়া, ভয়ভীতি প্রদর্শন করা ছিল তার নিত্যনৈমত্তিক কাজ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাও দায়ের করাতেন। আবার মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে সেই মামলা প্রত্যাহারও করাতেন।
স্থানীয় শাহজালাল বলেন, এই খাদেমুল আমাকে রাজনৈতিক কারণে অসংখ্য মামলার আসামী করেছে। তার অত্যাচারে আমরা অনেকেই শান্তিতে একটু বাড়িহে থাকতে পারি নাই। আমাদেরকে দীর্ঘদিন ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে থাকতে হয়েছে। বর্তমান সময়ে এসেও তার দাপট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এতে আমরা খুব শঙ্কিত ও চিন্তিত।
রহিদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বলেন, আমার একটি মামলার জামিন হবার পর থানায় রিকল জমা দিতে গেলে থানার সে সময়ের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কৃষ্ণ বলেন, এ রিকল নেয়া যাবে না। পিও খাদেমুলের নির্দেশ আছে। ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে, না হলে হবে না। এ অভিযোগ থেকে বোঝা যায়, থানার কার্যক্রমেও তার প্রভাব কত গভীরে ছিল।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন বলেন, খাদেমুল আমার বন্ধু ছিল। এক সময় তার বাইসাইকেলও ছিল না। পায়ে জুতা থাকতো না। অনেক বার আমি তাকে ভাত খাইয়েছি। আজ তার গাড়ি, বাড়ি-এসব দেখে মনে হয়, আমি যেন স্বপ্ন দেখছি। প্রশ্ন উঠেছে-তার এত সব অর্থ কোথা থেকে এলো?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের এককর্মী আক্ষেপ করে বলেন-কী আর বলব, রাজনীতির জন্য রাজপথে লড়াই করা, মার খাওয়া, মিছিল-মিটিংয়ে দৌঁড়াদৌড়ি ও মামলার আসামী হলাম আমরা সাধারণ নেতাকর্মীরা। আর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন খাদেমুলের মতো লোকেরা। এখন আমরা ঘরে থাকতে পারি না। আর খাদেমুল বুক ফুলিয়ে চলছেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর ছত্রছায়ায় কোটিপতি বনে গেছেন খাদেমুল। তার গাড়ি-বাড়ি, ক্লিনিক-সবকিছুই আছে। সে টাকা খরচ করে এখন দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর আমরা পুলিশের ভয়ে বাইরে রাতযাপন করছি।
স্থানীয় যুবদল নেতা রাশেদুজ্জামান স্মৃতি খাদেমুল ইসলামের নামে একটি মামলা দায়ের করেছেন। তিনি মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন, ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের সময় খাদেমুল ও তার সহযোগীরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বাড়ি-ঘরে হামলা, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আরও উল্লেখ করেন, স্মৃতির নিকট ৫ লাখ টাকা দাবি করেন। তিনি ৩ লাখ টাকা দেয়ার পরেও খাদেমুল তার নিকট আরও ২ লাখ টাকা দাবি করেন। এ টাকা না দিলে তাকে হত্যা ও গুমের হুমকি দেন। এক পর্যায়ে তাকে রাস্তায় রড, কুড়াল ও লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। জুলাই বিপ্লবের পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হলেও ঠিক আগের মতোই ক্ষমতাবান হিসেবেই আছেন খাদেমুল। তার নামে বিভিন্ন অভিযোগ ও মামলা থাকলেও কোন কারণে তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করছে না। স্মৃতি আরও বলেন, আমি মামলা করার পর থেকেই খাদেমুলকে ধরার জন্য থানা পুলিশকে একাধিকবার তাগিদ দিয়েছি। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। খানসামা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নজমূল হক বলেন, খাদেমুলের নামে মামলা আছে। তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।